চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে
Published : Saturday, 20 March, 2021 at 12:00 AM
হীরেন পন্ডিত ।।
বিশ্বে
এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। প্রথম শিল্প বিপ্লব
শুরু হয় রেল রাস্তা, বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার ও উৎপাদনে যন্ত্রের ব্যবহার
এই বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য ছিল। দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব শুরু হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন
দিয়ে। তৃতীয় শিল্প বিপ্লব, যাকে কম্পিউটার বা ডিজিটাল বিপ্লবও বলা যায়।
ুদ্র ও শক্তিশালী সেন্সর, মোবাইল ইন্টারনেট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও
মেশিন লার্নিং চতুর্থ বিপ্লবের মূল শক্তি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের গুণগত
পার্থক্য আছে, এই বিপ্লবে মেশিনকে বুদ্ধিমান করা হয়েছে। অন্য বিপ্লবে
যন্ত্রকে ব্যবহার করেছে মানুষ, আর এ বিপ্লবে যন্ত্র নিজেই নিজেকে চালানোর
সমতা অর্জন করছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে
যন্ত্রকে বুদ্ধিমান করা হচ্ছে। মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে যন্ত্রের ধারণমতা
অনেক বেশি এবং প্রক্রিয়াকরণ মতা অনেক দ্রুত। ইন্টারনেটের কারণে এর
কার্যক্রমের আওতা অনেক বিস্তৃতি লাভ করেছে। বাংলাদেশে বসে একটি বুদ্ধিমান
কম্পিউটার যেকোনো দেশের একটা যন্ত্রকে আদেশ দিতে পারে, একটা ঘরের তাপমাত্রা
মেপে আদেশ দিতে পারে তাপমাত্রা বাড়ানো বা কমানোর।
তবে যেসব সেবায়
মানবিক ছোঁয়া আছে সেসব সেবা দিতে মানুষের প্রয়োজন ফুরাবে না। অন্যদিকে
মেধাভিত্তিক পেশার প্রয়োজন বাড়বে, যেমন—প্রগ্রামার, আর্টিফিশিয়াল
ইন্টেলিজেন্স, আইওটি ইত্যাদিতে দ লোকের চাহিদা বাড়ছে। আমাদের দেশে দ
প্রগ্রামের অনেক অভাব।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটছে
খুব দ্রুতগতিতে। নতুন প্রযুক্তি বয়ে আনছে আরো নতুন প্রযুক্তি। বিভিন্ন
প্রযুক্তিকে সংযুক্ত করে পরিবর্তন আনছে অর্থনীতি, সমাজ, ব্যবসা ও
ব্যক্তিজীবনে। যন্ত্রগুলো পরস্পর কথা বলবে, জানবে পরিস্থিতি কী, সে অনুযায়ী
ব্যবস্থা নেবে। মানুষ সরলরেখায় চিন্তা করতে অভ্যস্ত।
আজকাল শরীরে
পরিধেয় বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়েছে, যা শরীরের
স্বাস্থ্যসংক্রান্ত উপাত্ত সংগ্রহ করে; যেমন—তাপমাত্রা, রক্তচাপ, পালস,
রক্তে শর্করা ইত্যাদি। এই উপাত্তগুলো কম্পিউটার ডাটাবেইসে সংরণ করা হয়,
যাতে ভবিষ্যতে ওই ব্যক্তির চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায়।
গুগল গ্লাস সীমিত
আকারে কম্পিউটারের মনিটরের কাজ করছে। উন্নত বিশ্বে ডাক্তারদের রোগীর সঙ্গে
কথোপকথন লিপিবদ্ধ করার আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে। ডাক্তাররা নিজে সেই কথোপকথন
কম্পিউটারে লিখতেন। অগমেডিক্স নামীয় সিলিকন ভ্যালির একটি প্রতিষ্ঠান গুগল
গ্লাসের মাধ্যমে ডাক্তারের সঙ্গে রোগীর কথোপকথন বাংলাদেশ, ভারত,
শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে ইন্টারনেটে পাঠিয়ে দেয়; যা এখানে বসে ইংরেজি জানা
কোনো যুবক বা যুবতি লিপিবদ্ধ করছেন। এই চশমা ধীরে ধীরে মনিটরের স্থান দখল
করে নিচ্ছে।
থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম,
সিরামিক, স্টিল ইত্যাদি তৈরি করা যাচ্ছে। একটা কারখানার কাজ এখন একটা
প্রিন্টিং মেশিনে তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের
পোশাকশিল্প থ্রিডি প্রিন্টারে অনেক জিনিস নিজেরা তৈরি করতে পারবে, এতে
পরিবহন ব্যয় কমে যাবে, যা পরিবেশদূষণ কমাবে।
পোশাকে আজকাল যন্ত্রপাতিতে
চিপস ব্যবহার করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হয়, ফলে শরীরের
স্বাস্থ্যবিষয়ক বার্তা পাওয়া যায়। মানুষও পোশাকে ঘষা দিয়ে ইন্টারনেটের
মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য পাঠাতে বা পেতে পারে। কম্পিউটারের প্রক্রিয়াকরণ মতা
বাড়ছে আর দাম কমছে। বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিতে সেন্সর বা চিপস ব্যবহার
করা হচ্ছে এবং এগুলো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারছে। ইন্টারনেটের
মাধ্যমে মানুষের কাছে বার্তা পাঠানো যায় এটা ইন্টারনেট অব থিংস বা আইওটি।
কম্পিউটারকে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দেওয়া হচ্ছে। পূর্ববর্তী পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে
ডাটা বিশ্লেষণ করে এআই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। কম্পিউটারকে প্রথমে প্রশিণ
দেওয়া হয়, যেমন—একটি বস্তু দেখতে কেমন। সে বস্তুর অনেক ছবি দেখানো।
