ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
চেনা অনুভূতি ও বিপন্ন মানুষেরা
Published : Sunday, 11 April, 2021 at 12:00 AM
চেনা অনুভূতি ও বিপন্ন মানুষেরাহালিম আবদুল্লাহ ||
এ এক বিপন্ন সময়ের বয়ান। চারদিকে ভয়। কখন কার কী হবে কেউ জানে না। এ সময় ‘ মানুষের জীবন কচুপাতার পানি, এই আছে এই নাই।’ তাই মানুষ গুটিয়ে যাচ্ছে, নিজের মরমে মরে নিজে মর্মাহত হচ্ছে। সমাজের নীচতা ও মানুষের অসহায়ত্ব দেখে মানুষের বুকে হাহাকার জন্ম নিচ্ছে। রাষ্ট্র নির্মম হচ্ছে। বিবেক ও মনুষ্যত্বের বিপক্ষে অনৈতিক ও অমানবিক শাসননীতি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মানুষ পণ্য আর সংখ্যা ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু ব্যক্তিমানুষ কখনো নিজেকে পণ্য বা সংখ্যা ভেবে সুখি হতে পারে না। তাই মানুষ অসুখি হচ্ছে। অসুখি মানুষের মনে ক্ষোভ জমছে। ক্ষোভ প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণায় বিবেকওয়ালা মানুষ ভিতরে ভিতরে জ¦লে পুড়ে খাক হচ্ছে। সচেতন মানুষ হিসেবে একজন লেখক সবচেয়ে বেশি বিদ্ধ হচ্ছেন। সময়কে পাশ কাটিয়ে, সময়কে অস্বীকার করে লেখকের পক্ষে কি শিল্প নির্মাণ সম্ভব? না, সম্ভব নয়। যেমন গল্পকার আনোয়ারুল হকের পক্ষেও সম্ভব হয়নি। তাঁর সদ্য প্রকাশিত ‘ক্রসফায়ার’ গল্প সংকলনটি সময়েরই প্রতিচ্ছবি।
এর আগে প্রকাশিত ‘ফুলকন্যা’ ও ‘প্রেমজ’র গল্পগুলোর চেয়ে আনোয়ারুল হকের ‘ক্রসফায়ার’র গল্গগুলো একদম ভিন্ন ধাঁচের। এ গ্রন্থের গল্পগুলো নিছক গল্প নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। আমাদের যাপিত জীবনের সাদা-কালো, এপিঠ-ওপিঠের স্পষ্ট চিত্র লেখক দক্ষতার সঙ্গে চিত্রণ করেছেন।
‘ক্রসফায়ার’ নামটিই কেমন অস্বস্তিকর, ভয় উৎপাদক।  বন্দুকযুদ্ধ, এ্যানকাউন্টার যে নামেই বলা হোক না কেন, এ হচ্ছে বিচার বহির্ভুত হত্যাকা-। রাষ্ট্র তার সুবিধার জন্য এ হত্যাকা-টি চালায়। কিন্তু রাষ্ট্রের বয়ানে কিছুতেই এটিকে হত্যাকা- বলে স্বীকার করা হয় না। একটা গল্প বানানো হয় এবং গল্পটি সকলকে বিশ^াস করতে বলা হয়। কিন্তু গল্পটি কেউ বিশ^াস করে না। অবিশ^াস ও আতঙ্ক নিয়ে রাষ্ট্র থেকে দূরে থাকতে চায়।
কিন্তু দূরে তো থাকা যায় না। রাষ্ট্র এসে মানুষের দোর গোড়ায় দাঁড়ায়। পথ আটকে সওয়াল-জওয়াব করে। রাষ্ট্র থেকে পালানোর কেনো উপায় মানুষের নেই। অবিশ^াস ও আতঙ্ক নিয়েই রাষ্ট্রের অধীনে জীবন যাপন করতে হয়।
আনোয়ারুল হক এমনই এক অবিশ^াস ও আতঙ্কের গল্প লিখেছেন। ‘ক্রসফায়ার’ গ্রন্থের ১২টি গল্পের মধ্যে এ গল্পটিই সবচেয়ে দুর্দান্ত। গল্পটির নামও ‘ক্রসফায়ার।’
অফিস ফেরতা দুই যুবক (মনির ও বকুল)  তাদের এক টাকাওয়ালা বন্ধুর (বিনোদ) সঙ্গে মদ পান করেছিল। মধ্যবিত্ত জীবনে এটুকুই তাদের একমাত্র সুখ। মতিঝিলের সওদাগরি অফিস তাদের জীবনীশক্তি কেড়ে নিয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা টিকে থাকে এইসব মানুষের শ্রমে আর ঘামে। কিন্তু সুখ তাদের দিতে পারে না।  তাই পানের গ্লাসে তারা আনন্দ আনুসন্ধান করে। গভীর রাতে রিকসায় চড়ে দুজন বাড়ি ফিরছিল। পানের আনন্দে তারা মাতোয়ারা ছিল ঠিকই কিন্তু আতঙ্ক থেকে কিছুতেই তারা মুক্ত হতে পারছিল না। কারণ “সময় এখন ভলো না। সামনে ক্ষমতা বদলের নির্বাচন। রাস্তাঘাটে যে কোনো সময় যে কোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে। সাবধানে থাকা ভালো। সবাই জানে, আজও বুড়িগঙ্গায় লাশ পাওয়া গেছে একজনের। বেচারা পাবনা থেকে ঢাকা এসেছিলো নমিনেশন পেপার জমা দিতে। লাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। কোথা থেকে কখন যে কী হয়ে যায় তার কোনোই ঠিক নেই।”
পুলিশের রূপ ধরে আশঙ্কা তাদের পেছন থেকে ডাক দেয়। আধ-খাওয়া মদের বোতলসহ পুলিশ তাদের পাকড়াও করে। তাদের মনে আইনের ফাঁকটুকু উঁকি দেয়। তাদের মনে হয় “ এই দেশে মদের লাইসেন্স দেয়া হয় কিন্তু মদ খাওয়া নিষেধ।” কিন্তু এ সব তারা প্রকাশ্যে বলতে পারে না। এ সমাজ ব্যবস্থায় ক্ষমতাহীনের মুখ খোলার অধিকার নেই। তারাও মুখ খোলে না। কারণ যুক্তি দেখিয়ে লাভ নেই। ক্ষমতাবানের কাছে ক্ষমতাহীনের যুক্তি ধোপে টিকে না। তারা বিপন্ন বোধ করে। আর বোধ করে অপমান। জানা আতঙ্ক তাদের গ্রাস করে। পুলিশ তাদেরকে ডাকাতি মামলার আসামি বলে সাব্যস্ত করে। তারা চিৎকার করে নিজেদের নিরাপরাধ প্রমাণ করতে চায়। পুলিশ তাদের আরও আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দেয়। বলে “ চিল্লান ক্যান? বলছি না, স্যার আসতাছে। তারপর বাঁচা-মরা আপনাগো আল্লার হাতে।” তারা ‘স্যার’ এর অপেক্ষায় সারারাত গুজরান করে। তারা জানে, ‘স্যার’ আসবে মৃত্যু হয়ে, ক্রসফায়ার হয়ে। তাদের মনে হয় ‘স্যার’ আসার পর “ওরা ছাড়া পাবে, না কি বেওয়ারিশ লাশ হয়ে কাল সকালে পড়ে থাকবে হাতির ঝিলে!” কিন্তু ‘স্যার’ আর আসে না। এখানে এসে গল্পকার গল্পটির মোড় ঘুরিয়ে দেন। “একটা মরণভীতি আতঙ্কের অতল অন্ধকারে সাঁতরাতে সাঁতরাতে যখন তারা দুজনেই মাঝ দরিয়ায় তখন একজন কনস্টেবল মৃত্যুঘুম থেকে তাদের দুজনকে ডেকে তুললো। তারপর সদর দরজা খুলে দিয়ে যখন ওদের চলে যেতে বললো, সেই সময় দুজনের কারোরই বিশ^াস হচ্ছিলো না, ঠিক শুনছে তো!”
বিশ^াস না হওয়ারই কথা। ততক্ষণে তাদের মনে ক্রসফায়ার হয়ে গেছে। তাই ছাড়া পেয়েও তারা “এক পা-ও সামনে যেতে পারে না। পারলো না। কাঁপতে কাঁপতে দুজনেই বসে পড়লো মেঝেতে। এগিয়ে গেলেই বুঝি পেছন থেকে ছুটে আসবে গুলি। ঠা ঠা!”
এই মনোলোকিক আতঙ্কই গল্পটির প্রাণ। সবসময়ই পেছন থেকে গুলি ছুটে আসার আতঙ্কে সামনে আর পা ফেলা যায় না। এই ভয় যেমন দেশীয় তেমনি আন্তর্জাতিক। কোনো উচ্চকিত ভাষা বা তত্ত্বের বয়ান না দিয়েই আনোয়ারুল হক মানুষ ও রাষ্ট্রের একটি নিখুঁত সম্পর্ক নির্মাণ করেছেন। ইতিহাসের শুরু থেকেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের শত্রুতার সম্পর্ক। আনোয়ারুল হক তাঁর ‘ক্রসফায়ার’ গল্পে সেই অনিবার্য শত্রুতার একটি দিক উন্মোচন করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কখনো কখনো শারীরিকভাবে মুক্তি পেলেও মানসিকভাবে রাষ্ট্রের থাবা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। কারণ রাষ্ট্র ভয় দেখায় আর ভয়ই জনগণকে দাবিয়ে রাখার অন্যতম উপায়। রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার পটভূমিতে লেখা আনোয়ারুল হকের এ গল্পটি নিঃসন্দেহে কালোত্তীর্ণ হবে।
‘ক্রসফায়ার’ গ্রন্থে আনোয়ারুল হকের গল্পের চরিত্ররা কোনো একক মানুষ নয়। নাম-সুখ-দুঃখ, পারিবারিক ও সামাজিক যন্ত্রণা হয়তো একজনেরই, বন্দিত্বের শ^াসরুদ্ধকর অবস্থা ও মুক্তির আকাক্সক্ষা তাও একজনের, কিন্তু সেই একজনের মুখে ভেসে ওঠে একটি রাষ্ট্রের উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তের হাজার হাজার মুখ। ক্রসফায়ার থেকে আপাতত বেঁচে যাওয়া মনির ও বকুল, পোড়া মবিল মাখা মুখ নিয়ে ঘরে ফেরা অপমান জর্জরিত পৌঢ় শিক্ষাবিদ, বিকৃত যৌনাচারের শিকার মাছি আক্রান্ত যুবক, পোশাক কারখানায় দগ্ধ তরুণী, পিতার অসততায় ক্ষুব্ধ সৎ মধ্যবিত্ত, মায়ের অস্থি বিদেশে পাচার করা লোভী পুঁজিপতি, আত্মহননে মুক্তি খোঁজা দুঃখী তরুণী কেউ আমাদের অচেনা নয়। পচন ধরা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী অংশ দ্বারা নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের আত্মচিৎকারে ‘ক্রসফায়ার’র গল্পগুলো ভারাক্রান্ত। লেখকের নিখুঁত সরল বয়ান, সমাজ পর্যবেক্ষণের দক্ষতার গুণে একজন ব্যক্তি মানুষ সমস্ত মানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে। প্রতিটি গল্প তিনি দরদ দিয়ে লিখেছেন। মানুষের অক্ষমতা ও বিপন্নতাকে যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি একটি আলোর বার্তাও সুক্ষ্মভাবে প্রচার করেছেন। মানুষ ঘুরে দাঁড়াবে, ঘুরে না দাঁড়ালে ‘মানুষ সত্য’ আর থাকে কই!
