শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ।।
(১)
ভূমিকা:
আমি কুমিল্লা জেলার অধিবাসী। আমার দেশ বাংলাদেশ, ভাষা বাংলা এবং জাতিগত পরিচয় বাঙালি। আমার পূর্বপুরুষ জন্মসূত্রে এ দেশের নাগরিক। এ ধারায় আমার নাগরিকত্বও এ বিবেচনায় ‘বাঙালি’।
আমি কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার (থানা) ২২নং মাহাম্মদপুর ইউনিয়নের মাহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করি। যে বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করি, এলাকায় এ বাড়িটি ‘মাস্টারবাড়ি’ হিসেবে পরিচিত। এ বাড়ির অনেকেই চারপুরুষ শিক্ষকতায় জড়িত ছিলেন, আছেন। তবে এখন বাড়িটি আর আমাদের অধিকারে নেই। সকলেই দেশান্তর ও শহরবাসী হয়ে গেছেন। আমাদের বাড়িতে বাবা-মার শ্মশানসহ পাঁচ শতাংশ এবং এক কাকা তাঁর অংশে আছেন। যদিও বাড়ির ঠিকানা বলে মাঝে মাঝে পরিচয় দিই, মূলত সেখানে আমরা কেউ বাস করি না। এখন আমার বাসস্থান কুমিল্লা শহরের ঠাকুরপাড়া। আমি এবং অপর তিনভাই কুমিল্লা শহরের অধিবাসী। কুমিল্লা এখন আমার শহর, আমাদের শহর।
কুমিল্লা শহরে আমি প্রথম আসি ১৯৫৮ সালে, তখন আমি স্থানীয় বরকোটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। কী কারণে ২০ (বিশ) টাকা বৃত্তি পেয়েছিলাম। তা গ্রহণ করতে কুমিল্লা শহরে কুমিল্লা উত্তর মহকুমা প্রশাসকের দপ্তরে আসতে হয়েছিল। আমাদের শিক্ষক জনাব আবদুস সামাদ বি,এ.বিটি-সহকারী প্রধান শিক্ষক আমাদের বৃত্তি পাওয়া চারজনকে নিয়ে এসেছিলেন। আমরা যখন মহকুমা প্রশাসকের (হাকিমের) দপ্তরে পৌঁছি, তখন শুনতে পাই তিনি সরকারি কাজে দেবিদ্বার গিয়েছেন। সুতরাং তিনি না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হয়। বর্তমানে যে জেলা প্রশাসকের দপ্তর, এখানে একতলা দালান ও টিনের ঘর বা বাংলো ছিল অফিস ও ফৌজদারি আদালত হিসেবে। একটি বড় বটগাছ ছিল, আমরা গাছের শিকড়ে বসে সময় কাটাচ্ছিলাম। আবার ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল। এজলাসের সামনে একজন বসে দড়ি দিয়ে কী যেন টানছেন, দেখলাম অফিসার বা ম্যাজিস্ট্রেটের মাথার উপর পাটি ও কাপড় দিয়ে একধরনের পাখা ঝলছে, তা টানা হচ্ছে। এভাবে বাতাস সেবনের ব্যবস্থা ছিল। আশ্চর্য হয়েছিলাম। যে ব্যক্তিটি এ টানাটানি করত, সে নাকি অস্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত। আমাদের শিক্ষক আমাদের বসিয়ে রেখে কোথায় গেলেন। দুপুরে এলেন ও বর্তমানে কালেক্টরি অফিসের সামনে যে পুকুর রয়েছে, তার উত্তর পাড়ে হোটেল ছিল, সেখানে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেন। এবং সেখান থেকে ডেলহনি সাহেবের বাড়িটি বা এলাকাটি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিকেলবেলায় মহকুমা প্রশাসক, তখন এসডিও বলা হতো, তিনি এলেন এবং তাঁর অফিসকক্ষে ডেকে নিয়ে আমাদের হাতে বৃত্তির টাকা তুলে দেন। তারপর তড়িগড়ি করে শাসনগাছা এসে বাস ধরে বাড়ি চলে আসি।
আমি দি¦তীয়বার কুমিল্লা শহরের পশ্চিমাংশে রেলস্টশনে আসি একই বছর। আমার বড়কাকা বিয়ে করতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবেন, বরযাত্রী হয়ে সকলের সঙ্গে রওয়ানা দিয়েছি। তখন রবযাত্রীরা গ্রাম থেকে জুতা হাতে করেই শহরে পৌঁছেন। এখন যেখানে বাসস্টেশন, এখানে একটি পুকুর ছিল, পূর্বপাড়ে ডাকবাংলোর কোণায় একটি কাঁচা ঘাট ছিল, এ-ঘাটে হাতমুখ ধুয়ে এবং পায়ের ময়লা পরিষ্কার করে জুতা পরে নেন। তারপর হেঁটেই রেলস্টেশনে গিয়ে বাইরের বসার আসনে বসে থাকেন। কখন ট্রেন আসবে আমি জানি নাই। দেরি হয়েছিল , পেটে ক্ষুধা পেয়ে যায়, তখন স্টেশনের পূর্বদিকে, বর্তমানে যেখানে সবুজ রেস্টুরেন্ট, এখানে একটি হোটেলে আমাকে খাওয়ানো হয়। অন্যেরা বিড়ি খেয়েই সময় কাটিয়ে একসময় ট্রেনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে চলে যাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের বাড়ির একজন কাকা প্রমোদরঞ্জন ভৌমিক সাধনা ঔষধালয়ের ম্যানেজার ও কবিরাজ ছিলেন।
