মীর আব্দুল আলীম । ।
বিশ্বের কোথাও কেউ ভালো নেই; সবার মাঝেই মৃত্যু আতংক। সুখে নেই কেউ। সুখ কেবল করোনার এখন। সুদিন ভেবে করোনা দাবড়ে বেড়াচ্ছে বিশ্বজুড়ে। কি ধনী, কি গরিব দেশগুলোর ব্যবসা বাণিজ্যের চাকা অচল করে নোভেল করোনা-১৯ এখন বহাল তবিয়তে।
চারদিকে মানুষের কেবল দুঃসংবাদ। ফেসবুকে অসতর্ক মানুষের খবর, স্বজন হারানো আহাজারী আর মৃত্যুর খবর পত্রিকা জুড়ে। ভালো খবর যেন আর নেই কোথাও। পরিচিত জনরা ফোন করে মা চায়, আক্রান্ত হবার খবর জানার। নিকটের মানুষ অনেক মারা যাচ্ছে। এ অবস্থায় কখনো মায়ের, কখনো বাবার, কখনো সন্তান, স্ত্রী কিংবা পছন্দের চেহারা গুলো সামনে আসে। ডাক্তার ছেলে মেয়ের ভয়েতো আমি সবসময় কুঁকড়ে থাকি। স্ত্রী ঘেন ঘেন করেন হাসপাতালে না যেতে। ওদের কথা এসময় কি আমরা ঘরে থাকতে পারি? আমিও ভয় পাই, আবার ওদের মানব প্রেমে গর্বিত হই। এমন সন্তানইতো চাই আমি। বাহিরে এতো রুগী, ওরা কেন ঘওে বসে থাকবে? আমিওতো ঘরে থাকতে পারিনা। একটি হাসপাতালের চেয়ারম্যান হিসাবে ঘরে থাকা যায় না। সব কিছু মিলিয়ে এ অবস্থায় কি আর ভালো আছি কেউ। করোনা দাপটে তবু আলহামদুলিল্লাহ ভালোইতো আছি, বেঁচেতো আছি এখনও। এইতো বেশ।
দেশে কোভিড সংক্রমণের হার গত বৎসরের তুলনায় অনেক বেশি, প্রতি দিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড ভেঙ্গে চলছে। মৃত্যুসংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। তবে জনজীবনে আতঙ্কের ভাব গত বৎসরের তুলনায় অনেক কম। অনেক জায়গাতেই মানুষ অনেকটা স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। অথচ নিকট কোলকাতা পশ্চিমবঙ্গে অতিমারি করোনা ভারতীয় মানচিত্রে বিপদসঙ্কেত জ্বলছে। অনবরত শ্মশানে লাশ পুড়ছে। অস্থায়ী শ্মশান তৈরি করে লাশ পোড়ানো হচ্ছে সেখানে। পড়ে থাকা লাশ টেনে ছিড়ে খাচ্ছে কুকুর । এ দৃশ্য সবাই দেখছে টিভি পত্রিকায়, তবুও মানুষ সৃষ্টিকর্তার উপর নিজেকে অর্পণ করে সম্পূর্ণ বেপরোয়া ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমাদের দেশেও ভ্যাকু (এস্ককেভেটার) দিয়ে আগাম কবর খোঁড়া হচ্ছে। আর সেই ছবিও বাংলাদেশের অনেক পত্রিকায় দেখেছি। পত্রিকায় এও দেখছি লকডাউনে রাস্তায় যানজট। বাজারে মানুষের জটলা। ঈদ কেনা কাটার ধুম পরেছে। জনসমাগম সবখানেই হচ্ছে। তারাবী আর জুমার নামাজে হাজার হাজার মানুষ। মানুষের হুঁশ নেই। অসভ্যতারতো একটা সীমা থাকা চাই। সরকার লকডাউন দিয়েছে। লকডাউনে দেশটা কি আর লক আছে? রাস্তা যানজট সেই আগের মতই। আমরা মোটেও সতর্ক নই। চারদিকে যখন মৃত্যুর সংবাদ। রাস্তা ঘাটে তখন যদি হাজারো মানুষের ভিড় দেখি, রাজনৈতিক মিছিল দেখি, পত্রিকায় মারামারি হানাহানি র খবর দেখি তখন হোঁচট আর দিলে চোটতো পাইনি। যখন জনগনকে স্বাস্থ্য বিধি না মেনে মাস্কহীন চলাফেরা করতে দেখি, বলতে শুনি- ‘দেশে তো করুনাই নাই’। আবার কেউ বলেন- ‘সরকার তো হুদাই লকডাউন দিছে’ নির্বোধ মানুষ বলে কি? এমন সব কথা আর কাজে তখনতো হতভাগা হই বটে।