আনোয়ারুল হকের গল্পে তীর্যকতা আছে, ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপ আছে। গল্পটির নাম খেয়াল করা যাক, ‘পোড়া মবিল দিবস।’ আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার জাতীয় দিবসগুলোর সমান্তরালে একটি বিভীষিকাময় দিবসের নাম। অন্যায্য দাবি আদায়ের নামে পরিবহন শ্রমিকেরা রাস্তা দখল করেছে, তাদের ভাষায় যাকে বলা হচ্ছে ধর্মঘট। অন্যদিকে অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা রাখা হয়েছে। আড়ালে থেকে ধর্মঘটের কলকাঠি যারা নাড়ছে তারা রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী, অফিস ও প্রতিষ্ঠানের মালিকেরাও সেইসব সুবিধাভোগীদেরই জাত ভাই। মাঝখানে সমস্যায় আক্রান্ত মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী, মাঝারি ও নি¤œ আয়ের মানুষেরা। অফিসে যেতেই হবে তাই ঘর থেকে বের হতেই হয়। বাইরে একদিকে আছে সুযোগ সন্ধানীরা যারা এ সময়ে পারাপারের নামে গলা কাটবে, অন্যদিকে ধর্মঘটওয়ালারা। এ গল্পের প্রধান চরিত্র একজন অধ্যাপক, নাম মনিরুল। তিনি দীর্ঘদিন সরকারি কলেজে চাকুরি করে অবসরে গিয়ে একটি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। এই আক্রান্ত দিবসে মনিরুলও বের হয়েছেন। পথে পথে আতঙ্ক ও বিরক্তি নিয়ে সহকর্মীসহ তাঁর অনিচ্ছার যাত্রা। কিন্তু এ অশুভ সময়ে যাত্রা তো শুভ হতে পারে না। তাঁরও হয়নি। অন্য সকলের মতো ধর্মঘটওয়ালারা তাঁর গায়েও পোড়া মবিল মেখে দেয়। এতদিনের তাঁর অভ্যস্ত শ্রদ্ধার জীবনটি নিমেষেই অপমানে কুঁকড়ে যায়। এ অপমান যেন চরাচর জুড়ে বাস করা সমস্ত মানুষের। বাড়ি ফিরে এসে ছোট বোনকে দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে তিনি হাহাকারে ভেঙে পড়েন। গল্প থেকেই তুলে ধরা যাক, “বলতে বলতে অপ্রকৃতস্থের মতো মনিরুল হাসি কান্নায় মাখামাখি হয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর হো হো করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। দাদার আকস্মিক এমন কান্নায় রিমূঢ় মিনি। ভাইয়ের মাথায় সান্ত¡নার হাত রেখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মিনির মনে হলো, সারা ঘরের এমন কোনো জায়গা এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে পোড়া মবিলের অপমানের গন্ধ নেই।” শুধু ঘর কেন এ অপমানের পোড়া মবিলে মাখামাখি হয়ে যায় যাপিত জীবনের সব অলিগলি। ‘মাছি’  গল্পটি পড়ে ধাক্কা খাওয়ার মতো অবস্থা। প্রচলিত জীবন ও বিশ^াসের বাইরের ঘটনা নিয়ে লেখক গল্পটি লিখেছেন। ফয়সল নামে এক মফস্বলের যুবক চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ঢাকায় এসে বিকৃত মানসিকতার কয়েকজন যুবতি দ্বারা যৌন আক্রমণের শিকার হয়। ওসব তরুণীরা তাকে রাতের অন্ধকারে একটি ডাস্টবিনের পাশে ফেলে যায়। তাকে মাছি আক্রমণ করে। রাতের মেয়েগুলোকেও