
মোস্তফা হোসেইন ||
অস্বাভাবিক
একটা সময় যাচ্ছে এখন। একের পর এক প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ মনটা ভারি করে
দিচ্ছে। একইদিন দুটি মৃত্যু আমার মতো অনেককেই বাকহীন করে দিয়েছে। একজন
কুমিল্লা-৫ নির্বাচনী এলাকার মাননীয় সংসদ সদস্য এবং সাবেক আইনমন্ত্রী
আব্দুল মতিন খসরু এবং অন্যজন বাংলা একাডেমি পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও
গবেষক শামসুজ্জামান খান। দু’জনের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা। আব্দুল
মতিন খসরুর রাজনৈতিক জীবনের উত্থানকালের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুবাদে অসংখ্য
স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাঁর সঙ্গে। বাংলাদেশের বয়সের সমান সেই সময়। ‘৭১-এর
নভেম্বর মাসের শেষ দিকে আমাদের এলাকা স্বাধীন হয়ে যায়। ডিসেম্বরের গোড়ায়
মানুষ বাড়ি ফিরতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধা এবং ছাত্রলীগের কর্মীরা খোঁজ খবর
নিতে থাকে একে অন্যের। বীর মুক্তিযোদ্ধা জামাল ই আলমের কাছ থেকে জয়বাংলা
পত্রিকা আনতে গিয়ে খবর পেলাম, মুজিব বাহিনীর সদস্যরা বুড়িচং এসেছেন। পরদিন
ছাত্রলীগের জরুরী সভা ডেকেছেন বুড়িচংয়ে, জিজ্ঞেস করলেন আমি যাবো নাকি। রাজি
হয়ে গেলাম।
বুড়িচং পোস্ট অফিসে তখন মুজিব বাহিনীর থানা কমান্ডার
আব্দুল মতিন খসরুর নেতৃত্বে একটি গ্রুপ অবস্থান করছেন। মেঝেতে খড় বিছানো।
একটি লম্বা বেঞ্চ আছে দেওয়াল ঘেষে। খড়ের ওপরই বসার ব্যবস্থা। সিদ্ধান্ত হলো
৬ জানুয়ারি বুড়িচং থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সভা হবে।
১৯৭২ সালের ৬
জানুয়ারি একই জায়গায় সাধারণ সভা। ৩৫/৪০জন ছাত্রলীগের উপস্থিতিতে বুড়িচং
থানা ছাত্র লীগের শাখা গঠন হলো। আব্দুল মতিন খসরু হলেন সভাপতি, সহ-সভাপতি
হলেন আব্দুল মজিদ চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক হলেন মো. শহিদুল্লাহ,সাংগঠনিক
সম্পাদক হলেন ছিদ্দিকুর রহমান, ডিজিএস হলাম আমি। স্বাধীনতা পূর্বকালে
চান্দলা কে বি হাই স্কুল ছাত্রলীগ শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও
খসরু ভাইয়ের সঙ্গে অতটা ঘনিষ্ঠতা হওয়ার সুযোগ হয়নি।
১৯৭৩ সালে
নির্বাচনকালে বুড়িচং থানা আওয়ামী লীগের কার্যক্রম ভাটা পড়ে দলীয় কোন্দলের
কারণে। কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগে মুশতাক গ্রুপ এবং মিজান গ্রুপ তখন আওয়ামী
লীগকে অনেকটা দুর্বল করে দিচ্ছিলো। বুড়িচং থানা আওয়ামী লীগেও তার ছোঁয়া
লাগে। ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে বুড়িচং থানা থেকে নির্বাচিত এমপিএ
অ্যাডভোকেট আমীর হোসেন সাহেবের সঙ্গে ছাত্রলীগের দূরত্ব বেড়ে যায়। ছাত্রলীগ
নতুন নেতৃত্ব দেখতে চায়। তাদের পছন্দ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুসকে। শেষ
পর্যন্ত তিনিই নমিনেশন পেলেন এবং নির্বাচনে জয়ীও হলেন। সেই নির্বাচনকে আসলে
আওয়ামী লীগের না বলে ছাত্রলীগের বলাই ঠিক হবে। কারণ তরুণ ছাত্রলীগ নেতা
আব্দুল মতিন খসরু, আব্দুল মজিদ চৌধুরী, মো. শহিদুল্লাহ ও ছিদ্দিকুর রহমানের
সম্মিলিত নেতৃত্বে বুড়িচং থানার তরুণরা একাট্টা। সে কী আন্তরিকতা। নিমসার