আমাদের দেশে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ে দৈনিক আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দুটিই অনেক বেশি। আবার তৃতিয় ঢেউয়ের কথাও শুনছি। প্রথম ঢেউয়ে দৈনিক সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিল ৬৪ জন, আর দ্বিতীয় ঢেউয়ে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে শতাধিক। আমাদের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশেরও একই অবস্থা। ভারতে দৈনিক সংক্রমণ ছাড়িয়েছে তিন লাখ, আবার দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়েছে তিন হাজার। এ অবস্থায় কি ভারত কি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি উপো করার যে প্রবণতা দেখা যায়, তা আরো ভয়াবহ সংকটেরই আভাস দেয়।
আমাদের দেশে মৃত্যুর মিছিলে একে একে যোগ হয়েছে ১১ হাজার ৭শ’ ৯৬ জনের নাম। আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৭লাখ ৬৯ হাজার মানুষ। চিকিৎসক, রাজনীতিক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী, সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীসহ এমন কোন পেশা নেই যাদের নাম নেই মুত্যুর তালিকায়। এক একটি মানুষের মৃত্যু এক একটি পরিবারে অসীম শূন্যতা। সীমাহীন শোক। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে হারিয়ে বড় শূন্যতায় পড়েছে এক একটি খাত। দিন দিন ভারি হচ্ছে শোকাতুর মানুষের কান্না। দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। শোকাহত পুরো জাতি। গত বছরের ৮ই মার্চ দেশে যখন করোনাভাইরাস হানা দিয়েছিল তখন কে জানতো তা এতটা আগ্রাসী আর প্রাণঘাতী হবে। বছরের শেষে যখন প্রকোপ কমে আসে তখন কে ভেবেছে তা আরো আগ্রাসী রূপ নিয়ে হানা দেবে দ্বিতীয় দফায়। এখন প্রতিদিনই করোনা কেড়ে নিচ্ছে প্রায় শতাধিক প্রাণ। জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে হাজারো মানুষ। প্রিয়জনকে বাঁচানোর যুদ্ধে হাজার হাজার স্বজনের বিনিদ্র দিন কাটছে হাসপাতালে। হাসপাতাল, শয্যা খুঁজে পেতে মানুষের দৌড়ঝাঁপ। জীবন বাঁচানোর প্রাণান্ত যুদ্ধের মধ্যেই হেরে যাচ্ছেন অনেকে। অনন্ত অসীমের পথে তাদের যাত্রায় শোকে পাথর হচ্ছেন স্বজনরা।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারির বড় ধরনের আঘাত থেকে রা পেতে টিকার চেয়েও বেশি জরুরি হচ্ছে ব্যক্তিগত সচেতনতা, যেমন মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়াসহ জরুরি স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলা। কিন্তু লকডাউনের ঘোষণা হতে না হতেই মানুষ যেভাবে গাদাগাদি করে ঢাকা ছেড়েছে, যেভাবে হাট-বাজারে ভিড় করেছে তাতে সেই সচেতনতার অভাব খুবই প্রকট ছিল। এখনই হাসপাতালগুলোতে রোগীদের ঠাঁই হচ্ছে না। আইসিইউ শয্যা খালি পাওয়া যাচ্ছে না। ইচ্ছা করলেই নতুন নতুন হাসপাতাল বানানো যাবে না। কারণ আমাদের চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ানের অভাব