ড. আতিউর রহমান ||
গত
৩ জুন জাতীয় সংসদে আসন্ন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হয়। প্রস্তাবিত
বাজেট নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক চলছে। এখন পর্যন্ত যেসব গঠনমূলক সমালোচনা,
পর্যালোচনা এবং মূল্যায়ন হাজির করা হয়েছে তা থেকে বলা যায়, বাজেট প্রস্তাবে
বিদ্যমান বাস্তবতাকে সতর্কভাবেই বিবেচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি আগামীর
পথনকশাও এই বাজেটে আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। একদিকে সামাজিক নিরাপত্তা,
করোনা চিকিৎসা ও টিকা সংগ্রহে জোর দিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা এবং বিপন্ন
প্রান্তিক মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে; অন্যদিকে শিল্প ও
ব্যবসাবান্ধব রাজস্ব নীতি প্রস্তাব করা হয়েছে মূলত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে
মানুষের আয় বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বহাল রাখার মাধ্যমে অর্থনৈতিক
সুরক্ষার জন্য। আর এভাবেই আসন্ন অর্থবছরে মানুষের জীবন রক্ষার প্রয়োজনীয়
ব্যবস্থা করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭.২ শতাংশ করার লক্ষ্য অর্জন করার কথা বলা
হচ্ছে। সময়মতো অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালে নিশ্চয় প্রবৃদ্ধির এ লক্ষ্যমাত্রা
অর্জনযোগ্য। তবে আমি প্রবৃদ্ধি নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতে চাই না। এখন
দরকার টিকে থাকার। এই পরিমাণের প্রবৃদ্ধি হলে ভালো। না হলেও দুশ্চিন্তার
কিছু নেই।
বরং নজর দেওয়া দরকার কী করে এই দ্বৈত-কৌশলটি প্রয়োগ করে
মানুষের জীবন ও জীবিকা দুই-ই রক্ষা করা সম্ভব সেদিকে। কৌশলটি নিঃসন্দেহে
সহজ এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, এটি সময়োপযোগী। এই প্রস্তাবনা
বাস্তবায়ন করা অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং। আর এই চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য অর্জনে আমাদের
সর্বোচ্চ সক্ষমতার প্রমাণ রাখতে হবে। দেশের ম্যাক্রো-অর্থনীতি বর্তমানে
যে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তার বিবেচনায় এ লক্ষ্য অর্জন খুবই সম্ভব।
স্বাস্থ্য
খাতের মোট বরাদ্দের ক্ষেত্রে বাজেট প্রণেতারা আরেকটু সাহসী ও উদার হতে
পারতেন বলে অনেক বিশেষজ্ঞ ও অংশীজন বলছেন। আমারও তাই মনে হয়। স্বাস্থ্যে
চলতি বছরের সংশোধিত বরাদ্দের চেয়ে ৪ শতাংশ বাড়িয়ে মোট প্রায় ৩৩ হাজার কোটি
টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ আরও বাড়ানোই প্রত্যাশিত ছিল। মোট বাজেটের
শতাংশ হিসেবে স্বাস্থ্য বরাদ্দের অনুপাত ৫.৪ শতাংশ। এই অনুপাত বাড়ানো নিয়ে
সবাই কথা বলছেন। তার কারণ গত ১০-১২ বছর ধরেই স্বাস্থ্যে মোট বাজেটের ৫
শতাংশের আশপাশে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আমাদের মাথাপিছু আয় তো বেড়েই চলেছে।
পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় মাথাপিছু আয়ের বিচারে আমরা এখন সবার চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু
স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয়ের বিচারে আমরা সবচেয়ে পিছিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ায়
(পিপিপি মূল্যে) স্বাস্থ্যে মাথাপিছু ব্যয় গড়ে ৪০১ ডলার, আর আমাদের মাত্র
১১০ ডলার। তাই সবাই প্রত্যাশা করছিলেন করোনা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আসন্ন
অর্থবছরে স্বাস্থ্যের বরাদ্দ মোট বাজেটের অন্তত ৭ শতাংশের কম হবে না। আমার
মনে হয় স্বাস্থ্যে বরাদ্দকৃত অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়মিতভাবে
অব্যয়িত থেকে যাওয়া এবং এ খাতে অপচয়ের বিষয়গুলো মাথায় রেখেই নীতিনির্ধারকরা
