আনোয়ারুল হক ||
মৃত্যু
সংবাদ মনকে নাড়িয়ে দেয় সত্য কিন্তু তেমন প্রিয়জন না হলে কারও কারও মৃত্যু
সংবাদ মনের ওপর গভীর ছাপ ফেলার কথা না। সাধারণ মৃত্যু আর প্রিয়জনের চলে
যাওয়ার বেদনাবোধের মধ্যে পার্থক্য আছে। রূপম তার প্রিয়জন নয়। বন্ধুও নয়,
স্রেফ সহপাঠি। আর দশজনের মতো। সকালের শীতোষ্ণ রোদ বেলা দশটার দিকে যেমন
মিলিয়ে যায় তেমন। তবুও-
আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ছেলে অমল স্কুলে আর
অমলের বাবা সাজেদুল অফিসে চলে যাওয়ার পর নির্ভার মনটাকে নিয়ে সে দোতলার
খোলা বারান্দায় দোলনা চেয়ারটতে থিতু হয়ে বসেছিল। সামনের টিপয় নিচু টেবিলে
ধূমায়িত এক কাপ দুধ চা। ডুপ্লেক্স বাড়িটার ঝুল বারান্দার বুক ছুঁয়ে একটা
সুঠাম দেবদারু গাছ। তার ডালে বসা দুটো শালিকের গা ঘেঁষাঘেষি খুনসুটি দেখতে
দেখতে রূপার চোখ সকাল নটার আকাশে মেঘে নীলে ঘুরছিল।
বসন্ত এসে গেল
বুঝি। দূরে কোথাও একটা কোকিল ডেকে উঠলো। ঝিরঝিরে বাতাসটা মন ভালো করে দেয়
তেমন পাষাণ প্রাণেরও এমন। ঠিক সেই সময় কান্তার ফোল পেল সে। নব টিপে ফোনটা
কানে তুলতেই শুনলো,
এই রূপা, একটা খারাপ খবর আছে রে-
বল শুনছি। জবাব দিয়ে অপেক্ষা করে রূপা,
রূপমকে মনে আছে তোর ? সে আজ সকালে মারা গেছে। স্বরূপ একটু আগে ফোন করে জানালো। যাবি দেখতে ?
প্রথমে
রূপা মনে করতে পারলো না রূপম কে ? কান্তার ফোনে সংবাদটা শুনে চুপ করে রইল।
রূপার চুপ করে থাকা দেখে ওপাশ থেকে কান্তা তাড়া দিল,
কি রে, চিনতে পারছিস না ? ঐ যে, ঘোড়ামুখ- আমাদের সাথে পড়তো- রূপম
রূপার
নামের সাথে মিল থাকার কারণ, ঘোড়ামুখ বলাতেই ঝট করে নামটা মনে পড়ে গেল
রূপার। রূপম। তার জীবনের কাকতলীয় বিপত্তি। বৈপরীত্য, বিবমিষা, অসুখ,
বিরক্তি সবকিছু। রূপা জিজ্ঞেস করলো,
ও। তোর সাথে যোগাযোগ ছিল ?