থেকে মকিমপুর, ষোলনল থেকে সিদলাই, লাড়ুচোঁ হেঁটে হেঁটে নির্বাচনী
প্রচারণা। আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের নেতৃবৃন্দ কেউ কেউ ঝিমিয়ে পড়েছেন, মুলফত
আলী (পরবর্তীকালে কচ্যুত), শামসুদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ আব্দুল কাফি, বাশার
চেয়ারম্যানের নাম মনে আছে, যারা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করতেন। আরও আছেন
যাদের নাম মনে করতে পারছি না।
অধ্যাপক মো. ইউনুস এমপি হলেও বিজয় হলো
ছাত্রলীগের। কিন্তু আব্দুল মতিন খসরুর সততা এবং আন্তরিকতার কারণে
ছাত্রলীগের কোনো কর্মীই বাড়াবাড়ি থাক দূরের কথা সামান্যতম এদিকসেদিক করার
সুযোগও পেতেন না। আজকের মতো ব্যবসা বাণিজ্যের চিন্তা তখনকার ছাত্রলীগের
কোনো কর্মীর পে করা সম্ভব ছিলো না। অথচ এই কর্মীদের অধিকাংশেরই বাড়িঘর ছিলো
না। পড়ার বই ছিলো না। ঘুমানোর জন্য কাঁথা-বালিশও ছিলো না।
১৯৭২ সালেই
ছাত্রলীগের বিভক্তি দেখলাম আমরা। মনে আছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের
জাতীয় সম্মেলনে যোগ দেব আমরা। কুমিল্লা থেকে ভোর রাতে ট্রেনে চড়েছি।
আমাদের নেতা ছিলেন আব্দুল মতিন খসরু। কসবা স্টেশনে আসার পর খসরু ভাই বললেন,
ওজুটা করে আসি। তিনি নামলেন কিন্তু ওজু শেষ করে আসতে আসতে ট্রেন ছেড়ে
দিলো। আমরা আব্দুল মজিদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ঢাকায় জাতীয় সম্মেলনে যোগ দিলাম।
এমন
কত স্মৃতি জমে আছে মনে। আব্দুল মতিন খসরু তখন এলএলবি পড়ছেন। ল’কলেজে
নির্বাচন করলেন। বিপুল ভোটে বিজয়ী হলেন। আমি তখন মতলব কলেজে পড়ি। খবর দিলেন
অভিষেক অনুষ্ঠানে থাকার জন্য। কুমিল্লা টাউনহলে বিশাল আয়োজন। যতটা মনে আছে
খন্দকার মুশতাক, অধ্যাপক ইউসুফ আলী সম্ভবত মিজানুর রহমান চৌধুরীও ছিলেন
অনুষ্ঠানে। আওয়ামী লীগের ভিতরগত বিভক্তি আব্দুল মতিন খসরুকে দখল করতে
পারেনি। ভিপি হিসেবে আব্দুল মতিন খসরু প্রধান অতিথির চেয়ে বেশি সময় বক্তৃতা
করলেন। একজন ছাত্রনেতা যে এভাবে মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে বক্তৃতায়, তা
মনে হয় অনেকেই ধারণা করতে পারেনি। তারপর একসময় তিনি এমপি হলেন। দেখলাম
বুড়িচংয়ের প্রতি কতটা আন্তরিকতা। গুণীজনকে কিভাবে তিনি সম্মান করতেন তাও
দেখলাম। ১৯৯১ সালে আমার গ্রামের স্কুলে দাওয়াত করলাম তাকে। চান্দলা কে বি
হাই স্কুল প্রাক্তন ছাত্র সমিতির প্রতিষ্ঠা উপলে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান
অতিথি হলেন আমার কাকা ও সাবেক কৃষি মন্ত্রী আজীজ-উল হক। নির্বাচিত এমপি
হওয়ার পরও তাকে যখন বলা হলো আজীজ উল হককে প্রধান অতিথি করলে তিনি রাজি হবেন
কিনা। কালপেন করলেন না রাজী হতে। শুধু তাই নয় চান্দলা কে বি হাই স্কুল
প্রাক্তন ছাত্র সমিতির সভাপতি হিসেবে আমি তাকে একবার নিমন্ত্রণ করলাম
যেখানে বিএনপির হুইপ আশরাফ হোসেন ছিলেন প্রধান অতিথি। প্রাক্তন ছাত্র
সমিতির সভাপতি হিসেবে ২০১১ সালে চান্দলা কে বি হাই স্কুলের শতবর্ষী
অনুষ্ঠানেও তাকে দাওয়াত করলাম, এবারও বিশেষ অতিথি হিসেবে। প্রধান অতিথি
ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফীন সিদ্দিক। তিনি বললেন
উপাচার্য সাহেব শিক তাকে প্রধান অতিথি করলে তিনি বিশেষ অতিথি হিসেবে যেতে
সমস্যা নেই। আর সেই অনুষ্ঠানে তার পাশে বসা ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের
তৎকালীন উপদেষ্টা সাংবাদিক শওকত মাহমুদ।
তাঁর মধ্যে একটা গুণ ছিলো
ব্যতিক্রমী। তিনি মনে করতেন সম্মান পেতে হলে মানুষকে সম্মান করতে হবে। একই
মঞ্চে রাজনৈতিক প্রতিপরে সহাবস্থান বাংলাদেশের আর কোথাও এমন প্রমাণ আছে কি
না জানি না। কিন্তু আব্দুল মতিন খসরু সেই অসম্ভবকেও সম্ভব করেছিলেন বড় মনের
অধিকারী হওয়ার কারণে। কয়েক বছর আগের একটা উদাহরণ দিতে পারি। বুড়িচং এ একটা
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিলো আমার। মঞ্চে
দেখলাম বিএনপি থেকে নির্বাচিত সাবেক এমপি অধ্য মোহাম্মদ ইউনুসকে। দুজনই নিজ
নিজ রাজনৈতিক অবস্থান ভুলে সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বললেন।
নব্বইয়ের
দশকে আব্দুল মতিন খসরু হলেন এমপি। হলেন আইন উপমন্ত্রী। ঢাকায় সংবর্ধনা
দেওয়া হলো প্রেসকাবে। আমি রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও হাজির হয়ে অবাক হয়ে
গেলাম। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সাবেক কৃষিমন্ত্রী আজীজ-উল হক,
বিশেষ অতিথি বুড়িচংয়ের বিএনপি নেতা সাবেক যুবপ্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেম ও
জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দিতাকারী ওয়াহিদুন্নবী।
রাজনৈতিক
প্রতিপকেও সম্মান জানানোর এমন উদাহরণ সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিলো আব্দুল মতিন
খসরুর বিশালত্বের কারণে। যে কারণে দলমত নির্বিশেষে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিলো
অকল্পনীয়।
তিনি গুণীজনকে সম্মান করতেন, আরেকটি উদাহরণ-ডেইলি স্টার
পাবলিকেশন্স আমার লেখা ‘কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সমগ্র’ প্রকাশ করেছে। উৎসর্গ
করেছি প্রিয় নেতাকে। আমার অফিসে একবার দাওয়াত করেছিলাম অনুষ্ঠানে। তাকে
বইটি দিয়ে পাশে বসে আছি। তিনি পাতা উল্টিয়ে দেখেন, বইটি উৎসর্গ করেছি তাকে।
সে কী খুশি। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, দুইজন বিখ্যাত মানুষ আমার পাশে বসা,
তাদেরসহ ছবি তোলো একটা। অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ও ডা. জাফরুল্লাহ
চৌধুরীকে কাছে টেনে নিয়ে ছবি নেয়ার ব্যবস্থা করলেন।
আরেকবার একটি
অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করেছি তাঁকে। অনুষ্ঠানশেষে মোবাইলে রাখা একটি ছবি
দেখালাম। লিফটে ওঠার আগে তিনি থেমে গেলেন, আবেগাপ্লুত হয়ে গেলেন তাঁর
যুদ্ধস্মারক দেখে। লিফট ছেড়ে দিয়ে বললেন, একটা ফটোকপি করে দাও আমাকে। অন্তত
৫/৭মিনিট দাঁড়িয়ে রইলেন, আমার ফিরে আসা পর্যন্ত। যুদ্ধস্মারকটি হচ্ছে-
আমাকে দেওয়া মুজিববাহিনীর থানা কমান্ডার আব্দুল মতিন খসরুর একটি
প্রশংসাপত্র।
সেই প্রশংসাপত্রটি আগলে রেখেছি অতিযতেœ। কিন্তু খসরুভাইকে
পারলাম না। চলে গেলেন অজানা দেশে। যেখানেই থাকুন অনেক অনেক ভালো থাকুন
খসরু ভাই।
লেখক- সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।