বরাদ্দ দেওয়ার সময় সাবধান থেকেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোর উপাত্ত বলছে,
স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন বরাদ্দের ২৪ শতাংশই অব্যয়িত থেকে যায়। এই বিচারে
নীতিনির্ধারকদের এমন সতর্কতাকে তাই ইতিবাচকভাবেই দেখছি। তবে বরাদ্দে যেহেতু
সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে, তাই বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এবার
পিছিয়ে থাকার কোনো সুযোগই নেই। সে ক্ষেত্রেও একই ধরনের সতর্কতা কাম্য।
সেজন্য স্বাস্থ্য বাজেটের বাস্তবায়নের ধারা মনিটরিং আরও জোরদার করা চাই।
মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম তদারকি করার জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তির কার্যকর
ব্যবহারের কথা ভাবা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকে আমরা আমদানি-রপ্তানির এলসি মনিটর
করার জন্য একটি ডিজিটাল ড্যাশবোর্ড চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিং
জোরদার করতে পেরেছিলাম। স্বাস্থ্য খাতেও একই রকম ডিজিটাল উদ্যোগ নেওয়া যেতে
পারে। আইসিটি মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে।
স্বাস্থ্যের
জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি তথা এডিপিতে যে প্রকল্প বরাদ্দগুলো আছে,
সেগুলো পর্যালোচনা করে মনে হয়েছে, ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে। তবে এ
ক্ষেত্রে আরও ভালো কিছু করা যেত। স্বাস্থ্যের জন্য মোট ৬৫টি উন্নয়ন
প্রকল্পে ১৭,৩১২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে নতুন প্রকল্প মাত্র
একটি। আগের প্রকল্পগুলো তো চলবেই। তবে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে আরও
নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়ার দরকার ছিল। যেমন : সারাদেশে স্বাস্থ্যসেবা
সহজলভ্য করে নগরাঞ্চলের বড় চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর ওপর চাপ কমাতে নতুন
স্বাস্থ্য অবকাঠামোনির্ভর প্রকল্প হাতে নেওয়া যেত। বিশেষ করে জেলা পর্যায়ে
কেন্দ্রীয় অক্সিজেন প্লান্ট নির্মাণ, আইসিইউ সুবিধা, ভেন্টিলেশনের
ব্যবস্থা, বিশেষজ্ঞ জনবল এবং টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়
হাসপাতালগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন ইত্যাদির জন্য প্রচুর বিনিয়োগ দরকার।
পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া
যেত। এ ক্ষেত্রে একটি আলাদা গবেষণা ফাউন্ডেশন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
জাতীয় বাজেট আসন্ন একটি অর্থবছরের জন্য প্রণীত হলেও এটি আমাদের ভবিষ্যতের
পথনকশারও অংশ বটে। তাই আগামীর জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার জন্যই এর প্রয়োজন
রয়েছে।
বিশেষজ্ঞসহ সব পর্যায়ের অংশীজনরা অন্য যে বিষয়টির দিকে বিশেষ জোর
দিচ্ছেন তা হলো, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের বা বরাদ্দের ক্ষেত্রে কাঠামোগত
পরিবর্তন। কারণ কাঠামোগত পরিবর্তন বা ব্যাপক সংস্কারের মধ্য দিয়ে না গিয়ে
কেবল বরাদ্দ বাড়িয়ে স্বাস্থ্য খাতের সংকট মোকাবিলা করা যাবে না। যেমন
:ধারাবাহিকভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় মোট স্বাস্থ্য বাজেটের ২৫ শতাংশের
মতো বরাদ্দ দেওয়া হয়ে আসছে। অথচ আমাদের স্বাস্থ্য সেবাপ্রার্থীদের বড়
অংশটিই কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য আসেন। কাজেই মোট স্বাস্থ্য
ব্যয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অংশ বাড়ানো দরকার। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার
মান যত বাড়ানো যাবে সেকেন্ডারি ও টারসিয়ারি স্বাস্থ্যসেবার পেছনে খরচও তত
কমবে। স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন উপখাতে যে বরাদ্দ যাচ্ছে তার প্রক্ষেপণ
