ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া ||
সর্বনাশা
করোনাভাইরাস মোকাবিলা করার জন্য পৃথিবীর উন্নত ক'টি দেশে তৈরি করা হয়েছে
করোনা ভ্যাকসিন। অনেক মেধা, সময় আর অর্থ ব্যয় করে উদ্ভাবন করা হয়েছে এসব
ভ্যাকসিন। সে কারণেই এসব ভ্যাকসিন বাণিজ্যিকীকরণ করে একচেটিয়া মুনাফা অর্জন
করার জন্য সংশ্নিষ্ট গবেষক বা ওষুধ কোম্পানি মেধাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে
একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য স্বত্ব অর্জন করেছে। এ সময়কালে ভ্যাকসিন
বিক্রয় করে একচ্ছত্র মুনাফা অর্জন করার আইনগত বৈধ অধিকার তাদের রয়েছে।
এভাবেই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বিজ্ঞান গবেষণা পরিচালিত হয় এবং প্রোডাক্ট
বা প্রসেসের জন্য মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হয়। আর তাতে এগিয়ে চলে গবেষণা ও
উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) কার্যক্রম। এটি হলো মেধাস্বত্ব রক্ষার চিরাচরিত নিয়ম।
আইনের মাধ্যমে প্রাপ্ত অধিকার এটি।
করোনা এখনও আমাদের এক বড় আতঙ্কের
নাম। কবে আমাদের প্রিয় পৃথিবী এর হাত থেকে মুক্তি পাবে কে জানে। নাকি একে
সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে আমাদের আরও বহু বহু দিন, সে ভাবনাও অমূলক নয়। সে
কারণেই করোনার টিকা নিয়ে মানুষের এত আগ্রহ। যদি খানিকটা হলেও নিস্কৃতি
পাওয়া সম্ভব হয় এর হাত থেকে। পৃথিবীর অল্প ক'টি প্রতিষ্ঠান টিকা আবিস্কার
করতে সক্ষম হয়েছে মাত্র। মডার্না, বায়োএনটেক, রভি, ক্যানসিনো বায়োলজিক্স
ইত্যাদি টিকা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বড় বড় সব ফার্মা। অথচ পৃথিবীর সব দেশের
মানুষের জন্য এ টিকা প্রয়োজন। চাহিদার তুলনায় টিকার উৎপাদন সংখ্যা আসলেই
অনেক কম। যাকে মানুষ জীবন রক্ষাকারী হিসেবে ভাবছে, তার সংকট তাই গোটা
পৃথিবীর মানুষের কাছেই ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব জীবন রক্ষাকারী
টিকার দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি করা এখন সবারই দাবি। যারা টিকার আবিস্কারক তাদের
পক্ষে অল্প সময়ে টিকার উৎপাদন বৃদ্ধি করে সব দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ
করা যে সম্ভব নয়, সেটা বেশ পরিস্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে। অথচ এসব টিকার
উৎপাদন বৃদ্ধি করাও জরুরি। বরং বলা ভালো, অতি জরুরি।
টিকার উৎপাদনের
ঘাটতির কথা বলা হলো বটে, তবে দেশে দেশে টিকাপ্রাপ্তির বৈষম্যের বিষয়টিও কম
গুরুত্বপূর্ণ নয়। অতিসম্প্রতি সেসব তথ্যও কিন্তু প্রকাশিত হয়েছে।
করোনাভাইরাসের টিকার প্রাপ্যতার বৈষম্য নিয়ে বেশ খোলামেলাভাবেই কথা বলেছেন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসুস। তিনি হিসাব
কষে দেখিয়েছেন, পৃথিবীর জনসংখ্যার মাত্র ১৫ ভাগ লোক রয়েছে ধনী দেশগুলোতে
আর টিকা পেয়েছে এসব কয়েকটি দেশ শতকরা ৪৫ ভাগ। অন্যদিকে, পৃথিবীর সিংহভাগ
মানুষ বাস করেছে পৃথিবীর শতাধিক দেশে, অথচ তারা ভ্যাকসিন পেয়েছে মাত্র
শতকরা ১৭ ভাগ। টিকা নিয়ে বৈষম্য সৃষ্টির তথ্য হিসাবে এ পরিসংখ্যানটিই
যথেষ্ট। ফলে টিকার প্রাপ্যতা বাড়াতে হলে ব্যবস্থা নিতে হবে টিকা উদ্ভাবক
দেশগুলোকেই। ভ্যাকসিন আবিস্কারক বড় কোম্পানিগুলো তাদের প্রোডাক্ট বাজারে
ছাড়ার আগেই পেটেন্টের মাধ্যমে এসব উদ্ভাবনের জন্য মেধাস্বত্ব অর্জন করেছে।
ফলে চাইলেও সক্ষমতা আছে এমন অন্যান্য কোম্পানির এসব প্রোডাক্ট তৈরি করার
আইনগত সুযোগ নেই। মেধাস্বত্ব ছাড়ের দাবিটি উঠে এসেছে তাই অতি যৌক্তিক
কারণেই। বিশ্ব যখন কভিড নিয়ে মহাসংকটে নিপতিত, তখন এ দাবি আরও জোরালো হওয়াই
স্বাভাবিক। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) বাণিজ্যের জন্য মেধাস্বত্ব
