বিশেষ
প্রতিনিধি ॥ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের
নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে পাক হানাদাররা। পুরো বাংলাদেশ চলছে বঙ্গবন্ধুর
অঙ্গুলি হেলনে, নির্দেশে। ধানম-ির ৩২ নম্বর থেকে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ
দিচ্ছেন, সেই অনুযায়ী চলছে বাংলাদেশ। শুধুমাত্র ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া
বাংলাদেশের আরও কোথাও কোন নিয়ন্ত্রণ নেই পাকিস্তানের সামরিক জান্তার।
মিছিলে মিছিলে উত্তাল ছিল সারাদেশ। চরমে পৌঁছে দেশব্যাপী চলা লাগাতার
অসহযোগ আন্দোলন। এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও
ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মধ্যে টেলিফোনে দেশের সর্বশেষ
রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।
টেলিফোনে দুই নেতা আলোচনার পর
আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টা বৈঠক করেন। বিকেলে
পল্টন ময়দানে এক জনসভায় তুমুল করতালির মধ্যে অশীতিপর বৃদ্ধ ন্যাপ নেতা
মওলানা ভাসানী পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে উদ্দেশে করে বলেন, ‘ইয়াহিয়া
সাহেব অনেক হয়েছে, আর নয়। তিক্ততা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। তোমার ধর্ম তোমার,
আমার ধর্ম আমার- এ নিয়মে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও।’
এদিকে
ইসলামাবাদে সরকারীভাবে ঘোষণা করা হয়, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট
ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে আসবেন। সামরিক কর্তৃপ রাত ৯টা থেকে রাজশাহী শহরে ৮
ঘণ্টার কার্ফু জারি করে। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক
হল ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সংগঠনের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকের সভাপতিত্বে সভায় গত ২ মার্চ ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের
ছাত্র জনসভায় গৃহীত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণা’র প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।
গভীর
রাতে ইসলামাবাদে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে ‘খ’ অঞ্চলে (বাংলাদেশ) সামরিক
শাসক নিয়োগ করা হয়। এই নিয়োগ ৭ মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়েছে বলে ঘোষণা করা
হয়। টিক্কা খান ৭ মার্চ সামরিক বিমানে ঢাকায় আসেন। ৬ মার্চ তাকে
পূর্বাঞ্চলে (বাংলাদেশ) গবর্নর নিয়োগ করা হয়। এদিন তার গবর্নর হিসেবে
কার্যভার গ্রহণ করার কথা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঢাকা হাইকোর্টে
হরতাল চলাকালে কোন বিচারপতি নবনিযুক্ত সামরিক গবর্নরের শপথ অনুষ্ঠান
পরিচালনা করতে অস্বীকার করেন। জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টা প্রয়োজনে বাংলাদেশ
থেকে জাতিসংঘের স্টাফ ও তাদের পরিবারবর্গকে প্রত্যাহারের জন্য ঢাকার
জাতিসংঘের উপ-আবাসিক প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেন।
এদিকে, একাত্তরের এই দিনে
ঢাকা শহর মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। যেখানে সেখানে জটলা, মিছিল, মিটিং
চলতেই থাকে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী সারাদেশে মাতৃকাকে শত্রুমুক্ত
করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে যুবকরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। চলে বিভিন্নস্থানে
গোপন অস্ত্রের প্রশিণ, গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি।
বাংলাদেশের যুবকদের
রক্তে তখন একই নেশা, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের
সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ দু’চোখে দেশকে হানাদারমুক্ত করার
স্বপ্ন। বাঙালীদের নতুন একটি দেশ। বাঙালির হৃদয়ে শুধু স্বাধীন-সার্বভৌম
বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন। তাই তাদের রক্তে বইতে থাকে টগবগে উত্তেজনা।
শুধু অপো পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ওপর আক্রমণের মাধ্যমে সশস্ত্র
মুক্তিযুদ্ধের।
এদিকে সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চরমে
পৌঁছে। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী এ বাংলায় তাদের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলে। পাক
সামরিক জান্তার কোন নির্দেশ কেউই মানে না। এ জনপদের প্রতিটি মানুষ
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অরে অরে পালন করছে। এমনকি শুধু ক্যান্টমেন্ট ছাড়া পাক
সামরিক জান্তা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশ পালন করতে মুখের ওপর ‘না’
বলতে থাকে বাঙালী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সাধারণ মানুষ অপোয়, এরপর কী
হবে? তরুণ-যুবক ছেলেরা সবাই মনে প্রাণে প্রস্তুতি নিতে থাকে চূড়ান্ত ডাকের
অপোয়। অন্যদিকে যুব সমাজকে সংগঠিত করতে সারাদেশেই সংগ্রাম কমিটি গঠিত
হচ্ছে। অবসরপ্রাপ্ত বাঙালী সেনা অফিসার-সৈনিকরা গোপনে নানা স্থানে সশস্ত্র
প্রশিণের মাধ্যমে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে থাকে স্বাধীনতার স্বপ্নে
বিভোর বাঙালী দামাল ছেলেদের।