বিশ্নেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসা ও শল্য চিকিৎসা বাবদ যায় স্বাস্থ্য
খাতে সরকারি বরাদ্দের মাত্র এক-পঞ্চমাংশ। অথচ বিনামূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে
যে ওষুধ সরকারি সেবাকেন্দ্রগুলো থেকে দেওয়া হয়, সেই টাকা কিন্তু এই উপখাত
থেকে আসে। কাজেই এই উপখাতে বরাদ্দ বাড়ানো গেলে মানুষের, বিশেষ করে নি¤œ
আয়ের সেবাপ্রার্থীদের 'আউট অব পকেট' খরচ অনেকটাই কমানো সম্ভব।
স্বাস্থ্য
খাতের জন্য আসন্ন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে
ইতিবাচক হয়েছে স্বাস্থ্য খাতের ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের জন্য দেওয়া কর
ছাড়গুলো। আমাদের জনগণ কিন্তু স্বাস্থ্যসেবার জন্য বহুলাংশে ব্যক্তি খাতের
ওপরই নির্ভর করেন। আউট পেশেন্টদের মধ্যে গড়ে ৮৩ শতাংশ এবং ইন পেশেন্টদের
মধ্যে গড়ে ৪৩ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবার জন্য বেসরকারি হাসপাতাল বা
স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে যান। তাই স্বাস্থ্য খাতের ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের কর
ছাড় দেওয়ার প্রস্তাবনাগুলো আমাদের নীতিনির্ধারকদের বিদ্যমান বাস্তবতার
বিষয়ে সংবেদনশীলতা প্রমাণ করে। ঢাকার বাইরে প্রাইভেট হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায়
কর অবকাশ এবং করোনা চিকিৎসাসামগ্রী আমদানিতে কর ও ভ্যাট ছাড়ের মতো
প্রস্তাবনাগুলো প্রশংসার দাবি রাখে। একইভাবে বেসরকারি খাতের এসব উদ্যোগে
অর্থায়নকারী ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও করপোরেট কর
প্রণোদনার কথা ভাবা যায়। স্বাস্থ্যসেবার জন্য ব্যক্তি খাতের ওপর নির্ভরতার
বিবেচনায় আরেকটি প্রস্তাব রাখতে চাই। যারা (বিশেষত যে দরিদ্র, এমনকি
মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ) করোনা চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন,
তাদের সরকারের পক্ষ থেকে খানিকটা ভর্তুকি দেওয়ার জন্য একটি করোনা ভাউচার
স্কিম অন্তত পাইলট ভিত্তিতে দ্রুত চালু করার কথা ভাবা যায়। সর্বজনীন
স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে পাইলট প্রকল্প ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। সেখানকার
অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আরও বড় প্রকল্পও হাতে নেওয়া উচিত বলে মনে করি। বাজেট
অধিবেশনে মাননীয় সংসদ সদস্যদের আলোচনায় এবং সংসদের বাইরে নাগরিক সংলাপে এ
বিষয়গুলো বেশি করে উঠে আসা উচিত।
সবশেষে বলতে চাই, সতর্ক বাজেট
বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ দক্ষতা দেখানোর পাশাপাশি আমাদের করোনা পরিস্থিতির
সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে প্রয়োজনীয় রদবদলের প্রস্তুতিও রাখতে হবে। যেমন
সীমান্ত এলাকায় দ্রুত সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছেন যে,
ওইসব এলাকার জন্য আলাদা করে আপৎকালীন থোক বরাদ্দ দেওয়ার। একই সঙ্গে
আন্তঃসীমান্ত রোগ নিয়ন্ত্রণবিষয়ক আন্তর্জাতিক নীতিমালা নিয়েও এখন থেকে কাজ
শুরু হওয়া চাই। এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য
সহযোগিতা কাঠামো গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে। মোদ্দা কথা, আমাদের স্বাস্থ্য খাত
নিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি ভিশন দাঁড় করাতে সরকারি, অ-সরকারি ও ব্যক্তি খাতের
অংশীজনদের কাজ শুরু করতে হবে। এমন একটি ভিশন ও ফ্রেমওয়ার্ক থাকলে তা আগামী
দিনে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ দেওয়ার সময় বাজেট প্রণেতাদের জন্য সহায়ক হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং উন্নয়ন সমন্বয়ের চেয়ারপারসন