তার ভাগাড়ের মাছি মনে হয়। গল্পটির সামাজিক সত্য হয়তো বিশ^াস ও অবিশ^াসের মাঝামাঝি কিন্তু গল্পটি ইঙ্গিতপূর্ণ। ভিন্নভাবে নারীবাদের চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস। হয়তো লেখক বলতে চেয়েছেন, বিকৃতি যখন সমাজে বিস্তার লাভ করে তখন নারী পুরুষ কেউই তার বাইরে থাকে না। ‘আগুন আগুন খেলা’, পুঁজির যূপকাষ্ঠে দগ্ধিভূত হাজার মানুষের আত্মচিৎকারের বয়ান। গার্মেন্টসে আগুন লাগানো হয় কারণ আগুন লাগালে লাভ আছে। মানুষ মরুক তাতে পুঁজির কিছু এসে যায় না। আগুনে শ্রমিক পোড়ে, মালিক ম্যানেজার ও এক্সিকিউটিভরা পোড়ে না। কিন্তু মালিক ম্যানেজার তো আর শেষ কথা নয়। আরও কিছু আছে। যে ম্যানেজার আগুন লাগিয়েছিল গ্যাসের আগুনে পুড়ে সেই ম্যানেজারও মারা যায়। গল্পটি পড়ে গা ছমছম করে। বিমূঢ় হয়ে যেতে হয়। আগেই বলেছি পুঁজির কাছে লাভই একমাত্র সত্য। গ্রাম থেকে শহরে আসা দরিদ্র গোর খোদক গোফরানের কাছে যে নীচতা অবিশ^াস্য, পুঁজিপতি কামালউদ্দিন চৌধুরীর কাছে তা স্বাভাবিক। প্রকাশ্য ব্যবসার আড়ালে মানুষের অস্থি বিদেশে পাচার করা তার লাভজনক ব্যবসায়। কিন্তু এ গল্পে আনোয়ারুল হক পাঠককে চমকে দিতে চেয়েছেন। পুঁজিকে প্রশ্নের মুখোমুখী দাঁড় করেছেন। অন্য অস্থির সাথে এ পুঁজিপতি নিজের মৃত মায়ের অস্থিও বিদেশে পাচার করে দেন। স্বপ্নের ভিতর তিনি এক মাড়ি-দন্তহীন মুখগহ্বর থেকে শুনতে পান, “বাজান বাজান আমারে কই নিয়া যাও?” সময়ের অভাবে মাকে হজে নিয়ে যেতে পারেননি কিন্তু বিদেহী মাকে ঠিকই বিদেশ পাঠিয়ে দিলেন। গল্পটির নাম ‘বিদেহীর বিদেশ যাত্রা।’
হতাশা-আক্ষেপ আনোয়ারুল হকের গল্পে বিস্তর আছে। বাবার অবহেলা, মায়ের স্বার্থপরতা ও অসুস্থ যৌনজীবনে হতাশ হওয়া জীবনবিমুখ এক তরুণীর গল্প ‘বিপন্ন সময়।’ মেয়েটির নাম শিবা, কলেজে পড়ে। মেয়েটি উগ্র কিন্তু হৃদয়বান। জীবনই তাকে উগ্র করেছে কিন্তু হদয় কেড়ে নিতে পারেনি। হৃদয়বান বলেই মেয়েটি বাবার অবহেলা ও মায়ের অসঙ্গতিপূর্ণ জীবনাচারে ব্যথিত হয়। জীবন থেকে পালানোর জন্য মেয়েটি এক সময় আত্মহত্যা করে। তার মনে হয় “মৃত্যু সহজ। জীবন অনেক কঠিন। আমি সহজটাকেই বেছে নিলাম।” কিন্তু আত্মহননের আগে যে ঘটনাটি সে ঘটিয়ে যায় তার জন্য মেয়েটির মা ও গল্পের পাঠক কেউ প্রস্তুত ছিল না। শিক্ষকের কাছে লেখা চিঠিতে সে লেখে, “আমি যা করেছি, তা যদি প্রকাশ্যে স্বীকার করি তাহলে আমি নিশ্চিত, মোল্লারা আমাকে পাথর ছুঁড়ে মারার বিধান দেবে। সেদিন আমার মা ঘরে ছিল না। তার অবর্তমানে মায়ের প্রেমিককে আমার দিকে প্রলুব্ধ করেছি। সে খুব সহজেই ধরা দিয়েছে। ওর সঙ্গে প্রতি রাতে মা যা করে, আমিও তাই করেছি। আর অনন্ত যাত্রার আগে কথাটা মাকে লিখে জানিয়ে গেছি।” এ চিঠি পাঠ করে চমকে যেতে হয়। প্রতিশোধের কী নির্মম পন্থা! আনোয়ারুল হক পাঠককে সেই নির্মমতার সঙ্গে  পরিচয় করে দেন।
