দুই পা হারিয়েও হারেননি মোজাম্মেল
Published : Saturday, 12 June, 2021 at 12:00 AM
পা
দুটি হারিয়েছেন প্রায় ১০ বছর আগে। নিজের পা ঠিক করার শিক্ষা না থাকলেও
অন্যের নষ্ট হওয়া বাহনটি নিঁখুতভাবে সারিয়ে দেয়ার শিক্ষা ঠিকই রপ্ত করেছেন
মোজাম্মেল হক (৬৭)। দুই পায়ে ৬ বার অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে
পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় পা হারানোর পাশাপাশি হারিয়ে ফেলেন শ্রবণ শক্তিও।
এতকিছুর
পরও দমেনি মোজাম্মেল। যৌবনকালে টগবগে শরীরে অদম্য তেজ, শক্তি আর অসীম
সাহসের কারণে গ্রামের মানুষ তার নাম দিয়েছিলেন ‘মেইল’। সেই মেইল এখন অচল
পায়ে সচল কোমরে বস্তা বেঁধে সাইকেল ও ভ্যান মেরামতের কাজ করেন।
দুই পা ও
শ্রবণহীন মোজাম্মেল হকের দোকানে আসা গ্রাহকরা উচ্চস্বরে বা কাগজের মধ্যে
সমস্যার কথা লিখে দিলে সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের সাইকেল ও ভ্যান মেরামত করে
দেয় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। সেবা নিয়ে হাসিমুখেই ফেরেন সাইকেল বা ভ্যান মেরামত
করতে আসা লোকজন।
পা হারিয়েও স্ত্রী-সন্তানদের কাছে বোঝা হতে চাননি বলে
তিনি এখনও তার শক্ত দু’হাত দিয়ে হাতুড়ি-রেঞ্জ ঘুরিয়ে নিজের জীবনের মোড়
ঘোরানো অদম্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আশপাশের দোকানদাররা জানান, ডান
পায়ের আঙ্গুলে ছোট্ট একটি ঘা থেকে পা কাটা শুরু মোজাম্মেলের। দুই বছরের
মধ্যে বাম পা কাটতে হয়। ৬ বারে একটু একটু করে পা কাটতে কাটতে তাকে দুই পা
কোমর সামান্য নিচ পর্যন্ত কাটতে হয়েছে। পা কেটে ফেলার দুই বছর পর হারিয়েছেন
শ্রবণ শক্তিও। তাতে কি দমে যাওয়ার পাত্র তো মোজাম্মেল নয়। ১০ বছর ধরে
এভাবেই চালিরে যাচ্ছেন জীবনযুদ্ধ।
মোজাম্মেলের বাড়ি দিনাজপুরের বিরামপুর
উপজেলার বিনাইল ইউনিয়নের কুন্দর গ্রামে। গ্রামের পাশেই কুন্দন বাজার।
সেখানেই রিকশা-ভ্যান, সাইকেল সারানোর কাজ করেন তিনি।
রাস্তার পাশে একটি
মাটির ঘরের মোজাম্মেলের দোকান। দোকানে কয়েকটা হাতুড়ি রেঞ্জ, আর শ দুয়েক
টাকার মালপত্র। গায়ে কোনো জামা-কাপুড় নেই তার। সাদা একটি প্লাস্টিকের বস্তা
কোমরে পেচিয়ে বসে হাতে ভর দিয়ে আসেন মোজাম্মেল। দূর থেকে দেখলে মনে হবে
তিনি স্বাভাবিত একটি মানুষ।
বারান্দার নিচে বসে কথা হয় মোজাম্মেলের সঙ্গে। তিনি গলায় চেচিয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘জোরে কও মুই শুনবার পার না। মুই বয়রা।’
পায়ের
এমন চিত্র ঈশারায় দেখিয়ে দিলে একটি অট্টহাসি দিয়ে মোজাম্মেল বলেন, ‘কাটি
ফেলাইচু, ঘাঁও হয়চিল। মোর কপাল বলেই, আপন মনে ভ্যানের চাকা সারানো কাজে
লেগে পড়েন তিনি।’
দোকানের এ অবস্থার কথা জানতে চাইলে মোজাম্মেল হক বলেন,
‘পায়ের চিকিৎসা করি টাকা খরচ করি ফালাইচু ন। টাকার অভাবত দোকানে মালপত্র
কিনিবা পারছ না। গোটাদিন কাম করি দুই আড়াই হাজার টাকা হয়, এই টাকা দিয়া
হেনে অভাবের সংসার।’
স্থানীয় হাসেম আলী নামের এক ব্যক্তি বলেন,
‘পৈত্রিকসূত্রে যৎসামান্য যে জমি পেয়েছিলেন তা ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ভাগ করে
দিয়েছেন। এখন মাটির নড়বড়ে ঘরেই স্ত্রীকে নিয়ে চলছে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর
সংসার।’
তিনি বলেন, ‘যৌবনকালে মোজাম্মেল হকের টগবগে শরীরে অদম্য তেজ,
শক্তি আর অসীম সাহসের কারণে গ্রামের মানুষ তার নাম দিয়েছিলেন- ‘মেইল’।
গ্রামের ছোটবড় সবাই তাকে ওই নামেই ডাকেন। ছুটে চলার দূরন্ত পা হারিয়ে
মোজাম্মেল হকের শরীরে আগের সেই তেজ ও শক্তি না থাকলেও মনের মধ্যে রয়েছে
তীব্র সাহস।’
‘আর এ সাহসের কারণেই তিনি ভেঙে পড়েননি এবং কারও মুখাপেক্ষী
হননি। সেই থেকে পায়ের বদলে তার শক্ত দুই হাতের উপর ভর করে জীবন ও জীবিকার
তাগিদে ঘুড়ে দাঁড়িয়েছেন মোজাম্মেল হক।’
মোজাম্মেল হকের দোকানে
মেরামত করতে আসা দেশমা গ্রামের ভ্যানচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘদিন
থেকে আমি এখানে এসে ভ্যানের ক্রটি হলে সারিয়ে নিয়ে যাই। মোজাম্মেল হক ভালো
কাজ জানে। পা না থাকলেও হাতে তার অনেক শক্তি। স্থানীয় অনেকেই এসে তার
দোকানে ভ্যানের কাজ করি আমরা।’
কুন্দন গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল ইসলাম
রিপন বলেন, ‘গ্রামের মানুষের কাছে মেইল ভাই একজন অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী।
সবার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক। তার জীবনে এতবড় একটি দুর্ঘটনা ঘটার পরও তিনি
অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজে পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করেন এ
বিষয়টি এলাকার মানুষকে অবাক করেছে এবং তিনি সবার কাছে এখন একটি অনন্য
উদাহরণ।’
৫নং বিনাইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. শহিদুল ইসলাম বলেন,
‘মোজাম্মেল হকের শারীরিক সমস্যার বিষয়টি বিবেচনায় এনে তাকে বয়স্কভাতা কার্ড
দেয়া হয়েছে। আর তার ব্যবসায়িক পুঁজি বাড়ানোর জন্য সরাসরি আর্থিক অনুদান
দেয়ার ব্যবস্থা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নেই। তবে তার এ বিষয়ে আমি ইউএনওর সঙ্গে
কথা বলব।’
এ বিষয়ে কথা হলে বিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)
পরিমল কুমার সরকার বলেন, ‘দুই পা হারিয়ে কোমরে চটের বস্তাবেঁধে জীবনচাকা
সচল করতে ভ্যান, সাইকেলের চাকা মেরামত করেন মোজাম্মেল। তার এই অবস্থায়
সরকার তাকে একটি বয়স্কভাতার কার্ড করে দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ওই ব্যক্তির
পাশে শুধু সরকার নয় সমাজের বৃত্তবান মানুষগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। তার
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে আয় বাড়ানোর জন্য যদি কিছু পুঁজির ব্যবস্থা করা যায়
সেই বিষয়টি আমরা বিবেচনা করব।’