আছে। তাহলে যেভাবে প্রতিদিন রোগী বাড়ছে, তারা চিকিৎসা পাবে কোথায়? তারা কি বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে? পরিস্থিতি যাতে সেদিকে না যায়, সে জন্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কমপে দুই সপ্তাহের পরিপূর্ণ লকডাউন চেয়েছিলেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রয়োজন হলে আরো বাড়াতে বলেছিলেন। কিন্তু সরকার লকডাউন দিয়েছে। তা-ও পরিপূর্ণ নয়। গার্মেন্ট, কলকারখানা খোলা রাখা হয়েছে। গণপরিবহন, মার্কেটও খোলা। তাহলে করোনা মহামারি কিভাবে ঠেকানো যাবে? বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন অবহেলা ও উদাসীনতা হবে দলবদ্ধ আত্মহত্যারই শামিল।
করোনা ভাইরাস আমাদের জীবন ও জীবিকার ইস্যুতে তালগোল পাকিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সরকার জীবিকাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে আগে তো জীবন।’ প্রধানমন্ত্রীর কথার সত্যতা ও যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না। জীবিকার কথা না ভেবে জীবনের কথা ভেবে সরকার দীর্ঘ লকডাউনে যেতে বাধ্য হয়েছে। বাস্তবে যে অবস্থা, তাতে সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা দুটোই বিপন্ন। সরকার জনগণকে ‘একটু’ কষ্ট করতে বলেছে এই দুর্যোগের সময়ে। কার্যত, একটু নয়- ‘অনেক’ কষ্ট করতে হচ্ছে গণমানুষকে। জীবিকা বন্ধ হয়ে অনেকের জীবন সঙ্কটাপন্ন হচ্ছে। যার কষ্ট, তিনি এর যাতনা বোধ করেন বেশি। লকডাউনে মিরপুর থেকে গুলশান কিংবা বাসাবো হতে রামপুরায় হেঁটে গিয়ে কাজ করার কষ্ট কেমন, তা বলে দিতে হয় না। তবু জীবন আগে। আমাদের শতর্ক হতেই হবে।
মনে রাখতে হবে, করোনায় করুণা করছে না কাউকে। মানুষ মরছে প্রতিদিন। আমাদের সবসময় প্রস্তুত থাকা দরকার। আসলে আমরা কতটা প্রস্তুত? আর কতটা সতর্ক? সতর্কতা খুবই কম। রাজধানীকেন্দ্রিক প্রস্তুতি থাকলেও জেলা কিংবা উপজেলা পর্যায়ে প্রস্তুতি তেমন চোখে পড়ে না। আমাদের জনবল খুব কম। স্বাস্থ্য সরঞ্জামও কম। ভেন্টিলেটর, আইসিও, হাইফো অক্সিজেনের অপর্যাপ্ততা রয়েছে। করোনাভাইরাস ভারতের মতো ছড়িয়ে পড়লে তাতে সামাল দেয়া কঠিনই হবে। আমাদের জনগণও সচেতন নয়। একবার করোনা ভাইরাসের ভারতীয় ভাইরেন্ট ছড়িয়ে পড়া শুরু করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এজন্য আগেভাগেই জনগণকে সচেতন করে তুলতে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সতর্কীকরণ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা দরকার। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ সবখানে জনগণকে করোনাভাইরাসের হাত থেকে রায় করণীয় সম্পর্কে বোঝাতে হবে।