মানুষের সমাজ ভাঙছে, পরিবার বিপন্ন হচ্ছে, মানুষও বিপন্ন। প্রচলিত বিশ^াস ও মূল্যবোধ প্রশ্নের মুখোমুখী হচ্ছে। বাড়ছে উগ্রতা ও প্রতিশোধস্পৃহা। হঠকারিতাও বাড়ছে। ‘চাপ’ গল্পের নিতাই নাপিত ‘এলাকার মূর্তিমান শয়তানের’ গলায় যেভাবে খুর চালালো, তা হয়তো আপাত অর্থে স্বাভাবিক নয়, কিন্তু ক্ষোভ প্রকাশের এর চেয়ে উগ্র মাধ্যম আর কি হতে পারে! খুরই তো নাপিতের অস্ত্র। গলায় চালাতে হলে তাকে খুরই চালাতে হয়। যার যা আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার নামই তো যুদ্ধ।
হতাশা-বিক্ষোভের বিপরীতে আলো ও সম্ভাবনার কথাও আনোয়ারুল হক তাঁর গল্পে দেখিয়েছেন। গল্পটির নাম ‘তাসের ঘর।’ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের বাইরে ছিলেন, কিন্তু নিজের চাকুরির বয়স বাড়ানো ও উত্তরাধিকারীদের সুবিধা দেয়ার জন্য প্রভাব খাটিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সনদ জোগাড় করেছেন। বাবার এ অনৈতিক অবস্থানের কারণে ছেলে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ হয়। বাবাকে পরিত্যাগ করে। এই যে ব্যক্তির ছোট বিদ্রোহটুকু তার মধ্য দিয়ে লেখক আমাদের কাছে শুভ ও সুন্দরের বার্তা পৌঁছে দেন। ‘মানব সত্য’কে টিকিয়ে রাখার জন্য এ আলোর রেখা হয় তো খুবই ক্ষুদ্র কিন্তু ক্ষুদ্র হলেও আলোই সত্য। সমস্ত অন্ধকারকে ছাপিয়ে এক টুকরো আলোই মানুষকে পথ দেখাতে পারে। ‘গভীর গভীরতর অসুখ’, ‘পিংপং’, ‘সারমেয় সমাচার’, ‘লাল মাটি কালো মানুষ’ গল্পগুলোতেও আনোয়ারুল হক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। মানুষের ভিতর থেকে মানুষকে বের করে এনে তিনি আলোতে দেখতে চেয়েছেন।  আনোয়ারুল হক সরলভাবেই তাঁর গল্প বলেছেন। গল্পই তাঁর লক্ষ্য। ভাষার দুর্বোধ্যতা তৈরি করে, প্রকরণের জটিলতা নির্মাণ করে গল্পকে হারিয়ে যেতে দেননি। গল্প বলা ছাড়া গল্পলেখকের আর কী কৃতিত্ব থাকতে পারে!
‘ক্রসফায়ার’ গ্রন্থটি গল্পপাঠকদের নিশ্চিত ভালো লাগবে।
 পরিশিষ্ট :
আনোয়ারুল হক আমার শিক্ষক ও সাহিত্য পথের সহযাত্রী। আমাদের সখ্য ও অনুরাগের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। বর্তমানে তাঁর বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। তিনি আমাকে তাঁর বেশি বয়সের কথা (মোটেই না। তারুণ্যে তিনি আনেক তরুণকেও ছাড়িয়ে যান!) স্মরণ করে দিয়ে বলেছেন, আধুনিক গল্প বলার কলা-কৌশল সম্পর্কে তাঁর তেমন একটা জানা নেই। আমারও তাই মনে হয়েছে। তাঁর গল্পে জাদু বাস্তবতা, উত্তর আধুনিকতা, দাদাবাদ, পরাবাস্তবতা, বিনির্মাণবাদের শক্ত প্রকরণগুলো খুঁজে পাওয়া যায় না। ভাগ্যিস যায় না। যদি সেই সব প্রকরণ থাকতো তাহলে আমার পক্ষেও তাঁর গল্পের পাঠ উদ্ধার করা সম্ভব হতো না। শিক্ষকের মতো ছাত্রেরও ওইসব কলা-কৌশল খুব জানা নেই।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক