ডা. জাহেদ উর রহমান ||
মারুফ
আমাদের শিশু না। ‘আমাদের’ মানে আমরা যারা পেটের ভাত, পরনের কাপড় আর মাথার
ওপরের একটা ছাদের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে পত্রিকার কলামে কিংবা ফেসবুকে
নীতি কথা কপচাই। মারুফ এই দেশের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো অসংখ্য ছিন্নমূল
শিশুর একটি, রেগে গেলে আমরা যাদের বলি ‘ফকিন্নির পুত’।
বিখ্যাত শিল্পী
রফিকুন নবী (যিনি রণবী নামেই অনেক বেশি পরিচিত) এদেরই নাম দিয়েছিলেন টোকাই।
অবশ্য এটা শব্দ নিয়ে ‘কচকচানির’ কাল, তাই শব্দটা আমাদের ভালো লাগেনি খুব
একটা। আমরা তাদের পথশিশু বলি। আর ‘কবি’ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তো এদের
দিয়েছিলেন আরও কাব্যিক নাম পথকলি।
মারুফ কিছু দিন আগে ভাইরাল হলো।
আমাদের স্মৃতিতে নিশ্চয়ই তরতাজা হয়ে আছে এখনও একটা টিভি রিপোর্টিংয়ের
মাইক্রোফোনের পাশে দাঁড়িয়ে একরকম অযাচিতভাবে বলে ফেলা কথাগুলো – ‘আচ্ছা এই
যে লকডাউন দিয়েছে, সামনে ঈদ মানুষ খাবে কী। এই মাননীয় মন্ত্রী একটা লকডাউন
দিয়েছে, এইটা ভুয়া। থ্যাংক ইউ।’
এই ইনফরমেশন ওভারলোডের যুগে অসংখ্য তথ্য
এসে খুব দ্রুত আরেকটি তথ্যকে আমাদের মনোযোগ থেকে সরিয়ে দেয়। মারুফের এই
ভিডিওটি খুব দ্রুতই হয়তো সরে যেত। কিন্তু মারুফ আলোচনায় থাকে। কেউ একজন
তাকে খুঁজে বের করে এবং তার আপডেট আমাদের জানাতে থাকে। ক্যামেরার সামনে
অযাচিতভাবে এমন কথা বলার অপরাধে মারুফকে পেটানো হয়, মার খেয়ে ফুলে ওঠা
চোখসহ মারুফের ছবি আমরা দেখি। মারুফের গল্প এগিয়ে চলে, মারুফ আমাদের
আলোচনায় থেকে যায় আরও।
এরপর আমাদের জানানো হয় মারুফ একজন নেশাসক্ত শিশু।
সে ‘ডান্ডি’ তে আসক্ত। একজন নেশাসক্ত শিশুর বক্তব্যকে আদৌ গুরুত্ব দেওয়ার
কিছু নেই, এমন কথা বলে অনেকেই। মারুফকে দিয়ে আসলে ডান্ডির কাছে পৌঁছতে
চেয়েছি আমি। আচ্ছা ‘ডান্ডি’ বস্তুটা কি চিনি আমরা?
‘রাগবি বয়’ কারা?
সুনির্দিষ্টভাবে এই প্রশ্নের জবাব কারও জানা না থাকলে অনুমান করে হয়তো
অনেকে ভাববেন এটা রাগবি খেলার একটা দল বা কাব। আসলে সেটা নয়। এই রাগবি
হচ্ছে ফিলিপাইনের একটা আঠা কোম্পানির ব্র্যান্ডের নাম। ফিলিপাইনের রাজধানী
ম্যানিলার রাস্তায় বেড়ে ওঠা অসংখ্য ছিন্নমূল শিশুকে ‘রাগবি বয়’ নামে ডাকা
হয়। কারণ, এরা রাগবি ব্র্যান্ডের আঠা শুঁকে নেশা করে। আমরা যারা জানি না
তাদের বলে রাখি এটাই আসলে ডান্ডি।
নেশার ভেতর ছিন্নমূল শিশুরা খুব আনন্দ
খুঁজে বেড়ায়, তা নয়। মগজে খুব উচ্চমাত্রায় ডোপামিন থাকলে ুধার অনুভূতি কম
হয়। এ কারণেই তারা এই নেশায় ডুবে যায়। ঠিক এখানে এসেই এক হয়ে যায় ম্যানিলার
রাস্তার ছিন্নমূল শিশুরা আর ঢাকার রাস্তার ‘ফকিন্নির পুতেরা’। সত্যিই ুধা
ভীষণ বড় বালাই।
ঢাকার রাস্তায় অসংখ্য শিশুর হাতে এই পলিথিন ঠোঙা
(ডান্ডি) দেখা যায়। বছরের পর বছর দেখেছি আমি। এখনও দেখি, সংখ্যাটা বাড়ে
প্রতিনিয়ত। আমাদের অনেকেরই হয়তো চোখে পড়ে না অথবা চোখে পড়লেও আমরা বুঝি না।
হয়তো ওদের প্রতি আমাদের ন্যূনতম কৌতূহলও নেই, তাই আমরা খোঁজ নিতে চেষ্টা
করি না এটা নিয়ে।
