তানভীর দিপু:
ব্ল্যাক
হিট আর সুরমা নামে দুই মোরগের রক্তাক্ত লড়াই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হয়ে লড়ছে
ব্ল্যাকহিট আর কুমিল্লার সুরমা। রণক্ষেত্রে একে অপরকে ঠোকর মেরে, ধারালো
নখের আঁচড়ে রক্তাক্ত করছে। আঘাতের পর যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে সে-ই বিজয়ী।
মোঘল আমলের ঐতিহ্যবাহী মোরগ লড়াই বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায় হলেও
কুমিল্লায় আয়োজন করা হলো দুই জেলার ‘আসিল’ মোরগ লড়াই। গতকাল কুমিল্লা
নগরীর ভাটপাড়া এলাকায় অনুষ্ঠিত হলো ঐতিহ্যবাহী মোরগ লড়াই। ৭ ম্যাচের এই
লড়াইয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাছে হেরেছে কুমিল্লা। ৩টি ম্যাচ জিতেছে
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লার জয় একটি। আর বাকি গুলো ড্র হয়েছে।
এবারের আয়োজনে স্বাগতিক কুমিল্লার আসিল ক্লাব জহির ব্রাদার্স। আমন্ত্রিত হয়ে কুমিল্লায় খেলতে এসেছে ব্রাহ্মবড়িয়ার সূর্যকিরণ ক্লাব।
জহির
ব্রাদার্সে প্রতিষ্ঠাতা জহিরুল ইসলাম জানান, এই ক্লাবে কুমিল্লায় ২২ জন
সদস্য আসিল মোরগ পালন করে। শখের বশেই এই মোরগ পালন করছে। আর শক করেই মোরগ
লড়াইয়ের আয়োজন করা হয়। যে জেলা স্বাগতিক থাকে সে জেলা-ই আমন্ত্রিত দলের সকল
ভার বহন করে। এতে যারা মোরগ লড়াইয়ের সাথে সম্পৃক্ত থাকে তাদের মধ্যে একটা
আন্তরিকতা তৈরী হয়। আর এর মাধ্যমে একটি ঐতিহ্যও রক্ষা হচ্ছে।
দুই দলই
মাঠে নামার আগে বাঁশের বড় বড় খাঁচায় করে ৯টি আছিল মোরগ নিয়ে আসে। সুরমা,
ব্ল্যাক হিট, ডেভিড, গলাছিলা, লাক্ষা, ঝামাসহ নানান আক্রমণাত্মক নাম
তাদের। ব্রাডমিন্টন কোর্টের মত দু’টি কোর্ট করে এক সাথে শুরু হয় দুই জোড়া
মুরগীর লড়াই। আলাদা আলাদা লড়াইয়ে চারটি মুরগীর জন্য থাকেন চার জন কোচ
যাদেরকে মোরগ লড়াইয়ের ভাষায় বলা হয় খলিফা। কমপক্ষে ৪০ মিনিট এবং সর্বোচ্চ ২
ঘন্টা ২০ মিনিট নির্ধারিত এক একটি ম্যাচে খলিফারা মোরগগুলোকে আক্রমণের
নির্দেশনা ও উৎসাহ দেয়। খেলার মাঝে বিরতিতে চলে মোরগ গোসল করানো আর
পরিচর্যার পালা। খলিফারা অত্যন্তদ যতœ করেই এই কাজ করেন। শুধু প্রতিযোগিতাই
নয়, এই লড়াই সম্মানের লড়াই মনে করেই চলে এই লড়াই-প্রতিযোগিতা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া
থেকে আসা মোরগ লড়াইয়ের খলিফা বাদল খন্দকার জানান, এক একটি মুরগীর দাম
৪০-৫০ হাজার টাকা। বাচ্চা মুরগীর দামই হয় ১০-১৫ হাজার টাকা। শৌখিন আছিল
পালকরা অত্যন্ত যতœ করে এই মোরগগুলো পালন করে। উন্নত খাবার এবং ঔষধসরবরাহ
করা হয় প্রয়োজন মত। এই মোরগগুলোও খুব মালিক ভক্ত, লড়াইয়ে জেতার জন্য তারা
প্রাণও দিতে পারে।
আছিল উন্নয়ণ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সুমন
চৌধুরী জানান, বাংলাদেশের গ্রামীণ খেলাধুলার ঐতিহ্য রক্ষায় কুমিল্লা ও
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ক্লাব গুলো মোরগ লড়াইয়ের আয়োজন করে যাচ্ছে। আমরা শখের এখনো
এই খেলা ধরে রেখেছি। এধরনের আয়োজন করে আমরা খুশি। আগামীতেও বাংলাদেশের যে
কোন জায়গায় মোরগ লড়াই হলে আমরা অংশ নিবো।
কুমিল্লার লড়াইয়ের ৭ ম্যাচে
৩টিতেই জয় পায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া। একটিতে কুমিল্লা জিতে আর বাকিগুলো ড্র হয়।
পুরষ্কার তুলে দিতে এসে কুমিল্লা সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সুমন
ভৌমিক জানান, ‘আসিল উন্নয়ণে কেউ যদি প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের সহযোগিতা চায়
অবশ্যই সহযোগিতা করা হবে।’
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, একসময় ভারত থেকে
ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইলের দেওয়ান বংশ এই আসিল মোরগ নিয়ে আসেন। আগেরকার দিনের
রাজা-বাদশার এটিকে পুষতেন বলে একে রাজকীয় মোরগও বলা হয়।
শোনা যায়, টিপু
সুলতান, সম্রাট আকবরসহ অনেক রাজা এই মোরগগুলো শখ করে পুষতেন। এদের লড়াই
দেখাটাকে বিনোদনের অংশ হিসেবে নিতেন। তবে, এখন এই খেলাটি বাংলাদেশে তেমন
দেখা না গেলেও তুরস্কের জাতীয় খেলা কিন্তু এই মোরগ লড়াই। ভারত, পাকিস্তান,
মিয়ানমার, জাপানেও এই খেলার প্রচলন রয়েছে।