কম্পিউটার একটা প্যাটার্ন আন্দাজ করে নেয়। ফলে পরবর্তী সময়ে রং, সাইজ,
ভঙ্গিভেদে কম্পিউটার সেই বস্তুটি চিনতে পারে।
বর্তমানে কোনো লেনদেন হলে
তা লেজার বা খতিয়ানে লিপিবদ্ধ থাকে। এই লেজার কেন্দ্রীয়ভাবে সংরণ করা হয়।
ব্লকচেইনে লেজারটি ছড়িয়ে দেওয়া হয় সব অংশগ্রহণকারীর মধ্যে। ফলে কেউ
জালিয়াতি করতে পারবে না। কারণ সবার কাছে লেজার আছে। একেকটা লেনদেন একটা
ব্লক তৈরি করে। সেটা আগের ব্লকের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে একটা চেইন তৈরি করে।
ব্লকচেইনে শুধু আর্থিক লেনদেন নয়; চুক্তি, জমির দলিলসহ বিনিময়ের রেকর্ড
থাকতে পারবে। ব্লকচেইন প্রবর্তিত হওয়ার ফলে মধ্যস্বত্বভোগীদের অনেক কাজ কমে
যাবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ছে।
আমাদের এ জন্য কম্পিউটার প্রগ্রামার,
ডাটা অ্যানালিস্টসহ কারিগরি জ্ঞান ও দতাসম্পন্ন লোকের চাহিদা বাড়ছে। আশার
কথা হলো, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগ ও সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এবং এর
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি
বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি
বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহেমদ পলক চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অত্যাধুনিক
প্রযুক্তি ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), ব্লকচেইন ও রোবটিকস স্ট্র্যাটেজি
দ্রুত প্রণয়নের উদ্যোগ নেন এবং খসড়া প্রণয়নের পর মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত
হয়েছে। যে ১০টি প্রযুক্তি আমাদের চারপাশের প্রায় সব কিছুতেই দ্রুত পরিবর্তন
আনবে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে তুলে ধরার পর প্রধানমন্ত্রী
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের গুরুত্ব অনুধাবন করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেন। ২০১৯
সালে এটুআই প্রগ্রাম ও ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) চতুর্থ
শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করার ল্েয পরিচালিত যৌথ
সমীায় ছয়টি ত্রে চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হচ্ছে—সনাতনি শিাপদ্ধতির রূপান্তর,
অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্ভাবনী, গবেষণা ও উন্নয়ন বিকশিত করা, সরকারি নীতিমালা
সহজ করা, প্রবাসী বাংলাদেশিদের দতা কাজে লাগানো এবং উদ্ভাবনী জাতি হিসেবে
বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করা। এই সমীার আলোকে স্কুল পর্যায়ে উদ্ভাবনে
সহযোগিতা, প্রগ্রামের শেখানোসহ নানা উদ্যোগের বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রায়
এক বছর আগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের এলআইসিটি প্রকল্প ১০টি
অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ওপর দ মানুষ তৈরির প্রশিণ শুরু করে। এসব উদ্যোগ
আমাদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ঝুঁকিকে সম্ভাবনায় পরিণত করার জন্য আশাবাদী
করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ জনশক্তির জন্য কারিগরি শিায় সর্বোচ্চ
গুরুত্বারোপ করেছেন। আসন্ন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে দ জনশক্তির
প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে কারিগরি শিার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা
উল্লেখ করছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের দ জনশক্তি প্রয়োজন। আর সে
কারণেই কারিগরি শিাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে শুধু
বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বের জন্যই দ জনশক্তির প্রয়োজন হবে। যাঁরা বিদেশে
যাবেন, তাঁদের কারিগরি বিষয়গুলোয় দ হয়ে যেতে হবে। আর সে জন্যই কারিগরি
শিাকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের শিাব্যবস্থায় পরিবর্তন করা হয়েছে। যেসব বেসরকারি
প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তিগত প্রশিণ দিচ্ছে, সরকার তাদের সহায়তা করছে উল্লেখ
করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘একটি দেশ গঠনের জন্য দ জনশক্তি সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ—এটা আমরা সব সময় মনে করি এবং দ জনশক্তি তৈরিতে আমরা কাজ করে
যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার জনশক্তিকে এমনভাবে গড়ে তুলতে চায়, যাতে
তারা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের যেকোনো জায়গায় প্রতিযোগিতা করতে পারে।
লেখক : প্রাবন্ধিক