সারা বিশ্ব যেখানে সতর্ক সেখানে আমাদের দেশে সবকিছু অনেকটা স্বাভাবিক। পরে হয়তো বুঝতে পারব কতটা তি হলো আমাদের। হচ্ছেইতো। সরকারী হিসাবই দিনে মৃত্যু একশ ছাড়িয়েছে। প্রকৃত হিসাবে মৃত্যু আরও অনেক বেশি। আল্লাহ মাফ করুক। একটা কথা মনে রাখতে হবে সার্স, মার্স, ডেঙ্গু বা ইবোলার মতো নানা ধরনের প্রাণঘাতী ভাইরাসের কথা আমরা জানি। এমন মহাবিপদ থেকে আল্লাহ আমাদের উদ্ধারও করেন। বিভিন্ন ধর্মেও রোগের েেত্র সতর্ক করা আছে। আল-কোরআনে মহামারি হলে যে যার স্থানে থাকার কথা বলা আছে। তাই প্রয়োজন না হলে ক’দিন না হয় নিজের জীবনের জন্য; স্বজনদেও জীবনের জন্য ঘর থেকে অতি প্রয়োজন ছাড়া নাইবা বের হলেন। প্রয়োজন থাকলে কী আর করা। মাস্ক পওে স্বাস্থ্যবিধী মেনে ঘর থেকে বের হউন। মনে রাখবেন এ সমস্যা কিন্তু অনেক দিন ধরেই থাকবে না। আল্লাহ আমাদের রা করবেনই। কিছুদিন যারা সতর্ক থাকতে পারবেন, সবকিছু ঠিকঠাক মেনে চলবেন তারা হয়তো এ বিপদ থেকে অনেকটা মুক্ত থাকতে পারবেন। তবে আমারা বেশিই অসাবধান মনে হয়। কোন কিছুকেই গুরুত্ব দিতে চাই না কখনো। কোনো কিছু মানতে চাই না। আল্লাহ আমাদের রা করলেই চলে।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের এখন যুদ্ধে নামতে হবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। ঘুরতে না যাওয়া, বেশি মানুষ এক জায়গায় না হওয়া, আড্ডাবাজি বন্ধ করতে হবে। করোনা নামক শত্রু এদেশে ঢুকে পড়েছে। ক্ষতিও বেশ করেছে। জীবন গেছে অনেকের। দেশের অর্থনীিিততে করোনার ব্যাপক প্রভাব পরেছে। অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে বেকার হয়ে পরেছে। এ অবস্থায় সবাই সতর্কতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে না পড়লে আমরা হয়তো এই যুদ্ধে এক বারে হেরে যাব। আসুন আমরা সবাই সতর্কতার যুদ্ধে নামি। এ যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। পাশের দেশ ভারত থেকে কিন্তু আমাদেও শিক্ষা নিতে হবে। তবে যুদ্ধ জয়ের জন্য আমরা আতঙ্কগ্রস্ত হলে চলবে না। দিশেহারা হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করার পাশাপাশি ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিকভাবে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সর্বদা বজায় রাখতে হবে। নিজে সতর্ক থাকতে হবে অপরকে সতর্ক করতে হবে। ভাইরাস থেকে রার একটাই পথ সতর্কতা। সব ভয়কেই দুরে সরিয়ে নির্ভয়ের, নিরাপদের বাংলাদেশ গড়তেই হবে আমাদের।
নোভেল করোনার মতো, বিদ্বেষ ও কুরুচির এই ভয়াবহ ব্যাধির প্রতিরোধে শেষ অবধি ভরসা নাগরিকের শুভবুদ্ধি এবং তা প্রয়োগের উদ্যম।, সকলের শুভবুদ্ধি জাগ্রত হউক, এই বিপদের মোকাবিলায় সমস্ত প্রকারে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন সম্পর্কে সমাজের প্রতিটি মানুষ সচেতন হউক। বাঙালি ইতিহাসে বহু বিপদ অতিক্রম করেছে, এই বিপদও সে জয় করার সামর্থ্য রাখে বলে আমরা বিশ^স করি। করোনা প্রতিকার ও নিরাময়ের প্রবল উদ্যোগ না নিলে এবং জনগন সচেতন না হলে এই ব্যাধি দ্রুত বাড়বে এবং সমাজকে উত্তরোত্তর গ্রাস করবে, প্রাণহানী হবে; দেশ অর্থনৈতিক ভাবে গ্রতিগ্রস্ত হবে তাতে কিছুমাত্র সংশয় নাই।
লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]