মো. হাবিবুর রহমান, মুরাদনগর ||
একুশে পদকপ্রাপ্ত ও সাবেক গণ পরিষদ সদস্য হাজী আবুল হাসেম ইন্তেকাল করেছেন। শুক্রবার দুপুরে তিনি ঢাকার নিজ বাসায় শেষ নি:শ^াস ত্যাগ করেন (ইন্না.........রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৯ বছর। মৃত্যুকালে তিনি ২ ছেলে ও ১০ মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে পরিবারসহ উপজেলা জুড়ে বইছে শোকের বাতাস। ব্যক্তি জীবনে শিক্ষার উন্নয়নে তিনি ছিলেন নিরলস নি:স্বার্থ। তাঁর গড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন ১৪টি। এরমধ্যে ১০টি স্কুল, ২টি কলেজ ও ২টি মাদরাসা। এগুলো ছড়িয়ে আছে- কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯০ সাল থেকে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য আর চাকরি করে আয়-রোজগার করেন। সেই টাকা দিয়েই তিনি এখন পর্যন্ত সেবা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আবুল হাসেম ১৯২২ সালের ১১ এপ্রিল কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার চাপিতলা গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। ১৯৪৩ সালে ঢাকার নবকুমার হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক (তখনকার ম্যাট্রিকুলেশন) পরীক্ষায় পাস করেই কর্ম জীবনে ঢোকোন। ১৯৪৬ থেকে ৪৮ সাল পর্যন্ত ৩০ টাকা বেতনে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার বিক্রয় ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন, তখন বেতন ছিল ১৫০ টাকা। পুঁজি জমিয়ে একদিন ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেন। সীমিত সামর্থ্য নিয়ে ওই সময় থেকেই আবুল হাসেম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন শুরু করেন।
শুরুটা হয়েছিল ১৯৫৬ সালে, বাবার নামে কোম্পানীগঞ্জ বদিউল আলম উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। তারপর ১৯৬৪ সালে বাখরনগর হাসেমিয়া ইসলামিয়া সিনিয়র মাদরাসা, ১৯৭০ সালে বদিউল আলম ডিগ্রি কলেজ, চাপিতলা অজিফা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয় ও মুরাদনগর নূরুন্নাহার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯৭১ সালে হোমনা উপজেলার কাশীপুর হাসেমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯৭২ সালে রামকৃষ্ণপুরে কামাল স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯৭২ সালে ফেনীর পশুরামে দক্ষিণ রাজেশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং দক্ষিন রাজেশপুর করিম মিয়া মাদরাসা ও মসজিদ, ১৯৮৬ সালে হোমনা উপজেলার রামকৃষ্ণপুর কলেজ ও মুরাদনগর উপজেলার স্বল্পা প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৯৯৩ সালে কচুয়ারপাড় প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২০০৩ সালে অজিফা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয় এবং ২০০৪ সালে রাজেশপুর মসজিদ স্থাপন করেন আবুল হাসেম। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোম্পনীগঞ্জ বদিউল আলম কলেজটি জেলার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও গড়েছেন হাজী আবুল হাসেম। ২০০৪ সালে তিনি ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার দক্ষিন রাজেশপুর গ্রামে জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়াও হোমনা উপজেলার রামকৃষ্ণপুর আকন্দপাড়া গ্রামে মাদরাসা, চরলহনীয়া গ্রামে মাদরাসা ও দৌলতপুর গ্রামের মাদরাসায় তাঁর রয়েছে আর্থিক অনুদান। বদিউল আলম ও অজিফা খাতুনের চার ছেলে-দুই মেয়ের মধ্যে চতুর্থ আবুল হাশেম মানবসেবার ক্ষেত্রে তাঁর প্রয়াত স্ত্রী ‘নূরুন্নাহার স্মৃতি পাঠাগার’ স্থাপন করেছেন তিনি। আবুল হাসেমের ১০ মেয়ে ও ২ ছেলের মধ্যে পাঁচজন বিদেশে থাকেন।
কোম্পানীগঞ্জ বদিউল আলম ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ নূরুল হক দৈনিক কুমিল্লার কাগজকে বলেন, হাজী আবুল হাসেমের মতো কাজপাগল মানুষ এ যুগে দুর্লভ। রহিমপুর অযাচক আশ্রমের অধ্যক্ষ ডা: মানবেন্দ্রনাথ সরকার শিক্ষাবিস্তারে আবুল হাশেমের অবদানকে অনস্বীকার্য বলে মন্তব্য করেছেন।
হাজী আবুল হাসেমের পরিবার সূত্রে জানা যায়, জনসেবার ইচ্ছা থেকেই একসময় তিনি রাজনীতিতে ঢোকেন। ইচ্ছে ছিল নির্দলীয় প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার। কিন্তুু এলাকার কয়েকজন নেতা তাঁকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এরপর আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে ১৯৭০ সালে নির্বাচনে জয়ী হন তিনি। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি মুরাদনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। শিক্ষা ও সমাজ সেবার অসমান্য অবদানের জন্য তিনি ২০১১ সালে একুশে পদকে ভুষিত হন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সেবামূলক কাজ করেছেন আবুল হাসেম। তিনি প্রথমে বাঞ্ছারামপুরের বিভিন্ন গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ভাবে সহযোগিতা করেন। সেখান থেকে ১৮ মে চলে যান ভারতের আগরতলার কর্নেল চৌমুহনীতে। সেখানকার হাফাইন্যা ক্যাম্প ছিল ক্যাপ্টেন হায়দারের অধীনে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার-দাবার জোগাড় করে এনে দিতেন আবুল হাসেম।’
ব্যবসা ও ব্যবসায়িক নেতৃত্ব দু’টোতেই সমান দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন হাজী আবুল হাশেম। ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তান টেক্সটাইল মিলস ওনার্স-এর চেয়ারম্যান, ১৯৭৩ সালে লায়ন্স কাব অব ঢাকা নর্দানের পরিচালক ও ১৯৮৪-১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস্ আ্যসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) চেয়ারম্যান ছিলেন। সমাজসেবায় বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য তিনি স্বামী স্বরূপানন্দ ফাউন্ডেশন পদক, মুরাদনগরের বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী হিসেবে একাধিকবার সংবর্ধনা পান।