কোকেন আমাদের মগজে যে জায়গাটায় কাজ করে টলুইন ( ডান্ডি
তৈরির মূল উপাদান) কাজ করে ঠিক সেই জায়গায়। আর সব মাদকের মতো সাময়িক কিছু
আনন্দময় প্রভাবের সঙ্গে সঙ্গে এটি খুব দ্রুতই মানুষকে আসক্ত করে তোলে।
আসক্তি মানে এটা না নিলে আর স্বাভাবিক থাকা যায় না।
খুব বেশি টেকনিক্যাল
আলোচনায় ভারাক্রান্ত করতে চাইছি না লেখাটি, তাই মানব দেহের ওপর টলুইনের
প্রভাব নিয়ে কয়েকটি কথা বলে রাখা যাক। একজন আসক্ত যখন ক্রমাগত তার
নিশ্বাসের সঙ্গে টলুইন নিতে থাকে তখন সেটার তাৎণিক সাইডএফেক্ট হিসেবে দেখা
যায় অরুচি, বমি বমি ভাব, ঘুম না হওয়া, কোনও কিছু মনে করতে না পারা,
হাঁটাচলা এবং শারীরিক অন্যান্য পরিশ্রমের েেত্র সমন্বয়হীনতা। এর
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হিসেবে ফুসফুস, হৃদপি-, কিডনি, লিভার এবং মস্তিষ্কে
স্থায়ী তি হয়। প্রত্যেকটি অঙ্গের কাজ করার মতা কমতে থাকে দ্রুত। মস্তিষ্কের
আকার কমে যায়। দীর্ঘমেয়াদে একটা মানুষ একেবারে অম, অথর্ব হয়ে পড়তে পারে।
কোমায় চলে যেতে পারে, এমনকি মারা যেতে পারে।
অন্য সব নেশার েেত্র যা হয়,
দীর্ঘমেয়াদে এই নেশায় ততটা ‘হাই’ হয় না, যেতে হয় বস্তুর উচ্চমাত্রায় এবং
তারপর নতুন কোনও নেশার বস্তুর সন্ধানে। অর্থাৎ ডান্ডি আসক্ত শিশুরাই কিছু
দিন পর ইয়াবা, হেরোইনসহ অন্যান্য মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ একেবারে শিশু
বয়স থেকে ল ল মানুষ সারা জীবনের জন্য নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে আমাদের এই
সমাজে।
আমি জানি না এসব শিশু এমন ভয়ংকর বিপদের মুখে আছে দেখেও আমাদের
আদৌ কোনও ভাবান্তর হবে কিনা। তবে ওদের এই পথে যাওয়া আমাদের জন্যও তৈরি করছে
মহাবিপদ। এই নেশাসক্ত শিশু এখন তো বটেই ভবিষ্যতে আরও বহুকাল এই সমাজে নানা
অপরাধের সঙ্গে জড়িত হবে। আমরা শিশুদের নিয়ে কোনও সিরিয়াস কাজ করিনি,
কিন্তু ফিলিপাইনে ঠিকই হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে ‘রাগবি বয়’ রা চুরি,
ছিনতাই, ডাকাতি, মাদক পরিবহন/ব্যবসা, সাধারণ মারামারি থেকে খুনোখুনি
পর্যন্ত নানা রকম অপরাধের সঙ্গে জড়িত। আমাদের শহরে এর অন্যথা হওয়ার তো কোনও
যুক্তি নেই। ফিলিপাইনে তো অন্তত এটাকে একটা বড় সমস্যা হিসেবে স্বীকার
করেছে, আমরা তো নেই তার কাছাকাছিও।
এই শহরের ল ল শিশু এই বীভৎস বিপদের
মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘকাল থেকে। তাতে আমাদের কি কিছু আসে যায়? আমরা যারা
‘সচেতন নাগরিক’ তাদের শিশুরা অন্তত এখনও এই নেশায় আসক্ত হতে শুরু করেনি।
তাই আমরা এটা নিয়ে সামান্য কথাও বলি না, শোরগোল তৈরি করা দূরেই থাকুক।
রোজায় কয়েকজন রাস্তার শিশুকে ডেকে ইফতার করিয়ে, ঈদের সময় কয়েকজনকে কিছু
নতুন জামা কাপড় দিয়ে সেটার ছবি তুলে নিজে কিছু আত্মপ্রসাদ লাভ করে, আর সেই
ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে মানবিকতার জন্য প্রশংসিত হওয়া পর্যন্তই দৌড় আমাদের।
শুরুতেই বলেছিলাম ওরা আমাদের শিশু না। তাই এই রাষ্ট্র কোনোকালেই মাথা ঘামায়নি ওদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট