ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
ভিন্ন প্রেক্ষাপটেও যেন আশা না মরে
Published : Wednesday, 14 April, 2021 at 12:00 AM
ভিন্ন প্রেক্ষাপটেও যেন আশা না মরেহাসান আজিজুল হক ।।
বাংলা নববর্ষের সূচনা এবং এর ক্রমধারাবাহিক অগ্রযাত্রা সচেতন মানুষ মাত্রেই জানা। পারিবারিক ও সমাজ জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে। কিন্তু এবার নববর্ষ আমাদের সামনে এসেছে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্রোপটে, মর্মন্তুদ অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণে। এর মধ্যে প্রায় গোটা বিশ্বে যে মর্মান্তিকতার ছায়া পড়েছে ও তা ক্রমপ্রসারিত হচ্ছে, তাতে আমাদের পুরোনো ঐতিহ্য সবাই মিলেমিশে নববর্ষ উদযাপনে এবার বাদ সেধেছে। মানুষ শঙ্কা-আতঙ্কে জড়সড়। দুটি বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি আমার স্মরণে আছে। লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারাল ওই দুটি যুদ্ধে। এই নির্মম অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছিল মানুষের হাতে। কিন্তু করোনা অধ্যায়টা সে রকম নয়। প্রকৃতির অঘোষিত যুদ্ধের বিরুদ্ধে আজ মানুষ লড়ছে। প্রকৃতি এক দিক বা অন্য দিক থেকে প্রতিশোধ নিচ্ছেই। একি প্রকৃতির ওপর মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকা-ের বিরূপ ফল? চিকিৎসাবিজ্ঞানের এত উৎকর্ষতাও পরাস্ত করতে পারছে না জীবাণু দানবকে। রাষ্ট্রশক্তির নানা রকম ব্যবস্থা, দেশে দেশে নিজ নিজ অবস্থান থেকে মানুষের শত প্রচেষ্টা, কিছুই যেন থামাতে পারছে না করোনাভাইরাস নামক মৃত্যুদানবকে। এ থেকে উত্তরণের পথ মানুষই বাতলাবে; কিন্তু তা কবে। বেশ কিছু দুরারোগ্য ব্যাধি নির্মূল হয়ে গেছে মানুষের প্রচেষ্টায়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায়। নববর্ষের ঊষালগ্নে কামনা করি, এই গাঢ় ছায়া অপসারিত হোক। মানবজাতি রা পাক বিপর্যয়ের হাত থেকে। তারা আবার জেগে উঠুক সব দানবীয়তাকে পরাস্ত করে, ধ্বংসের মাঝে দাঁড়িয়ে নব প্রত্যয় নিয়ে।
পুরোনো দিনের সব গ্লানি, কষ্ট ও হাহাকার ভুলে নতুন বছরের সূর্যকে আমরা আহ্বান করি নতুন রূপে। সবার কল্যাণ ও শুভ হোক- এই প্রত্যাশা শুভবোধসম্পন্ন সবার। আমাদের নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির যোগাযোগ কতটা নিবিড়, এর ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণও নতুন করে নিষ্প্রয়োজন। আমাদের দেশে অনেক ুদ্র নৃগোষ্ঠী কিংবা জাতিসত্তার মানুষ রয়েছে; যাদের প্রত্যেকেরই বছরের নতুন দিনে উৎসব আছে। বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়াও পৃথিবীর আরও নানা দেশে বাঙালি জনসমাজে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়ে থাকে। মূলত প্রবাসী বাঙালিরা সেসব দেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে থাকেন। বাংলা নববর্ষ স্বাধীন দেশে আমরা যেভাবে পালন করে আসছি এবং নিজেদের মতো করে এই উৎসব পালনের পরিবেশটি অর্জন করেছি এর জন্য আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে আসতে হয়েছে। যুগে যুগে, ক্রমে ক্রমে এই বোধটুকুই পুষ্ট হয়- বাঙালি জাতিসত্তার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠার একটি উৎসব, আর তা হলো পহেলা বৈশাখ। যুগের সঙ্গে অনেক কিছুই এগিয়েছে। আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিও সে অর্থে পিছিয়ে নেই। আর এ জন্য সাড়ম্বরে আমরা পালন করি বাংলা নববর্ষ উৎসব। বাংলা নববর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'। এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে মানবতার বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। ইউনেস্কো বলেছে, 'এই মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের মানুষের সাহস আর অশুভর বিরুদ্ধে গঠিত লড়াই।' এ আমাদের আরেকটি বড় অর্জন।
উল্লেখ্য, শুধু বাঙালি জাতি নয়, পৃথিবীতে আরও অনেক মানুষের নববর্ষ আছে। এক দিনে সব নয়। ইতিহাসের ধারায় বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে বছরের দিনকাল গুনে তাকে চিনে নেওয়া যায়। প্রকৃতির আবর্তনে প্রত্যরে একই ছবি চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা নিয়ে ফের যখন ফিরে আসে, তখন আমরা সবাই বুঝি নববর্ষ এসেছে। মনে লাগে আনন্দের দোলা। সারা বছরের এই একটা দিন, ভিন্ন মাত্রায় আমাদের সামনে আসে। পহেলা বৈশাখ, নববর্ষের দিন। সংস্কৃতি তাকে চেনানোর কারণেই যোগ হয় অনন্য মাত্রার। সংস্কৃতির সৃষ্টিময়তা প্রাণের স্পর্শ জাগায় এবং আনন্দে সবাই মিলিত হই। এখানেই আমাদের নববর্ষ অর্থাৎ বাংলা নববর্ষ বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। আমাদের নববর্ষের ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে; যা ুদ্র পরিসরে আলোচনা করে শেষ করা যাবে না। আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়, অবিভক্ত এই জনপদে তো বটেই, স্বাধীন বাংলাদেশেও আমাদের সংস্কৃতির ওপর আঘাত কম আসেনি। রমনার রক্তাক্ত বটমূল এর একটি মাত্র মর্মন্তুদ দৃষ্টান্ত। কিন্তু আশার কথা এই যে, আমাদের জাতীয়তাবাদের চেতনা ও মূল্যবোধের শানিত ভাবনা সবই প্রতিহত করেছে স্বকীয়তা বজায় রেখে। এ জন্যই আমাদের আত্মপরিচয়ের গৌরব উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করার দিন বাংলা নববর্ষ। আমাদের যে সাংস্কৃতিক পরিচয়-ঐতিহ্য, যুগে যুগে এর বিকাশ ঘটেছে নানা মাধ্যমে। আমাদের চিত্রকলা-শিল্পকলা-চারুকলা, এমনকি মাঠের ফলন্ত ফসল কাটার মধ্য দিয়েও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অনুসন্ধান করা যায়।
১৪২৬ সন পেরিয়ে আমরা ১৪২৭ সনে একটি নতুন বাংলাদেশ দেখতে চাই। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে মানবজাতি বহুবার আক্রান্ত হয়েছে, আবার মাথা তুলেও দাঁড়িয়েছে ঝড়-ঝাপটা অতিক্রম করে। বিদ্যমান সংকটও কাটবে, মানুষের উদ্ভাবনী শক্তিই অদৃশ্য দানবকে পরাস্ত করবে। যে করোনাভাইরাস দানব বিশ্বের এক লাখেরও বেশি মানুষকে ইতোমধ্যে কেড়ে নিয়েছে, এর বিনাশও অবশ্যই ঘটবে। চারদিকে তের দগদগ চিহ্ন। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর বেদনার দীর্ঘশ্বাস পড়ছে আমাদের এখানেও। অধ্যায়টা মর্মন্তুদ, তাতে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। তবুও আমরা আশাবাদী। এমন বাস্তবতায় শুধু নতুন বাংলাদেশ নয়, নতুন পৃথিবীও দেখার অপো করছি।
আমরা মানুষের জন্য যান্ত্রিকতাশূন্য, অমানবিকতাশূন্য একটা গ্রহ চাই। এই গ্রহ মানবেতর যে কোনো প্রাণীর জন্য বিপদমুক্তভাবে বসবাসের যোগ্য হয়ে উঠুক। অশুভ প্রবণতা বদলাক। আরও সৃজনশীল মানবসমাজ দেখতে চাই। অন্ততপে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যা দেখছি, এই বিরূপতা আর দেখতে চাই না। এই বিরূপতার কারণ নিয়ে দেশে দেশে নানা কথা হচ্ছে বটে; কিন্তু এসব নিয়ে তর্ক-বিতর্কের সময় এখন নয়। অনেক েেত্র সম্পূর্ণ আশা বিসর্জন দেওয়ার অনেক কারণ থাকলেও যে মানুষ শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলছে, সে আরও বাঁচতেই চায়। এই চাওয়া মানুষের সহজাত আকুতিরই বহিঃপ্রকাশ। আশাবাদী হওয়া কি মানুষের দুরারোগ্য ব্যাধি? দুরারোগ্য ব্যাধি হলেও তার জ্ঞাননেত্র কখনোই উন্মীলিত হয় না, মোহ কাটে না। আমিও সেই একই দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছি।
প্রকৃতিই পৃথিবীর মাটি-তৃণ আকীর্ণ করে ফেলে। প্রকৃতির কাছ থেকে এই শিাটিই নিতে হয়। আশা মরে না। ১৪২৭-এর জন্যও তাই আশাকে জিয়ন্ত রাখি। সবার জীবন মঙ্গলময় হোক।

শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক