ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
রাজনীতিবিদদের ভাবতে হবে
Published : Sunday, 11 April, 2021 at 12:00 AM
রাজনীতিবিদদের ভাবতে হবেমোস্তফা হোসেইন ||

রাজনীতির বৈঠা কার হাতে যাবে? এতদিন গলা চড়িয়ে বলা হচ্ছিলো, রাজনীতি নাও চলছে ব্যবসায়ীর লগিতে। রাজনীতিতে রাজনীতিবিদগণ সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছেন। বাস্তবতা তেমন হলেও রাজনীতির অস্তিত্ব কিছুটা হলেও আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার পরিপ্রেেিত বলতেই হবে, রাজনীতির গন্তব্য কোথায়?
রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা নাকি স্বার্থান্ধ মানসিকতায় আজকে রাজনীতিবিদদের হাত থেকে রাজনীতি চলে যাচ্ছে অপশক্তির হাতে। একবারও কী ভাবনায় আসে, রাজনীতিবিদদের হাত থেকে রাজনীতি সরে গেলে দেশের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? ভোটের হিসাব-নিকাশে এই অরাজনৈতিক ও অপরাজনৈতিক শক্তি যেভাবে ঢুকে পড়ছে তার চূড়ান্ত পরিস্থিতি কী হতে পারে
ব্যবসায়ীরা এমপি-মন্ত্রী হচ্ছেন, অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু একটা বিষয় মানতে হবে, এবং এই ব্যবসায়ীরা রাজনীতিকে অধিকাংশ েেত্র ব্যবসায় স্বার্থে ব্যবহার করলেও তাদের কিছুটা হলেও মানুষের কথা ভাবতে হয়। এটা নিজের অবস্থান ঠিক রাখার জন্য যেমন প্রয়োজন তেমনি তাদের পেশাগত সুবিধার কথা চিন্তা করেও। তারপরও ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদগণ প্রায় সবাই উচ্চশিতি। কিন্তু এখন যেভাবে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে রাজনীতি ফসকে যাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যৎ কী হবে বলা মুশকিল। এখনই এই মুহূর্তেই তাদের ভাবতে হবে, রাজনীতি কার হাতে যাবে? আশঙ্কিত এই শক্তির প্রায় সবাই আধুনিক দুনিয়ার গতি সম্পর্কে অজ্ঞ এবং মানসিকতার দিক থেকে অন্ধকার যুগের অনুসারী।
একের পর এক অঘটন ঘটে চলেছে দেশে। সুনামগঞ্জের শাল্লায় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হয়েছে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে। কয়েক বছরের ইতিহাসে রামু, কোটালীপাড়া, বগুড়া (চাঁদে সাঈদীকে দেখা নিয়ে ভাংচুর, হামলা), নাসিরনগর এবং অতি সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তা-বকে যারা ধর্মীয় উন্মাদনা হিসেবে দেখছেন, তাদের পর্যবেণ সম্পূর্ণ ভুল। এর প্রমাণ তাদের কর্মসূচি এবং বক্তব্য-বিবৃতি। কর্মকা-ই শুধু নয়, তাদের প্রায় সবারই রাজনৈতিক পরিচয় আছে। তারপরও তারা কখনও বলছে, তাদের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কখনও বলছে– ‘না হলে সরকারের পতনের আন্দোলন’। ইতোমধ্যে তারা স্বাধীনতা ও বাংলাদেশের প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভেঙেছে, বঙ্গবন্ধুর ছবিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। যা স্পষ্টত পাকিস্তানি ভাবধারার রাজনীতির সূচনা বলে মনে করতে হবে। তারা কিন্তু একবারও বলছে না বঙ্গবন্ধু ধর্মবিরোধী। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তাদের ােভের কথা তারা প্রকাশ করেনি। কিন্তু বারবার তারা মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকেই আক্রমণ করছে। সুতরাং তাদের কর্মকা- দেখে স্পষ্টতই প্রমাণ হয় তারা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকেই টার্গেট করে এগিয়ে যাচ্ছে। যা শতভাগ রাজনৈতিক উদ্দেশে পরিচালিত।
রাজনীতি করার অধিকার তাদের আছে। যেমনি প্রতিটি নাগরিকের আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের স্বাধীনতার প্রতীক ও জাতির পিতাকে অবমাননা করে কি রাজনীতি হতে পারে? সরকার পতনের ডাক কি অরাজনৈতিক সংগঠনের হতে পারে? তারা কি নিজেদের রাজনৈতিক দলগুলো থেকে পদত্যাগ করে ধর্মীয় আন্দোলনে শরিক হয়েছে? বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় অুণ্ন রেখেই তারা রাজনৈতিক মাঠে নেমেছে। সেই অনুযায়ী তারা কাজও করছে।