না।
স্বরূপ, বিমল, মনির, বেলাল ওদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। ওরা সবাই যাচ্ছে দেখতে।
আমাকে বলেছে, তুই কি যাবি আমার সাথে? তাহলে আমি যাওয়ার সময় তোকে নিয়ে যাব।
জবাবে কান্তা কিছু বললো না রূপা। ফোনটা টিপয় টেবিলে রেখে দিল।
কান্তা
যাদের নাম বললো, ওরা সহ সে, কান্তা, নয়না, সোহেলি, মমতাজ সবাই একসাথে
পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ সমাজ বিজ্ঞান, কেউ বাংলা, কেউ ইংরেজি
বিভাগে। সবার মধ্যে বিষয়ের মিল না থাকলেও মনের মিল ছিল মৌচাকের মতো, একের
সাথে অপরের দারুণ। কত স্মৃতি! মান-অভিমান, হাসি-গল্পের সকাল-বিকেল, মধুর
কেন্টিন, টিএসসি, চারুকলা, শাহাবাগ সিনোরিটা, পাবলিক লাইব্রেরি, পরীক্ষা
সবশেষে বিদায়। এরপর বিয়ে, স্বামী-সন্তান, সংসার সবকিছু নিয়ে বন্ধুরা বছর
দশেক তো হয়েই গেল, একেকজন একেক প্রান্তে গেছে চলে। কেউ দেশে, কিউ বিদেশে।
তারপরেও
আজকাল ফেসবুক, এ্যাপস্ ও ম্যাসেঞ্জারের সুবাদে ফোনে কারো কারো সাথে
যোগাযোগটা থেকে গেছে তাদের। নিয়মিত যোগাযোগ হয় এমন কাছের বন্ধুদের একজন এই
কান্তা। উত্তরা, সাত নম্বরে থাকে। স্বামী ব্যাংকার, সে ছোট্ট একজন
এন্টারপ্রাইজার। স্কুলে পড়ুয়া আট বছরের এক ছেলে নিয়ে সুখি বাককাকুম, ভাল
আছে। চঞ্চলা, হুল্লুড়ে, উদ্যোমী কান্তাই প্রবল আগ্রহে তাদের জোটের বন্ধুদের
সঙ্গে আজও যোগাযোগ রেখেছে। কখনও পার্টি, পকনিক, আড্ডা এসবের আয়োজন করে সে
সবাইকে ডেকে হৈ চৈ লাগিয়ে দেয়।
কান্তার জন্যেই রূপমের খবরটা পেল রূপা।
মনে
রাখার কোন কারণ নেই বলেই হয়তো ভুলে গিয়েছিল সে তাকে। কিন্তু আড়ালে
বন্ধুদের মুখে মুখে চালু থাকা বিদঘুটে বিশেষণ ‘ঘোড়ামুখ’ নামটা কান্তা
উচ্চারণ করতেই ওর স্মৃতির ঝাঁপি পে-োরার কৌটোর মুখের মতো ফট্ করে মত খুলে
গেল।
খুলতে খুলতে, তারপর-তারপর কোথাও একটা মোচড় খেয়ে আচমকাই মনটা খারাপ
হয়ে গেল রূপময়ী সেনগুপ্তা রূপার। অনুর্ধ পয়ত্রিশ, হালকা-পাতলা,
শ্যামবর্ণা, দীঘল চুলের অনিন্দ্য সুন্দর।
যদিও মন খারাপ হবার কথা নয়
তার। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একটি ঘটনা অথবা দুর্ঘটনাটি ছাড়া যাকে দেখলে, চোখ
পড়লে, সামনা-সামনি হলে বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে, বন্ধুদের আড্ডায় সে
থাকলে দশহাত দূর দিয়ে পালিয়ে স্বস্তি পেতো রূপা তার মৃত্যু সংবাদে কি ওর
খুব খারাপ লাগার কথা! আর দশটা সাধারণ মৃত্যু সংবাদের মতই তো পিঁপড়ের কামড়
যেমন, তেমনি ভাবটা চলে যেতে পারতো।
অবাক ব্যাপার! তা হলো না।
বন্ধুরা
সবাই জানতো, রূপা রূপমকে কেবল অপছন্দই করতো না, ভীষণ বিরূপও ছিলো সে ওর
প্রতি। আর তার জন্যে রূপমকে দায়ী করা যায় না কোন মতেই। কেননা, কাকতলীয়
ভাবেই রূপার নামের সঙ্গে মিলে গেছে রূপমের নাম। আর কোন মানুষই তার নিজের
চেহারাটা নিজে বানিয়ে জন্মায় না। তাহলে দুনিয়ার তাবৎ মেয়েরা ট্রয়ের হেলেন
আর ছেলেরা গ্রিক প্রেমের দেবতা কিউপিড হতে চাইতো। রূপম সবকিছু ঠিকঠাক নিয়ে
জন্মালেও তার সুঠাম শক্ত-পোক্ত, বলিষ্ঠ শরীরের মতো ওর মুখটা তেমন আকর্ষণীয়
ছিলো না। বরং উল্টো ছিল। যাকে আক্ষরিক অর্থে বলা যেতে পারে ঘোড়ামুখ। মুখের
সামনের দিকটা লম্বাটে, নাক চাপা, গাল-চোয়াল শক্ত গঠনের ভাঙ্গা, চোখ দুটো
তেমনি, সেইসাথে মাথার চুল ঘাড়ের ওপর লম্বা বিছানো এবং একটু লালচে। যে
কারোরই হঠাৎ করে রূপমের দিকে চোখ পড়লে চমকে ওঠবে।
এই রূপম সমাজ বিজ্ঞান
বিভাগে রূপাদের সহপাঠি ছিল। যদিও সে ছিল বিনয়ী, সদালাপী, বন্ধু বৎসল।
কিন্তু ওর এমন বিদঘুটে চেহারাটা ছেলে বন্ধুদের সয়ে গেলেও মেয়েরা ওকে সহ্য
করতে পারতো না। রূপাও অন্যদের মতোই রূপমকে এড়িয়ে চলতো ঠিক, কিন্তু একটি
ঘটনায় সেটা রূপ নিলো তীব্র বিরক্তি ও বিরূপতায়।
সেদিন ছিল ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস। কলাভবন সহ পুরো এলাকা রূপসী সাজে সেজে
আছে। কোন ক্লাশ ছিল না, নেই আগমী তিনদিন। সবাই যার যার আনন্দে মেতে আছে
কলাভবনের একতলা, দোতলা, তিনতলা, করিডোরে সবখানে। রূপাদের দলের সবাই তখনো
আসেনি বলে সকাল এগারটার দিকে কান্তা, নয়না, রুপা, সোহেলি দোতলা থেকে
একতলাতে নামার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ছিল বাকিদের অপেক্ষায়। চারিদিকে হৈ চৈ,
হাসি হুল্লোড়, বেলুন নিয়ে মাতামাতি। সারা বিশ্ববিদ্যালয় যেন কোমড় দুলিয়ে
নাচছে বাজনার তালে তালে।
হঠাৎ পিছন দিক থেকে দোতলার করিডোরে চুমকী তাদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বললো, আসছে রে আসছে..
কী
আসছে, কে আসছে খবর নিল না কেউ। বাহারী শাড়ি পড়া রূপাদের দলটা হুড়মুড় করে
সিঁড়ি ভেঙ্গে একতলার দিকে নামতে গেল। রূপা ছিল সামনে, বাকীরা পেছনে। কিন্তু
বিধি বাম। অনভ্যস্ত হাই হিলে রূপার শাড়ির লম্বা আঁচল গেল জড়িয়ে। কাঁধের
কাছ থেকে টান পড়ে টাল সামলাতে না পেরে পিছলে গেল রূপা। ওর পা দুটো শূন্যে
উঠে গেলে ভয়ে একটা চিৎকার দিয়ে সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। তারপর ভয়ংকর কিছুর
অপেক্ষায় ছিল ও।
আর এই সময় নিচতলা থেকে ঘোড়ামুখো রূপম এবং তার বন্ধুরা
নিচের দিকে থেকে উপরে উঠে আসছিল। রূপম ছিল দলটির সামনে। মোড় ঘুরতেই রূপম
দেখলো রূপা সি-েরেলার মতো মেঘের আকাশে বাতাসে উড়তে উড়তে ধেয়ে আসছে তার
দিকে। শক্ত ধাতের যুবক ঘাবড়ালো না। নিত্য দিনের খেলা ক্রিকেট বলের মতো
দুইহাতে পাঁজাকোলা করে রূপাকে লুফে নিলো ঘোড়ামুখো রূপম। বিপদজনক দূর্ঘটনা
থেকে রূপার বেঁচে যাওয়ার এই দৃশ্যে বন্ধুরা সবাই হাততালি দিয়ে খুশি হলেও
সম্বিত ফিরে পেয়ে রূপা খুশি হলো না।
সিঁড়ি থেকে পড়তে পড়তে যন্ত্রণাকাতর
পতন এখনও হলো না কেন ভেবে রূপা চোখ খুলে যখন দেখলো, সিঁড়ির নিচে সে রূপমের
দুই হাতের উপর এক দলা কাপড়ের পুটলির মতো দানা বেঁধে আছে, চারিদিকে সবাই
আনন্দে হাততালি দিচ্ছে। রূপমের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে আর সুর করে ছড়া কাটছে,
রূপা রূপম, রূপা রূপম
চমচম খাবো, চমচম।
তাতে
কৃতজ্ঞতা দূরে থাক্, ভীষণ রেগে গেল রূপা। শরীরটাকে এঁকেবেঁকে রূপমের কোল
থেকে মাটিতে নেমে রূপা চিৎকার করে কেঁদে ফেললো। দাঁতমুখ খিচিয়ে হুল ছড়ালো,
কেন ধরেছো তুমি আমাকে ? অসভ্য, ইতর, ঘোড়ামুখো জানোয়ার, সরো- বজ্জাত কোথাকার..
তারপর
রূপা যা করলো সেটা অতিরিক্তই ছিল। গালমন্দ করার পর রূপা রূপমকে হতভম্ব করে
দিয়ে ওর হালে সপাটি চড় মেরে দিয়েছিল। সেটা যে সে রাগের মাথায় করেছিল
বন্ধুরা তা বুঝতে পারলেও রূপম তার কোন ব্যাখ্যা চায়নি কোনদিন। আর কখনো
রুপাদের সামনেও আসেনি।
অবশ্য ইচ্ছে না থাকলেও রূপাকে আরও একদিন রূপমের সামনে যেতে হয়েছিল।
ফোনটা আবার বাজলো। কান্তা।
এক হাতে চায়ের কাপে আর অন্য হাতে ফোন ধরলো রূপা। কান্তার গলায় কাঁচ ভাঙার আহ্বান, যাবি ?
কেন জানি এবার আর দ্বিতীয়বার ভাবলো না রূপা। বললো,
যাবো। তুই আয়। আমি শাড়িটা পাল্টে রেডি হই। নিচ থেকে হর্ণ দিস্।
এর আধাঘন্টা পর গে-ারিয়ার দিকে যেতে যেতে রূপা কান্তাকে জিজ্ঞেস করলো,
ঠিকানা জানলি কীভাবে ?
ফোন নাম্বার ছিল, যোগাযোগও ছিল। বিমল, মনির ওরা জানতো। ওর কি দোষ ছিল বল্। শুধু শুধু তুই
রূপা কান্তাকে থামিয়ে দিতে কোলের ওপর রাখা হাতে চাপ দিল,
থাক্, ওসব, পুরনো কথা এখন-
কান্তা
ড্রাইভারকে ফুটওভার ব্রিজের পাশে গলির মুখে ডানদিকে ঢুকতে বললো। তারপর হাত
দশেক দূরে বেশকিছু জমায়েত, সাদা টুপি মাথায় লোকজনকে রাস্তার উপর দাঁড়ানো
দেখিয়ে গাড়ি সেখানে থামাতে বললো।
ঠা-া ভেজা ভেজা একটা বাতাস বইছে
এলাকাটির আশেপাশে। চারিদিকে গাছ-গাছালি ভর্তি উঠোন দিয়ে ঘেরা দোতলা হলুদ
রঙের বাড়িটা শোকে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ছোট্ট লোহার গেট দিয়ে ওদের ঢুকতে দেখে
মনির আর স্বরূপ এগিয়ে এসে ভিতরে নিয়ে গেল। সামিয়ানার নিচে উঠোনে শব
যাত্রীদের বসার জন্য চেয়ার পাতা আছে। পশ্চিম দিকে এক কোণে চাদর দিয়ে ঘিরে
একটা জায়গায় শবের গোছলের জন্য ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বাড়ীর ভিতর থেকে একটি
কিশোরি মেয়েকে বেলা নাম ধরে ডেকে রূপাদের ভিতরে নিয়ে যেতে বললো মনির।
বাতাসে আগরবাতি, কর্পূর আর আতরের গন্ধে মন কেমন কেমন করে। পুরো বাড়ি জুড়ে
বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরষের আনাগোনা, অচেনা মুখের ভীড়ে রূপা, কান্তারা শোবার
ঘরের একটা খাটের ওপর নি:সাড় বসে থাকে। বিহ্বল চোখে না পছন্দের সহপাঠির
মৃত্যুশোক অনুভব করার চেষ্টা করে রূপা।
কিছুক্ষণ পর মনির একবার এসে রূপাদের বলে গেল,
বসো
তোমরা। আমরা না আসা পর্যন্ত যেয়ো না। লাশ গোছল করিয়ে কবরস্থানে পাঠিয়ে
দিয়ে তোমাদের নিয়ে একসাথে বের হবো। রূপমের মা আর ঐ বোনটি, যে তোমাদের নিয়ে
এলো সে ছাড়া ওর আর কেউ নেই। বিয়ে থা করেনি।
দুই
কথাটা কি রূপাকে শোনালো মনির! রূপম বিয়ে করেনি।
কেন ? এই প্রশ্ন করে নিজের মনটাকে ক্ষত করতে চাইল না রূপা। তারপরেও কথাটা মন থেকে সরলো না। কাঁটাটা নড়তে লাগলো, কান্তা টের পেল না।
ফাইনাল
পরীক্ষার পর রেজাল্ট হয়নি বলে সবাই তখনো হল ছাড়েনি। সেই সময় একদিন বিকেলের
দিকে ডাকে চিঠিটা পেয়ে এবার আর রাগ কিংবা বিরক্তি নয়, হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল
রূপা। এক লাইনে লেখা রূপমের চিঠি। আমি তোমাকে ভালবাসি, রূপা। ইতি। রূপম।
এই
চিঠি পাবার দিন দশেক পর টিএসসির ক্যান্টিনে রূপমকে পেয়ে রূপা কোন রাগ
দেখালো না। বললো, এখানে অপেক্ষা করো। আধাঘন্টার মধ্যে আমি আসছি।
তারপর
দ্রুত রোকেয়া হলে ওর রুমে ফিরে গিয়ে রূপমের চিঠির জবাব হাতে নিয়ে ফিরে
এসেছিল রূপা। যে কথা রূপা আর রূপম ছাড়া কেউ জানে না। মনে পড়ে। রূপমকে সেদিন
আবারও কষ্ট দিতে একটুও কষ্ট হয়নি রূপার। তবে, দশ বছর পর আজ আর সেই মনের
জোরটুকু যেন নেই রূপার।
কবরস্থানে রূপমের লাশ পাঠিয়ে দিয়ে ঘন্টাখানেক পর
ওদের নিয়ে চারুকলার কেন্টিনে এলো মনির। তিনজনে একটা টেবিল ঘিরে চুপচাপ বসে
রইল মিনিট দশেক। চা সিঙারাও খেল কেউ কোন কথা না বলে। মনির টেবিলের ওপর
একটু ঝুঁকে রূপার চোখে চোখ রাখলো। রূপা চোখের ইশারায় জানতে চাইল, কী ?
মনির
শার্টের বুক পকেট থেকে একটা চৌকোণা রূপোর তাবিজ টেবিলে ওপর রাখলো। শব্দ
হলো। যেমন শব্দে ইট, কাঠ, পাথর অবহেলায় এদিক সেদিক পড়ে যায়। ঠাক্।
সেই শব্দে রূপা কান্তাদের চোখ পড়লো বস্তুটির ওপর। কান্তা চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করলো, ওটা কী ?
রূপোর তাবিজ। রূপমের বাম হাতের বাজুতে বাঁধা ছিল। গোছলের সময় লাশের গা থেকে আমি খুলে নিয়েছি।
কান্তা আবারও কৌতুহল নিয়ে বলে, ওসুখ বিসুখের জন্য বাঁধা ছিল তেমন কোন কিছু বুঝি ?
ডান হাতের মুঠো খুলে ওদের দুজনের চোখের সামনে মেলে ধরে মনির অনুচ্চ স্বরে বললো,
না। তাবিজের খোলের ভিতরে এই কাগজের টুকরোটা ছিল।
মনিরের মেলে ধরা চারকোনা করে কাটা সাদা কাগজের ওপর তিনজনের চোখ দেখলো,
কালো কালিতে লেখা একটি বাক্য,
‘ঘোড়ামুখ রূপম, আমি তোমাকে ভালবাসি না, ঘৃণা করি।’- রূপা।
সেদিন
বিকেলে রূপমকে লেখা কঠোর চিঠিটির জন্য রূপার চোখে কোন জল দেখেনি কেউ।
অনুতাপের কোন কথাও শোনা যায়নি ওর মুখে। সন্ধ্যার পর কান্তার সঙ্গে গাড়িতে
ঘরে ফিরতে ফিরতে রূপার কেবল মনে হয়েছে,
সব দু:খ পেতে হয় না। মনে মনেই থাকে। জলের চোখে পাতলা জলের দাগ। কষ্টের, যে কষ্ট শুধু নিজের।
৮/ ১/২০২১
মহাখালি, ঢাকা।