গোলাম কবির ।।
বিশ্বজোড়া
করোনাভাইরাস আক্রান্ত আসুরিক পরিবেশে রবীন্দ্র জন্মদিনের কথা সামনে রেখে
বলতে ইচ্ছা করে উনিশ শতকের পরাধীন বাংলায় শাসনতান্ত্রিক ন্যায়বোধের অভাব ও
রোগ, শোক, দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে রবীন্দ্রনাথ দৃঢ়চিত্ত
সত্যিকার মানুষের প্রয়োজন প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে সামনে
এনেছিলেন।
বিদ্যাসাগরকে রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন ‘যথার্থ মানুষ’, এর
মূলে ছিল বিদ্যাসাগরের ‘অজেয় পৌরুষ’ আর ‘অয় মনুষ্যত্ব’। রবীন্দ্র কবিমানসে
এই চেতনা জাগ্রত হওয়ার ফলে বাঙালি চরিত্রে সেই দৃঢ়তা ও মনুষ্যত্ব কিভাবে
উজ্জীবিত করা যায়, তার দিকনির্দেশনা তিনি নানাভাবে রূপায়িত করার সাধনায় রত
হন। ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ রচনাকালে তিনি ‘চিত্রা’ কাব্যের জগতে। উনিশ শতকের
শেষ পর্যায়ে, কবি তখন স্বকীয় প্রতিভার সন্ধান পেয়েছেন। কল্পলোক থেকে
মানুষের সুখ-দুঃখ নিয়ে ভাবনায় তিনি উদগ্রীব।
স্মর্তব্য, রবীন্দ্র
কবিমানসে ‘যথার্থ মানুষ’ অনুসন্ধানের প্রগাঢ় উপলব্ধি পূর্ববাংলায় আগমন
থেকেই শুরু। আর সেই অনুভবের বাঁক সৃষ্টি হয়েছিল রামপুর বোয়ালিয়া অর্থাৎ
রাজশাহীর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কবিবন্ধু লেকেন্দ্রনাথ পালিতের বাসায় আগমনের
পর। মতাধরদের পদতলে নিষ্পেষিত, নিয়তিনির্ভর মানুষের কাছে এসে/যারা ‘নাহি
জানে কারদ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে, দরিদ্রের ভগবানে বারেক ডাকিয়া
দীর্ঘশ্বাসে। মরে সে নীরবে।’ (এবার ফিরাও মোরে, রামপুর বোয়ালিয়া, ২৩শে
ফালগুন, ১৩০০ বঙ্গাব্দ) অনেকেই মনে করেন, এটি রবীন্দ্র কবিজীবনের
সর্বশ্রেষ্ঠ বাঁক। তিনি মনুষ্যত্বের নিদারুণ অপমান স্বচে অবলোকন করে তাদের
মধ্যে পৌরুষ উজ্জীবনের পথে অগ্রসর হন। ১৩০২ বঙ্গাব্দে ‘বিদ্যাসাগর চরিত’
রচনাকালে তাই তিনি তাঁর ‘অজেয় পৌরুষ’ আর ‘অয় মনুষ্যত্বের’ উদাহরণ খুঁজে
পান।
অবদমিত চেতনার মধ্যে মনুষ্যত্বের প্রভা উজ্জীবনের উদ্দেশ্যে একালে
তিনি পত্রপত্রিকায় বিশেষ করে ‘বঙ্গদর্শনে’ অনেক রচনা প্রকাশ করেন। যা ছিল
তাঁর চেখে দেখা অভিজ্ঞতার ফসল। ‘আত্মশক্তি’ নাম দিয়ে এতদসম্পর্কিত একটি
গ্রন্থ প্রকাশ করেন ১৩২২ বঙ্গাব্দে। এ যেন ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতার
দিকনির্দেশনার সরল ব্যাখ্যা। পরাধীনতা ও পরনির্ভরশীলতা মানবচরিত্রে ‘পৌরুষ’
কিংবা ‘মনুষ্যত্ব’ বিকাশে বিঘœ ঘটায়। রবীন্দ্রনাথ তা অভ্রান্তভাবে জানতেন।
চিত্রার পর ‘কল্পনা’তে তিনি শুধু কল্পলোক বিহার করলেন না, এই যে মানবসৃষ্ট
মনুষ্যত্বের অবমাননা, তা থেকে মুক্তির জন্য অবহেলিত ম্রিয়মাণ মানুষের
মধ্যে পূর্ণ মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে লিখলেন ‘হতভাগ্যের গান’।
ঘোষণা করলেন, ‘হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।’ একই কাব্যের
‘জন্মদিনের গান’ কবিতায় প্রার্থনা জানালেন : ‘ভয় হতে তব অভয়মাঝারে/নতুন
জন্ম দাও হে।/দীনতা হইতে অয় ধনে,/সংশয় হতে সত্যসদনে,/জড়তা হইতে নবীন
জীবনে/নতুন জনম দাও হে।’ ‘কালান্তর’ রচনাকালের লেখায় আমরা ল্য করব। কিভাবে
মনুষ্যত্বের জাগৃতির ফলে আমরা মনুষ্যপদবাদ্য হয়ে উঠতে পারি, তার ঋদ্ধ
প্রকাশ।
আবার আমরা ফিরে আসি এই বাংলায় শিলাইদহ, পতিসর, শাহজাদপুরে। দেখা
যাবে ‘এবার ফিরাও মোরে’ ভাবনার রেশ কাটেনি কবির। আত্মভোলা, অবনমিত,
পৌরুষহীন বাংলার মানুষ যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে সে জন্য ‘বঙ্গমাতা’
কবিতায় আবেদনের সুরে জন্মভূমিকে জানালেন : ‘মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে।’
উল্লেখ্য, একালে বিদ্যাসাগরের তিরোধানের বেদনার ছায়া কলকাতার সাংস্কৃতিক
অঙ্গনকে ভাবিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথ সে ভাবনাকে আত্মস্থ করেছিলেন বলে
গীতাঞ্জলির চতুর্থসংখ্যক কবিতায় বলতে পারলেন : ‘আমারে তুমি করিবে ত্রাণ/এ
নহে মোর প্রার্থনা/ তরিতে পারি শকতি যেন রয়।’ ওই কাব্যেই ১১৯ সংখ্যক কবিতায়
সেই সংকল্প কার্যকর করার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন : ‘রাখোরে ধ্যান থাকরে
ফুলের ডালি,/ছিঁড়ুক বস্ত্র, লাগুগ ধুলাবালি,/ কর্মযোগে তাঁর সাথে এক হয়ে/
ঘাম পড়ুক ঝরে।’ বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, কর্মযোগের ভেতর দিয়ে মনুষ্যত্ব
অর্জনের পথকে, রবীন্দ্রনাথ কত গুরুত্ব দিতেন।
আমরা রবীন্দ্র স্মরণোৎসবে
ললিত শিল্পকলাকে প্রাধান্য দিই। নাচ-গান, বক্তৃতা শেষে কোনো সংকল্প ধারণ
না করে ঘরে ফিরি। ওই যে ‘আত্মশক্তি’ রচনার যুগে কিংবা ইউরোপে ভ্রমণকালে
মনুষ্যত্ব অর্জনের জন্য কবি আত্মনির্ভর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, শুধু
পরামর্শই নয়, পূর্ব বাংলায় এসে প্রথমে শিলাইদহ-পতিসর এবং শেষ জীবন পর্যন্ত
ভুবনডাঙ্গার শান্তিনিকেতনে আত্মকর্মসংস্থানের শিার প্রবর্তন করেন। তাঁর
বিশ্বাস ছিল স্বনির্ভর হতে পারলেই দীপ্ত পৌরুষ নিয়ে চলা যায়।
আজকের দিনে
সব জায়গায় রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজন হয়। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায়ও হতো। তবে
আলোকসজ্জা করে চার দেয়ালের ভেতরের চেয়ে বাইরের প্রকৃতির উন্মুক্ত কোলের
অনুষ্ঠানকে বেশি ভালোবাসতেন কবি। ‘সেঁজুতি’ কাব্যে তার প্রমাণ আছে।
ভুল
বোঝার অবকাশ নেই যে ললিতকলাকে আমরা খাটো করে দেখছি। রবীন্দ্রসৃষ্টিধারা
জ্ঞাতসময়ের সেরা সম্পদ। তিনি তো বলেছেনই, ‘গানের ভেতর দিয়ে যখন দেখি
ভুবনখানি’ তখন তারেই চেনা যায় না, সবার সাথে ‘কানাকানি’ও হয়। তিনি বর
মাগেন, ‘মরণ হতে যেন জাগি/গানের সুরে।’ বলে। সুতরাং গান থাকবেই। তবে সে গান
যেন আত্মনিবেদনের সঙ্গে আত্মনির্ভরতা শেখায়। তোষামোদের অঞ্জলি দিয়ে
পদ-পদবি না বাগায়।
গান মানুষের সুকুমার চেতনার সর্বোত্তম মাধ্যম।
রবীন্দ্রনাথ গানের ওপরে সুরের প্রাধান্য দিয়েছেন। বলেছেন : ‘গান দিয়ে যার
নাগাল নাহি পাই/ সুর দিয়ে তার চরণ ছুঁয়ে যাই।’ আর এই সুর হবে উন্নত
মস্তকের। পৌরুষদীপ্ত মনুষ্যত্বের। যা কবি বিদ্যাসাগর চরিত্রে প্রত্য
করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের সমাজ-সংস্কৃতির সময় আমরা পার হয়ে এসেছি। আমাদের
শাসিত হওয়ার ধরন পাল্টেছে বাঁকে বাঁকে। তবে মননধর্মের চারিত্র বদল হয়নি।
অথচ আমরা দৃঢ়চিত্ত মানবকল্যাণী হয়ে উঠলাম কই? শুধু তাঁর নামে প্রতিষ্ঠান
গড়া হলেই কী দায়িত্ব শেষ! নাকি ‘যথার্থ মানুষ’ গড়ার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।’
আমরা
রবীন্দ্রস্মরণ-কথন শুরু করেছিলাম বিদ্যাসাগরের মতো যথার্থ মানুষের
রবীন্দ্র আবাহন দিয়ে। আজকের করোনা প্রভাবিত ‘দারুণ অগ্নিবাণে’ যখন ‘ভূতলের
স্বর্গখ-গুলি’ তছনছ হওয়ার উপক্রম, তখন মানবকল্যাণে রবীন্দ্র কথিত যথার্থ
মানুষের সামর্থ্য নিয়ে সবার এগিয়ে আসা উচিত।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