বিশেষ
প্রতিনিধি ॥ ১৯৭১ সালে মার্চের ১৫ তারিখ থেকে শুরু হওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আলোচনা ভেস্তে
যাওয়ার পথে। বন্ধ হয়ে যায় সমঝোতার সমস্ত পথ। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে
স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা ছাড়া বাঙালির সামনে কোন পথ খোলা ছিল না। নরঘাতক
জেনারেল টিক্কা খানরা গোপন বৈঠক করে নির্বিচারে বাঙালী নিধনে অপারেশন সার্চ
লাইটের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে।
বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ছয়
শীর্ষস্থানীয় সহকর্মী উপস্থিত ছিলেন। সকাল ১০টায় বৈঠক শুরু হয়ে তা প্রায়
সোয়া দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়। বৈঠক থেকে বেরিয়ে সোজা ধানম-ির বাসভবনে যান
বঙ্গবন্ধু। সেখানে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকরা তাঁকে ঘিরে ধরেন। চতুর্থ দফা
বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু বলেন, আলোচনা আরও হবে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য
আনা হচ্ছে- এই মর্মে জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন-
‘বাংলাদেশের সব খবর আমার জানা আছে।’
বাঙালী বুঝতে পারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে
ইয়াহিয়া খানের আলোচনায় বসাটা ছিল সম্পূর্ণ লোক দেখানো, প্রহসন মাত্র।
আলোচনার আড়ালে পাকিস্তানে স্বৈরশাসকরা বাঙালিদের স্বাধীনতার সমস্ত
আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়ার কৌশলে ব্যস্ত ছিল। এরই মধ্যে পাকস্তানী সামরিক
জান্তারা নির্বাচনে বাঙালী নিধনে অপারেশন সার্চ লাইটের সমস্ত পরিকল্পনা করে
ফেলে। এদিন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবদুল হামিদ ও জেনারেল টিক্কা খানের এক
বৈঠক থেকেই অপরাশেন সার্চ লাইনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়।
একাত্তরের এ
দিন ধানম-ির বাসভবনে সমাগত জনতার উদ্দেশ্যে একাধিক সংপ্তি ভাষণে বঙ্গবন্ধু
দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন, মুক্তিপাগল সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর চূড়ান্ত
বিজয়কে পৃথিবীর কোন শক্তিই রুখতে পারবে না। বাংলাদেশকে কলোনি করে বাজার
হিসেবে ব্যবহার করার দিন শেষ হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের মানুষের
সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সত্যাগ্রহ চলবে।
একাত্তরের ২০
মার্চ ছিল ঘটনাবহুল উত্তেজনাপূর্ণ একটি দিন। আন্দোলনে শান্তিশৃঙ্খলা বজায়
রাখার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু সংবাদপত্রে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘একটি
স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য জনগণ যে কোন ত্যাগ
স্বীকার করতে প্রস্তুত। তাই মুক্তির ল্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম
চালিয়ে যেতে হবে। শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে এ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে আমি
বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই। এবারের সংগ্রাম প্রতিটি শহর,
নগর, বন্দর ও গ্রামে। আবালবৃদ্ধবনিতা বাংলাদেশের দাবির পিছনে ঐক্যবদ্ধ
হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ, সারা বিশ্বের স্বাধীন জাতি কীভাবে স্বীয় ল্যপানে
এগিয়ে যেতে পারে, বিশ্বের সামনে বাংলার মানুষ আজ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
স্থাপন করেছে।’
অসহযোগ আন্দোলনের ঊনবিংশ দিবসে একাত্তরের অগ্নিঝরা এদিনই
বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতি দিয়ে ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব উপলে সাধারণ ছুটি ঘোষণা
করেন। এদিন বিহারী ও পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাঙালীর সংঘর্ষ হয়েছে মিরপুর,
চট্টগ্রাম, পার্বতীপুর ও সৈয়দপুরে। আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক।
সারাদেশে এক
উত্তপ্ত পরিবেশ বিরাজ করতে থাকে। ুব্ধ বাঙালিরা পথে নেমে আসে। যুদ্ধের
প্রস্তুতি চলতে থাকে দেশজুড়ে। কিন্তু তখনও পূর্ব পাকিস্তানবাসী বুঝতে
পারেনি যে অতর্কিতেই তাদের ওপর চালানো হবে অপারেশন সার্চলাইট। জেনারেল
ইয়াহিয়া খান এদিন তার সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল হামিদ খান, টিক্কা খান,
জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল ওমর প্রমুখকে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক
প্রস্তুতির পূর্ণ রূপ দেন। ওদিকে প্রতিদিনই ৬ থেকে ১৭টি পর্যন্ত ফাইটে
পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও যুদ্ধের রসদ নিয়ে আনা হচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তানে।
স্থল ও বিমান শক্তি দ্বিগুণ করে।
একাত্তরের এদিন ছাত্র ইউনিয়ন এক ভিন্ন
রকমের কর্মসূচী পালন করে। তাদের উদ্যোগে গঠিত গণবাহিনী ১০ দিনের প্রশিণ শেষ
করে রাজপথে এক শোভাযাত্রা বের করে। এতে প্রতিটি সদস্য সেদিন ড্যামি রাইফেল
নিয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি ছিলেন
নুরুল ইসলাম নাহিদ (সাবেক শিামন্ত্রী)। তাঁর নেতৃত্বে এ শোভাযাত্রা বের হয়।
সে সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও (বর্তমানে
সিপিবি সভাপতি) সার্বণিক বিভিন্ন কর্মসূচী পালনে ও ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেদের
সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
বছর ঘুরে এবার সত্যিই এক মাহেন্দ্রণে
বাঙালীর জীবনে এসেছে অগ্নিঝরা মার্চ। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্বাপ্নিক
স্থপতি ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলে পালিত হচ্ছে মুজিববর্ষ। আগামী ২৬ মার্চ
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর নানা
কর্মসূচী পালিত হবে বছরজুড়েই। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে
রেখে এবারের অগ্নিঝরা মার্চ মাস বিশেষ তাৎপর্য বয়ে এনেছে পুরো জাতির
জীবনে।