দৃষ্টি আকর্ষণ: মাননীয় মেয়র, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন
অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ।।
নদীকে আইনগত ব্যক্তি হিসেবে পৃথিবীর তৃতীয় ঘোষণা আসে তুরাগ নদীকে আইনি ব্যক্তি ঘোষণাকারী বাংলাদেশের মহামান্য হাইকোর্টের ২০১৯ এর ৩১শে জানুয়ারি ও ৩ ফেব্রুয়ারির রায়ে ১৭টি নির্দেশনার মাধ্যমে এবং তার অন্যতমগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ হচ্ছে-
১. এ রায়ে পাবলিক ট্রাষ্ট মতবাদের বিশদ ব্যাখ্যা, বিশ্লেøষণ ও বর্ণনা করা হলো যা আমাদের দেশের আইনের অংশ
২. “তুরাগ নদী”-কে আইনি ব্যক্তি/ আইনি সত্তা / জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হল। বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত সকল নদ-নদী একই মর্যাদা পাবে
৩. “নদী রক্ষা কমিশন”-কে তুরাগ নদীসহ দেশের সকল নদ-নদীর দখল ও দুষণমুক্ত করে সুরক্ষা, সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের নিমিত্তে আইনগত অভিভাবক ঘোষণা করা হল। নদ-নদী সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থা, অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় অদ্য হতে বাংলাদেশের সকল নদ-নদীর দূষণ ও দখলমুক্ত করে স্বাভাবিক নৌ চলাচলের উপযোগী করে সুরক্ষা সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও শ্রীবৃদ্ধির যাবতীয় উন্নয়নে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বাধ্য থাকিবে।
৫. তুরাগ নদীসহ দেশের সকল নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়ের ক্ষেত্রে নতুন প্রকল্প প্রণয়নের লক্ষ্যে পরিকল্পনা কমিশন, এলজিইডি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআইডব্লিউটিএ, বিএডিসিসহ সকল সংস্থা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে অবহিত করবেন এবং জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের অনাপত্তিপত্র গ্রহণ করবেন।
৭. নদী দখলকে এবং নদী দূষণকে ফৌজদারী অপরাধ গন্য করে এর কঠিন সাজা এবং বড় আকারে জরিমানা নির্ধারন করত: এ সংক্রান্ত মামলা দায়ের, তদন্ত এবং বিচারের পদ্ধতি উল্লেখপূর্বক জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০১৩ এর প্রয়োজনীয় সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করিবেন।
৮. ডিজিটাল ডাটাবেজ প্রনয়নের ক্ষেত্রে এসপিএ, আরআর, এসও স্যাটেলাইটের সাহায্যে আরএস/জিআইএস উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল নদ-নদী খাল-বিল জলাশয়ের ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয় এবং জীববৈচিত্র বিষয়ক তথ্যাদি সংগ্রহপূর্বক সকল ইউনিয়ন, উপজেলা এবং জেলার ম্যাপ প্রস্তুত করত: সংশ্লিষ্ট স্ব স্ব দপ্তর সকল নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত স্থানে বিলবোর্ড আকারে প্রদর্শন করবেন।
৯. জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে একটি কার্যকরী স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিনত করার নিমিত্তে ১নং প্রতিপক্ষকে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ অনতিবিলম্বে গ্রহণ করার নির্দেশ প্রদান করা হলো।
১০. বাংলাদেশের সকল সরকারি বেসরকারী স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শ্রেণিতে এবং বিভাগে প্রতি দুইমাস অন্তর একদিন এক ঘন্টার একটি নদীর প্রয়োজনীয়তা, উপকারিতা, রক্ষা, দূষণ, সংরক্ষণ বিষয়ে সচেতনতামূলক কাশ পরিচালনা এবং প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্ব স্ব এলাকার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত নদী নিয়মিতভাবে পরিদর্শনের ব্যবস্থা করবে।
১৩. সকল নদ-নদী দখলদার ও দূষণকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা প্রস্তুত করত: আগামী ৬ মাসের মধ্যে নোটিশ বোর্ডে উন্মুক্ত স্থানে টাঙ্গানোর জন্য সকল ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং জেলা প্রশাসককে নির্দেশ প্রদান করা হল।
১৪. যেহেতু পরিবেশ, জলবায়ু, জলাভূমি, তথা সমুদ্র, সমুদ্র সৈকত, নদ-নদী, নদ-নদীর পাড়, খাল-বিল, হাওর বাওর, নালা, ঝিল, ঝিরি এবং সকল উন্মুক্ত জলাভূমি পাহাড়-পর্বত, বন, বন্যপ্রাণী এবং বাতাস যেহেতু পাবলিক ট্রাষ্ট সম্পত্তি তথা জনগণের ন্যায্য সম্পত্তি তথা জাতীয় সম্পত্তি সেহেতু উক্ত ভূমি দখলের এবং দূষণের অভিযোগ কোন ব্যক্তি বা কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে থাকলে উক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সকল প্রকার ব্যাংক ঋণের অযোগ্য মর্মে সকল তফশীলি ব্যাংককে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করে সার্কুলার ইস্যুর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ প্রদান করা হলো।
