ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে শিক্ষা অর্জন
Published : Friday, 19 March, 2021 at 12:00 AM
প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে শিক্ষা অর্জনরেজাউল করিম শামিম ।।
শিক্ষার সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশের একটি গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সেই গুরুত্ব অনেক আগেই উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। তারও অনেক আগে প্রায় চৌদ্দশ বছর পূর্বে আমাদের কুমিল্লার কোটবাড়ি এলাকায় শালবন বৌদ্ধবিহার নামের পত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়, তাও এই সাই বহন করছে যে, সেসময়কার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিবেশেরই প্রাধান্য ছিল। আর ছিলো বলেই ঐতিহ্যের শালবন বিহারে বহু বছর আগে গড়ে তোলা হয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়। রবীন্দ্রনাথও শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি ঘেরা শান্তিময় পরিবেশে গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশাল শিক্ষাবাতায়ন।
সবুজ গাছগাছালী আর উঁচুনীচু পাহাড় ঘেরা প্রান্তর। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দক্ষিণ পাশের আকাঁবাকাঁ পথ ধরে সালমানপুর এলাকায় এই সিসিএন বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান। প্রায় ৩২ একর পাহাড়ে ঘেরা জমির ভাঁজে ভাঁজে এই প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন অবকাঠামো স্থাপন করা হয়েছে। তার মধ্যে শিা, প্রশাসন, গবেষণা, মিলনায়তন, অভ্যর্থনা, মহিলা হোস্টেল, সুইমিংপুল, লাইব্রেরি, মসজিদ ইত্যাদি মিলিয়ে বর্তমানে ব্যবহৃত জমির পরিমান মাত্র তিন একরের মতো। বাকি সবটুকুই ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণ আর পর্যটন স্পটের মতো ঘুরে ফিরে দেখা, উপভোগ, উপলব্ধি করার নিমিত্তে রাখা। বিনোদনের সকল দুয়ার খুলে দিয়ে, মানসিক প্রশান্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত শিক্ষা-জ্ঞান ধারণ করা,স্মরণ রাখার উপযুক্ত একটি ব্যবস্থা বলা যায়।
প্রশাসনিক ভবন ও মহিলা হোস্টেল ছাড়িয়ে একটু বিপরীত পার্শ্বেই অপো করছে একটি বিস্ময়। সেখানে সিঁড়ি দিয়ে একটু একটু করে উপরে ওঠার ব্যবস্থা। প্রায় ষাট ফুট উপরে ওঠতে শারীরিক কষ্ট যাতে না হয় সেজন্যে কিছু দূর উঠে বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন ধাপে রয়েছে বিভিন্ন অবকাঠামো, ছোট পার্ক। সেখানে একটি বিরাট ছাতার আকৃতির ছাউনি রয়েছে, রোদবৃষ্টি বাঁচাবে। বসারও ব্যবস্থা রয়েছে। চমৎকার রেলিং ঘেরা, দাঁড়িয়ে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ বেষ্টনী সহজেই নজর কাড়ে। নীল আকাশ ছোঁয়া পর্বত সাদৃশ্য পাহাড় আর নানা ধরনের গাছগুল্ম। এখানেই রয়েছে গবেষক/অতিথিদের থাকা-খাওয়া এবং মিটিং করার সুব্যবস্থা। এছাড়া রয়েছে ছোট সুইমিং পুল আর ক্যম্পাস ছাড়িয়ে আকাঁবাকাঁ গ্রামীণ পথ ধরে হেটে হেটে প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যাওয়ায় সুযোগ।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৮টি বিষয়ে স্নাতক/সম্মান এবং ২টি বিষয়ে মাস্টার্স নিয়ে অধ্যয়নের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরকার এবং ইউজিসি অনুমোদন নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে ২০১৫ সাল থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব বিষয়েগুলো সংশ্লিষ্ট ছাত্র, শিক্ষক আর অভিভাবকসহ সাধারণের জানানোর জন্য কুমিল্লা বীরচন্দ্র নগরমিলনায়তন (টাউন হল) মাঠে মনোজ্ঞ শিক্ষা মেলার আয়োজন করা হয়েছিলো সম্প্রতি। সেখান থেকে অনেকেই আগ্রহী হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির বাস্তব অবস্থান এবং অবস্থা দেখার জন্য। তাছাড়া  এইচএসসি পাশ করে উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রমে ভর্তির জন্য যারা কোচিং সেন্টারে কাস করছে- তাদের অনেকেই দল বেঁধে প্রতিষ্ঠানটি দেখতে এবং অভিজ্ঞতা নিতে আসে। প্রতিদিনিই এমন ঘটনা ঘটে। এজন্য কর্তৃপ বিশেষ অনুষ্ঠানমালারও আয়োজন করে। সেদিন তেমনি একটি অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে আমাকে বক্তব্য দিতে হয়েছিলো।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে সেখানকার শালবন বৌদ্ধ বিহার তথা সেই হারিয়ে যাওয়া মানব সভ্যতার স্মারক তথা সেখানকার উচ্চ শিার কথা। প্রাসঙ্গিক ভাবেই তৎকালীন শিা ব্যবস্থার সাথে বর্তমানের মেলবন্ধ একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। সেখান থেকেই জেনেছি যে, সেই ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ বিহারে এখনো ছোট ছোট কুঠরির যে অবশিষ্ঠাংশ দৃশ্যমান, সেগুলো মূলত শিাগুরুদের থাকার ঘর ছিলো। এর সংখ্যা ১০৯টি। তৎকালীন শিা ব্যবস্থাপনাটা ছিলো এমন যে, একজন গুরুর কাছে একজন ছাত্রই কেবল পাঠ নিতো। আর তার কোন বাঁধাধঁরা সময়কাল নির্ধারণ ছিলোনা। গুরু যেসময় অনুধাবন করতেন যে তার শিষ্যর পাঠগ্রহণ সমাপ্ত হয়েছে-তখই কেবল পড়াশোনা শেষ। এর জন্য দুই বছর, তিন বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় লেগে যেতে পারে। আর যেদিন সেই মাহেন্দ্রটি আসবে, গুরু তার শিষ্যকে ডেকে জানিয়ে দেন এবং বলেন, বিহারের কাছেই অবস্থিত পুকুরটিতে স্নান করে আসতে। শিষ্য যথারীতি স্নান শেষে ভিজা বসনে গুরুর সামনে এসে পায়ে প্রনাম করে। তা করতে গিয়ে মাটির ধূলো-বালু কণা শিষ্যের কপালে লেগে থাকে তীলক চিহ্ন হয়ে। আর এই স্নান ও তীলক থেকেই ‘স্নাতক‘ ডিগ্রি শব্দটি এসেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে কুমিল্লায় উৎপত্তি এই অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ শব্দটি এখন ব্যবহৃত হয় সর্বত্র।
সেদিন, উচ্চ শিক্ষার অঙ্গনে পা রাখাতে অপেমান অনেক ছাত্রছাত্রীর সমাবেশ ঘটেছিলো সিসিএন বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে। আর সেখানেই এমনি জ্ঞানগর্ব অনেক আলোচনা হলো। বন্ধু প্রফেসর ড.আলী হোসেন চৌধুরীসহ অনেকেই বক্তব্য রাখেন। আলী হোসেনতো  নজরুলের ‘বল বীর’ কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে মাতিয়ে তুলেছিলো গোটা অঙ্গন। ড. আলী হোসেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার এবং অসুস্থ ভিসির অনুপস্থিতিতে ভিসির দায়িত্বও পালন করছেন। মূলত তাঁর নিমন্ত্রেণেই আমার সেখানে যাওয়া। সেখানে কথা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা, সদস্য সচিব এবং অবৈতনিক রেজিস্ট্রার তারিকুল ইসলাম চৌধুরীর সাথে। শিক্ষানুরাগী এই মানুষটি খুবই সাদাসিধে সহজসরল মানুষের প্রতিকৃতির। অথচ তিনি তাঁর কঠিন ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে চলেছেন। তার ইচ্ছে হলো উদ্যেক্তা শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সচেষ্ট থাকা। ফলে তিনি যেমনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনি সে এলাকায় ইতিমধ্যে গড়ে তুলেছেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, মডেল কলেজ, শিক্ষা ফাউন্ডেশন ইত্যাদি। তিনি জানান এই প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক ভাবে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে ২০১৫ সাল থেকে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে, মালোশিয়া, ভারত, চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ক্যাডিট ট্যন্সপারের চুক্তি রয়েছে। আমেরিকার মিসিগান ইউনির্ভাসিটির সাথেও আলোচনা প্রায় চূড়ান্ত। তিনি জানান, ঐসব প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাথে তাদের বোর্ড অব ট্রাস্ট্রির চেয়ারম্যন, সাবেক মন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু এমপি চুক্তি স্বার করেন।
সেখানকার মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আলোচনা প্রসঙ্গে উঠে আসে অতীতের কথা। গত শতাব্দির ষাটের দশক থেকে কুমিল্লাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবিতে কতইনা আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছে কুমিল্লাবাসীকে। সেসময় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের যৌক্তিক দাবিটি উপেক্ষা আর বঞ্চিত করেই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন করা হয় চট্টগ্রামে। অথচ সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছুই বদলে গেছে। আজ শালবন বিহারের ঐতিহ্য ধারক হিসাবেই যেন এখানে দু’দুটি বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। তারমধ্যে সিসিএন বিজ্ঞানও প্রযুক্তি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টিতো ভারতের কবিগুরুর লালমাটির প্রান্তরে তৈরি করা শান্তিনিকেতন বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কেই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। কোটবাড়ির লাল মাটি আর পাহাড়-সবুজ শ্যমলিমায় ঘেরা নৈশর্গীক পরিবেশে সেখানে শিা সংক্রান্ত  প্রয়োজনীয় সবকিছুর আয়োজন রাখা হয়েছে। এখন শুধু যাদের জন্য  সেইসব, সেই শিার্থীরা যদি এসব ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার পাশাপাশি দেশ ও জনগণের জন্য নিজেদের তুলে ধরতে পারে তবেই সার্থক হবে সব আয়োজন।