সুতরাং মনে করার যথেষ্ট যুক্তি আছে যে, রাজনীতিতে ভাংচুর পার্টিগুলো শক্তভাবেই গোড়াপত্তন করতে সম হয়েছে। তা না হলে কোনও ব্যক্তি কি ‘রক্তের বদলা নেওয়া’র আহ্বান জানাতে পারে? শুধু তা-ই নয়, এমন অস্বাভাবিক হুংকারের পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে, যেসব স্থানে এই তা-বগুলো মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে সেখানে রাজনৈতিক শক্তি কতটা। এই অপশক্তিকে রাজনৈতিকভাবে অবদমিত করার কি ব্যবস্থা তারা নিয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের অফিস ও বাসায় আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে, আওয়ামী লীগ অফিসও বাদ যায়নি অন্য অবকাঠামো ধ্বংসের তালিকা থেকে। এর আগে সেখানকার দলগুলোর ভূমিকা কী ছিল? যদি সাংগঠনিক শক্তি মজবুত থাকতো তাহলে হয়তো এভাবে রাজনৈতিক দলের অফিস, নেতার বাড়ি ও অফিস ধ্বংস করতে পারতো না।
সাম্প্রদায়িক শক্তি কখনও প্রকৃত রাজনৈতিক সংগঠন হতে পারে না। তাদের সুপ্ত বাসনা রাজনীতি কিন্তু কর্মকা- সন্ত্রাসের। সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো সবখানেই এভাবেই সংগঠিত হয়। উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠনের ইতিহাসে দেখা যায়, জামায়াতে ইসলামীও শুরুতে শুধু ইসলামি সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা রাজনীতিকে বিষাক্ত করার সর্বত চেষ্টাই করেছে এবং এখনও করছে। এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের নাম পরিবর্তনের ঘটনাও তারা ঘটিয়েছে।
দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোকে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে। যেমনি রাজনীতিকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়েছে। মতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে ব্যবসায়ীরা অর্থসংস্থানের নিশ্চয়তা দিয়েছে। অন্যদিকে পেশীশক্তির প্রয়োজনে বড় রাজনৈতিক দলগুলো এই অপশক্তিগুলোকে কাছে টানছে। তারা ভাবছে না সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো সুযোগ পেলেই নিজেদের অবস্থানে চলে যায়। সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেলে তারা সন্ত্রাসের মাধ্যমে তোলপাড়ও সৃষ্টি করতে পারে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতির আদর্শ বদলাতে ভূমিকা পালন করে, কিন্তু সাম্প্রদায়িক জঙ্গিমুখী সংগঠনগুলো রাজনীতির গলা টিপে ধরতে একচুলও ছাড় দেয় না। দেবেও না। ওরা পরগাছা হয়ে জীবনীশক্তি অর্জন করে মূলগাছ কাটতে পারঙ্গম।
সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন স্থানে তা-বের পর ধারণা করা হয়েছিল হয়তো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ত্যাগ করবে বৃহত্তম দলটি। কিন্তু সংবাদ হলো সহিংসতার অভিযুক্তদের তালিকাটি অজানা অভিযুক্তদের নামেই ভরে গেছে। ‘রক্তের বদলা নেওয়ার’ নির্দেশ প্রদানকারী বহাল তবিয়তে রয়েছে। আরেকটি বড় দল জামায়াতমুক্ত হওয়ার পথে দুই পা এগিয়ে গেলেও হঠাৎ করে জামায়াতবন্ধনটাকে আরও দৃঢ় করতে উদ্যোগী হলো। এই বিষয়ে সংবাদ হয়েছে, দলটির সিনিয়র কোনও এক নেতার একক ইচ্ছাতেই জামায়াতবন্ধনমুক্ত হতে পারেনি তারা।
প্রশ্ন হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক অপরাজনীতির সংগঠন যদি রাজনীতির মূলশক্তির কাছাকাছি হয় তখন তার প্রভাব রাজনীতিতে অবশ্যম্ভাবী। আর তা যে আমাদের জাতীয় রাজনীতিকেই ডুবিয়ে ছাড়বে তা বলার অপো রাখে না। এই মুহূর্তে আমাদের ভাবতে হবে, রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের হাতে রাখা হবে, নাকি অরাজনৈতিক কিংবা অপরাজনীতির উদরে রাজনীতি বিলুপ্ত হবে?

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।