১৫. পাবলিক ট্রাষ্ট সম্পত্তি তথা জাতীয় সম্পত্তি দখল-দুষণকারী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীর অযোগ্যতা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করে আগামী ৬ মাসের মধ্যে অত্র বিভাগকে হলফনামা সম্পাদনের মাধ্যমে অবহিত করনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ প্রদান করা হল।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮(ক) এ বলা আছে রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যত নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জলাভূমি, জীববৈচিত্র, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষন ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন। জাতীয় সম্পত্তি তথা পাবলিক ট্রাষ্ট সম্পত্তি হলো-জলবায়ু, পরিবেশ, জলাভূমি তথা সমুদ্র, সমুদ্র সৈকত, নদ-নদী, নদীর পাড়, খাল-বিল ও পাড়, হাওর বাওর, ঝিল, নালা, ঝিরি, সকল উন্মুক্ত জলাশয়, পাহাড়-পর্বত, বন, বন্য প্রাণী, বাতাস ইত্যাদিসহ এমন সকল সম্পদ যা প্রকৃতির দান, এসব সম্পদ সকলের এবং এসবের উপর সকল নাগরিকের সমান অধিকার। এ অধিকার সমুন্নত রাখতে সাংবিধানিক দায়িত্ব বর্তায় রাষ্ট্রীয় জাতীয় সম্পদ রক্ষাকারী সরকারের।
প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি, জনপ্রতিনিধিত্ব আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নিষ্পৃহতায় বুড়িগঙ্গা বিশ্বের শীর্ষ দূষিত নদীতে পরিণত হয়েছে। একই অবস্থা তুরাগ ও শীতলক্ষায়। নদী ও জলাধারে মিঠা পানি হলো দেশের প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ। অথচ জনপ্রশাসনের এব্যাপারে অজ্ঞতা ও অসচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডের সুপ্রিমকোর্ট বহুকাল আগেই তাদের নদী দখলকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নদী দখলকারী মন্ত্রীদের জরিমানার ব্যবস্থা করেছেন। বাংলাদেশেও নদী দখল ও দূষণকারীদের শাস্তি দেয়া অপরিহার্য হয়ে দাড়িয়েছে। বিলম্বে হলেও হাইকোর্টের কতিপয় নির্দেশনায় আমরা সংসদ ও সরকারের কাছে এব্যাপারে একটা জাগরণ আশা করতে পারি।
হাইকোর্টের দুটি নির্দেশনার আলোকে আমরা অবিলম্বে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারি। ঢাকার চারটি নদীর মধ্যে এ পর্যন্ত কেবল বুড়িগঙ্গার সীমানা চিহ্নিতকরন, খুটিঁ স্থাপন এবং হাটার পথ তৈরি সম্পন্ন হয়েছে। বাকী তিনটি নদীরই এসব কাজ বহুলাংশে বাকী। নদী খননের অগ্রগতিও হতাশাব্যঞ্জক। আপাতত: সবার আগে সীমানা নির্ধারনী খুটিঁ স্থাপনের কাজ শেষ হোক। কারণ দখলকারীদের রুখতে এটাই মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। চট্টগ্রামে কর্নফুলীর প্রসস্থতা দিন দিন কমে আসছে তাই সেথায় এ কাজটি অনতিবিলম্বে আরম্ভ করা উচিত। কুমিল্লার পুরাতন গোমতি দখলে দূষণে ভরপুর এবং সেখানেও খুটি বসিয়ে সীমানা নির্ধারন করত: দুপারে হাঁটার রাস্তা তৈরি করে দেয়া অত্যন্ত জরুরী এবং পরিবেশ রক্ষায় পুরাতন গোমতি পরিচ্ছন্ন করে জনস্বাস্থ্য রক্ষা নিতান্ত প্রয়োজনীয়। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা হাতির ঝিলের অনুরুপ প্রকল্পও পুরাতন গোমতীতে নেয়া যায় বলে বিশ্বাস করে। মাটি কাটা বন্ধ করে নতুন গোমতীর অস্তিত্ব রক্ষায় জনগণ সোচ্চার। পুরাতন গোমতির ঝুপ-ঝাড়, কচুরীপানা ও আবর্জনা পরিষ্কার করে দেশের বৃহত্তম শাপলা ফুলের বাগান করারও অভিমত প্রকাশ করেছেন কুমিল্লার নাগরিক সমাজ।
সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে নদ-নদী খাল-বিল অবৈধভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে যার ফলে পানি প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। নদ-নদী সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, এতে বর্ষাকালে পানির প্রবাহ ব্যহত হচ্ছে এবং অনেক স্থানে বৃষ্টির পানি জমে ফসল ও বাড়িঘর তলিয়ে যায়। কিছু কিছু এলাকায় স্থানীয় প্রভাবশালী দখলদার ভূয়া দলিল ও কাগজপত্র তৈরি করে মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে যেভাবেই দলিল করা হোক না কেন, কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নিলে নদী রক্ষা আইন অনুযায়ী তীরের দখলকৃত জায়গা যে কোন সময় উদ্ধার করা সম্ভব। সারা দেশের নদীগুলোর ভয়াবহ দোষণের বিষয়টিও বহুল আলোচিত। পরিশোধন যন্ত্র থাকলেও কোন কোন কারখানায় বর্জ্য পরিশোধন না করে সরাসরি তা ফেলে দেয়। এতে বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ আমাদের খাদ্যচক্রে প্রবেশের সুযোগ পায়। তাই নদী দূষণরোধেও নিতে হবে কার্যকরী পদক্ষেপ। নদ-নদীসহ প্রাকৃতিক সব জলাধার সুরক্ষায় জনসচেতনতা গড়ার দিকে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নদ-নদী দখল দূষণের বিরুদ্ধে সক্রিয় করার কথা ভাবা যেতে পারে।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল