ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
বাংলা নববর্ষ :শিকড়ের সন্ধান
Published : Wednesday, 14 April, 2021 at 12:00 AM
বাংলা নববর্ষ :শিকড়ের সন্ধানড. মো. অলীউল আলম ||
বাংলা নববর্ষ পালনের মূলে আছে কৃষি। আগে বছর গণনার ভিত্তি ছিল চন্দ্রকলা। পরে ফসল বোনা ও কাটার বা কৃষির কারণে চন্দ্র ও সূর্য বা চন্দ্রসৌর বছরভিত্তিক গণনা শুরু হয়। এনামুল হক লিখেছেন, গোড়ায় নববর্ষ ছিল মানুষের ঋতুধর্মী অনুষ্ঠান। ঋতুধর্মী বলে কৃষির সঙ্গেও এর সম্বন্ধ ছিল অতিঘনিষ্ঠ। কারণ কৃষিকাজ একটি ঋতুনির্ভর মানববিজ্ঞান। প্রকৃতির কাছে নতিস্বীকার নয়, ঋতুর পরিবর্তন থেকেই পালিত হতে থাকে নববর্ষ। খ্রিষ্টীয় সাল গণনা করা হয় সূর্যের হিসাবে। আবার হিজরি সাল গণনা করা হয় চাঁদের হিসাবে। মোগল সম্রাট আকবরের সময়ও রাজকাজে হিজরি সাল চালু ছিল। ফলে কৃষি ফলনের সঙ্গে তা মিলত না। আকবর তাই সূর্যের বছরের সঙ্গে চাঁদের বছরের সমন্বয়ের কথা ভাবলেন। দায়িত্ব দিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজিকে (১৫৫৬ সাল বা ৯৯২ হিজরিতে)।
বাংলা নববর্ষ বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় উৎসব-আনন্দে মেতে ওঠার দিন এবং আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় গণমুখী উৎসব। নববর্ষ সে জন্যই আমাদের আর্থ-সামাজিক ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় বাঙালির ঐতিহ্যের অহঙ্কার। বাংলা নববর্ষ এমন একটি দিন, এর প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, এটি হিন্দু বা মুসলমান কিংবা বৌদ্ধের একক কোনো উৎসবের দিন নয়। এটির চরিত্র সর্বজনীন। এখানকার নববর্ষের অনুষ্ঠান উৎসবাদি ধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত নয়। কারণ আমাদের অধিকাংশ অধিবাসী হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান ও খ্রিষ্টান অধ্যুষিত দেশ অথচ এখানে ধর্মের কোনো বিশেষ প্রভাব আমাদের নববর্ষের অনুষ্ঠানে ও উৎসবে দেখা যায় না। পহেলা বৈশাখ কোনো লোকাচার ছাড়া চারশ' বছরেরও অধিককাল আগে অর্থাৎ সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর কৃষি ও ঋতুর সঙ্গে অনেক অনুষ্ঠান যুক্ত হয়ে পড়ে এবং এভাবেই আবর্তিত হয়ে পহেলা বৈশাখ রূপান্তরিত হয় নববর্ষে। বিগত শতকের ষাটের দশকে এভাবেই বাংলা নববর্ষ এক নতুন রাজনৈতিক মাত্রা লাভ করেছে। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশে কোনো ঋতু এ রকম রাজনৈতিক ও সামাজিক মাত্রা লাভ করেছে বলে আমার জানা নেই। আবহমানকাল বাঙালির নববর্ষের উৎসব পূর্বসূরির জীবনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। নগরবাসীর জীবনে নববর্ষ দীর্ঘকালব্যাপী ছিল উপেতি। এখানে আমাদের নাগরিক জীবনের কাজকর্ম, দেনা-পাওনা, ব্যবসা-বাণিজ্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত খ্রিষ্টীয় সন-তারিখ ধরে চলে। তা সত্ত্বেও আমরা দেশজ সংস্কৃতির অঙ্গ বাংলা নববর্ষকে অনুভব করেছি অন্তরের তাগিদেই। বাঙালিয়ানার প্রতি আমাদের আন্তরিক আনুগত্যের কারণেই বাংলা নববর্ষ প্রত্যেকের মনে ঐতিহ্য চেতনার রঙিন আলো ছড়িয়ে দিয়েছে।
১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ সরকারকে বিপুলভাবে পরাজিত করে মুখ্যমন্ত্রী ও বাঙালিদের নেতা শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের সরকার বাংলা নববর্ষের ছুটি ঘোষণা করে এবং দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানায়। অবশ্য এ তাৎপর্যপূর্ণ বিজয় স্থায়িত্ব লাভ করেনি। যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দিয়ে এবং সামরিক শাসন জারি করে তা সাময়িকভাবে রুখে দিয়েছিল স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার। সরকারিভাবে আর নববর্ষ উদযাপিত হয়নি পাকিস্তান আমলে; কিন্তু প্রবল আগ্রহ ও গভীর উৎসাহ-উদ্দীপনা বাঙালির বর্ষবরণ গণজোয়ারে রূপ নেয়। এরই মধ্যে সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত হয়ে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট (১৯৬১) বর্ষ পালনে উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৬৭ সাল থেকে রমনার বটমূলে (পাকুড়মূল) নববর্ষের যে উৎসব শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় বাধাহীন পরিবেশে, জনসাধারণের অংশগ্রহণে তা জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিার্থী ছাড়াও সারাদেশে যে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়, তা আবহমান বাঙালি ঐতিহ্যের স্মারক বহন করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা নববর্ষ ঘোষিত হয় সরকারি ছুটির দিন হিসেবে। এ সরকারের আমলে বাংলা নববর্ষ ভাতা কিংবা বৈশাখী ভাতা উৎসব পালনে নতুন মাত্রা যুক্ত করে দেয়। ধর্মীয় উৎসব ভাতা স্ব-স্ব ধর্মের মানুষ শুধু তাদের ভিন্ন ভিন্ন পালা-পার্বণে পেয়ে থাকে।

অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান ও উপাধ্যক্ষ নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ, রাজশাহী