রক্ষার এক বড় নিয়ামক সংস্থা। সে কারণেই মানবজাতির ক্রান্তিলগ্নে ভারত ও
দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে কভিড ভ্যাকসিনের মেধাস্বত্ব
সাময়িক প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে গত বছরের আগস্টেই। বলা বাহুল্য, একশরও
বেশি দেশ এ দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। বাণিজ্যের বৈশ্বিক ব্যবস্থা
সম্পর্কে সংবেদনশীল বলেই মেধাস্বত্ব সম্পূর্ণ ছাড়ের দাবি কিন্তু দেশগুলো
তোলেনি। বরং আপৎকালীন সময়ে সাময়িক ছাড়ের প্রসঙ্গটি এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এমন উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন বেশ তড়িঘড়ি
করেই। এর বিপক্ষে অবস্থান নিতে এক দিনও দেরি করেনি জার্মানি। ব্যবসায়িক
স্বার্থ রক্ষাটাই জার্মানির কাছে প্রাধান্য পেয়েছে। মানবজাতির বিপর্যয় নয়।
দেশটির টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেক একটি ভ্যাকসিন উদ্ভাবন ও
উৎপাদক ফার্মাসিউটিক্যালস। তাদের যুক্তি হলো, ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট
সৃষ্টি আরও নতুন ও অধিক কার্যকর ভ্যাকসিন গবেষণাকে অত্যাবশ্যক করে তুলেছে।
এর জন্য প্রয়োজন হবে প্রচুর অর্থ। গবেষণা ও উন্নয়নের স্বার্থেই এসব করতে
হবে। ফার্মা প্রতিষ্ঠানগুলো টিকার মেধাস্বত্ব ছাড় দেওয়া হলে এটি অন্যান্য
প্রোডাক্ট বা প্রসেসের ক্ষেত্রেও ভবিষ্যতে মেধাস্বত্ব ছাড়ের একটি উদাহরণ
হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্র তৈরি করবে। এ রকম আশঙ্কার কথাও কিন্তু উল্লেখ
করেছে তারা। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) অবশ্য মেধাস্বত্বের সাময়িক ছাড় নিয়ে
ডব্লিউটিওর সঙ্গে আলোচনা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। গরিব দেশের টিকাপ্রাপ্তি
সুলভ করার বিষয়টি নিয়ে ভাবছে আরও কিছু ইইউ দেশও। তবে ১৬৪ দেশের
প্রতিনিধিত্বকারী ডব্লিউটিও কতদূর সমঝোতায় পৌঁছাতে পারবে, সে সন্দেহ তো
থেকেই যাচ্ছে। কেউ কেউ অবশ্য মেধাস্বত্ব বহাল রেখে টিকা তৈরির অন্যান্য
বিকল্পের কথাও বলছেন। টিকার উদ্ভাবক বা উৎপাদক ফার্মার সঙ্গে চুক্তির
মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ টিকা বানাতে পারবে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন কোনো কোনো
গবেষক। এতেও যে দরিদ্র দেশ বঞ্চিত হবে না, সে রকম কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ
চুক্তির ক্ষেত্রে বড় ফার্মাগুলো অল্প পুঁজির দরিদ্র দেশগুলোর ছোট ফার্মার
চেয়ে ধনী দেশের বড় পুঁজির বড় ফার্মাকেই বেশি প্রাধান্য দেবে। সে ক্ষেত্রে
দরিদ্র দেশগুলোর টিকা প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে।
কভিড টিকা নিয়ে
বড়সড় রকমের ব্যবসাটা ইতোমধ্যে যে উদ্ভাবক সংস্থাগুলো করেছে, সে খবর কিন্তু
এখন আর গোপন নেই। ভ্যাকসিন ব্যবসায় অর্জিত ৯ বিলিয়নেয়ারের কাহিনি এখন
পত্রিকার পাতায় বেশ সুলভ। ফলে প্রচুর অর্থের মালিক বনে যাওয়া এসব উদ্ভাবক
সংস্থা এখন মানবিক হতেই পারে। সেটি তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করবে আর বাঁচাবে
কোটি কোটি মানুষকে বিপর্যয়ের হাত থেকে অনেকটাই। তাছাড়া মেধাস্বত্ব ছাড়ের
বিষয়টি কিন্তু সাময়িক হতেই পারে, অবস্থা বিবেচনায় ব্যবস্থাপনার ত্রুটি ধরা
পড়লে বা অন্য কারিগরি সমস্যা দেখা দিলে তা ক্ষেত্রভেদে প্রত্যাহারের সুযোগও
থাকতে পারে। তবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যতটা সম্ভব দ্রুতই। আর তা করতে হবে
ভয়ানক আতঙ্কের মধ্যে থাকা গোটা বিশ্বের মানুষের মনে খানিকটা স্বস্তি ফিরিয়ে
আনা এবং অবশ্যই দেশে দেশে ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা সুনিশ্চিত করার মানবিক
প্রত্যাশা পূরণের মাধ্যমে।
উপাচার্য, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়