আবদুল হাসিব ।।
একাত্তরে আমি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। রাজনীতি, অর্থনীতি, মুক্তিযুদ্ধ- এসব বোঝার বয়স ছিল না। কিন্তু ভয়ানক দিনরাত্রির কথা আজও ভুলতে পারি না। বিশেষত এপ্রিলের সেই দিনটি। মনে আছে, দিনটি শনিবার। উজ্জ্বল দুপুরে আমি ও আমার ভাই কুতুব উদ্দিন 'পেলুন জাল' নিয়ে বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা লোলা নদীতে মাছ ধরছিলাম। পুঁটি, টেংরা, কই, শিং- পাঁচমিশালি মাছ। হঠাৎ শুনি কোলাহল। তীরে তাকাতেই দেখি মানুষের স্রোত। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে পালাচ্ছে। পাড়ার সবাই পালাচ্ছে; প্রাণের ভয়ে প্রায় উদোম দেহে। পাগলপ্রায় ছুটছেন বাড়ির কর্তা। তার পিছু ছুটছেন পুত্র-কন্যা-জায়া-ভ্রাতা-ভগ্নি সবাই! কোথায় ছুটছেন- প্রশ্ন করার সময়ও যেন নেই। কেবল তাগিদ- পালাও! পূর্বদিক থেকে পশ্চিমদিকে পালাতে হবে।
আমরা দুটি ভাই তখনও কিংকর্তব্যবিমূঢ়! হঠাৎ কানে ভেসে এলো- পাঞ্জাবি আসছে! পালিয়ে যাও; মহিলাদের বাড়ি থেকে সরাও! এবারে আর বুঝতে বাকি থাকল না কিছুই। কেননা, ২৫ মার্চ থেকেই শুনে আসছি, পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ করছে। এসব শুনতে শুনতে শিশুমনেও ওদের তা-বের রূপ মোটামুটি এঁকে ফেলেছিলাম। তাই বুঝে ফেলামাত্রই নদীর পাড়েই পেলুন জাল আর মাছগুলো ছুড়ে ফেলে দুই ভাই বাড়ি অভিমুখে ছুটে আসছিলাম। বাড়ি পৌঁছামাত্র শুনলাম আগ্নেয়াস্ত্রের বিকট শব্দ। মেশিনগান আর স্টেনগানের গুলির বর্ষণ এত কাছ থেকে জীবনে এই প্রথম শোনা। ঘরের ভেতরে ঢুকে দেখলাম, বাবাও অস্থির। তিনি তখন একটি বড় হাঁড়িতে গরুর মাংস রান্না করছিলেন। ঘরে বিমাতা থাকলেও বাবা মাঝে মাঝে তার শখের জিনিস কিনে এনে রান্না করতেন। তিনি ভালো রান্না জানতেন।
হঠাৎ দেখলাম, বাবা উনুনে পানি ঢেলে দিয়ে হাতের কাছে কাপড়চোপড়-টাকাকড়ি যা পেলেন তা নিয়ে 'চলো চলো! পালাই পালাই!' বলে পশ্চিমদিকে ছুটতে থাকলেন। বিয়ানীবাজার সদর থানার অবস্থান আমাদের বাড়ির পূর্বদিকে। পাঞ্জাবিরা ততণে বিয়ানীবাজারে ঢুকে পড়েছে এবং থানাটিলা ও ডাকবাংলোয় উঠে চতুর্দিকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করেছে। মেশিনগানের অবিশ্রান্ত গুলি মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। একেক সময় মনে হচ্ছে, এই বুঝি পিঠে এসে বিঁধে গেল! প্রাণভয়ে শুধুই সম্মুখপানে ছুটছি। লোলা নদী পাড়ি দিয়ে সামনের বিশাল মাঠ পার হতে হবে। ঠোঁটে-মুখে পানি নেই। ভয়-ত্রাস, তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে বুক। এমতাবস্থায় হঠাৎ বাবার হাত ছেড়ে হারিয়ে গেলাম পলায়নপর জনতার মাঝে। আমি পাগলের মতো কাঁদছি আর হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে তাদের খুঁজছি। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য!
আমার হাতে ছিল একটি সনি ব্র্যান্ডের ফাইভ ব্যান্ড রেডিও। আমার বড় ভাইয়ের একান্ত প্রিয় বস্তু। আমারও প্রিয়। পালানোর সময় তিনি বাড়ি ছিলেন না বলেই আমি হাতে নিয়ে ছুট দিয়েছি। ডান হাতে শক্ত করে রেডিওটি ধরেছি আর ছুটছি। পরনে হাফপ্যান্ট আর লন্ডন থেকে আমার ছোট মামার দেওয়া কেরোলিন হাফ শার্টটি কোমরে প্যাঁচ দিয়ে বাঁধা। এমন পরিস্থিতিতেও কিছু লোক আমাকে বলতে লাগল- পাঞ্জাবি রেডিও দেখামাত্র তোকে আগে গুলি করবে! ওটা ফেলে দে! আমি কারও কথা না শুনে দৌড়াতে দৌড়াতে গরবিলের (শ্রীধরা গ্রামের পাশে) পাড়ে প্রায় চলে গেছি। ওই তো গোবিন্দশ্রী গ্রাম দেখা যাচ্ছে। ওখানে তো মেজো বুবুর বাড়ি। লোকের কাছে জিজ্ঞেস করে করে খুঁজে বের করে ফেলব।
মাথায় যখন এমন পরিকল্পনা, ঠিক তখনই শত সহস্র কান্নার সুর আর ডাকাডাকির মাঝে কানে ভেসে এলো মেজো ভাইয়ের কণ্ঠস্বর- হাসিব! হাসিব! ডাকতে ডাকতে মুখ দিয়ে তার ফেনা বেরোচ্ছে। কণ্ঠ যেন রুদ্ধ হয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলাম এবং ভাইকে জড়িয়ে ধরলাম। রেডিওটা তখনও হাতে।
তারপর মেজো ভাই আমাকে নিয়ে পুরুষপাল গ্রামে মামার বাড়ি গেলেন। সেখানে পরিবারের সবাই মিলিত হলাম এবং অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আশ্রয় নিলাম। স্বাধীনতার পর স্মৃতিবিজড়িত সেই রেডিওটি চুরি হয়ে গিয়েছিল। আজ এসব কাহিনি গল্পের মতো মনে হলেও তখন ছিল মর্মভেদী নির্মম সত্য।