আমি তৃতীয়বার কুমিল্লা শহরের আসি ১৯৬১ সালের মার্চ মাসের প্রথমে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে। আমার মেসোতাত দু’ভাই কুমিল্লা শহরের ছাতিপট্টি সংলগ্ন সুপারিবাগানে গুহবাড়ির কাচারি ঘরে থেকে কলেজে পড়তেন। আমিসহ দু’মাসীর দু’ছেলে আমার মেসোতাত ভাই রথীন্দ্র ও দিলীপ পরীক্ষা দিতে তাদের কাছে আসি। আমরা এসেছিলাম এক শুক্রবার, শনিবার বাসায় পড়াশোনা করেছি, ছাতিপট্টি অর্থাৎ মধুমিতা সিনেমা হলের প্রবেশ মুখে বিবেকানন্দ হোটেল ছিল, সেখানে খাওয়া-দাওয়া করেছি। রবিবার কোথায় পরীক্ষার সীট পড়েছে, তা দেখতে গেছি এবং সন্ধ্যার আগেই শ্রীরাজরাজেশ্বরী কালীবাড়িতে একটাকার পেড়া ভোগ দিয়ে সুপারিবাগানে চলে আসি। আমাদের পরীক্ষার সীট পড়েছিল জেলাখানার সামনে দক্ষিণাংশে লিয়াকত টেকনিক্যাল স্কুলে। এ স্কুলটি জেলাপরিষদ কর্তৃক পরিচালিত। এখানে দু’বছরের কোর্সে সাব ওভারসিয়ারি পড়ার সুযোগ ছিল। পাশ করলেই কোনোকোনো ঠিকাদারের অধীনে চাকরি পাওয়া যেত, সরকারি চাকরিও পাওয়া যেত। এ স্কুলটি ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত, নাম ছিল ইলিয়ট টেকনিকেল ইন্সটিটিউট, পাকিস্তান আমলে লিয়াকত টেকনিক্যাল স্কুল বা ইন্সটিটিউট এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ১৯৭১ সালে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক শহিদ শামসুল হক খানকে মার্চ মাসে হত্যা করে, তাঁর স্মৃতি-স্মারক হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানটির নাম পাল্টিয়ে ‘শহীদ শামসুল হক টেননিক্যাল ইন্সটিটিউট’ নাম রাখা হয়। এখন তার অস্তিত্ব নেই। কোটবাড়িতে পলিটেকনিক কলেজ প্রতিষ্ঠার পর তার গুরুত্ব কমে যায় এবং জেলা পরিষদ এখানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রকৌশল অফিস স্থাপন করে।
আমাদের পরীক্ষা চলেছিল মূলত চারদিন। সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার। প্রতিদিন দু’বেলা। প্রথম দিন ইংরেজি দু’পত্র, দ্বিতীয় দিন বাংলা দু’পত্র, তৃতীয় দিন অংক ও ভূগোল এবং চতুর্থদিন ইতিহাস ও সংস্কৃত/আরবী। পরের দিন শুক্রবার। শনিবার সকালবেলা যারা অতিরিক্ত বা আবশান্যাল বিষয় নিত তাদের একবেলা পরীক্ষা হলেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ। মনে পড়ে আমরা সকলেই শুক্রবার তিনটি সিনেমা হলে-পিকচার প্যালেস (লিবার্টি), রূপকথা ও রূপালী হলে সিনেমা দেখেছি। শনিবার অপরাহ্ন থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত দ্বিতীয়বার আবার সে সকল সিনেমা দেখে রবিবার বাড়ি চলে গেছি। উল্লেখ্য, আমি ছাতিপট্টিতে তখনকার বিখ্যাত দর্জি মেতু মিঞার ‘ড্রেসমাস্টার’ থেকে একটি পাজামা ও চীনা টি শার্ট তৈরি করে তা পরেই বাড়িতে গিয়েছি। তখন পাজামা ছিল খুবই ঢোলা। আর সেসময় নতুন পঞ্জের সে-েল বাজারে আসে, তা পরেই শহরে পরীক্ষা ও ঘুরাঘুরি যথাক্রমে দিয়েছি ও করেছি।
আমি চতুর্থবার কুমিল্লা শহরে আসি জুন-জুলাই মাসে ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হতে। ভর্তি হয়ে বাড়ি চলে যাই এবং কয়েকদিন পর একেবারে প্রস্তুতি নিয়ে চলে আসি। থাকার আস্তানা পূর্বনির্ধারিত সুপারিবাগানের গুহবাড়ির কাচারি ঘরে, খাওয়া-দাওয়া বিবেকানন্দ হোটেলে। এই যে কলেজে ছাত্র হিসেবে কুমিল্লা শহরে আসা, তখন থেকে বলতে গেলে এখন পর্যন্ত এশহরেই আছি, স্থায়ীভাবে বসবাস করছি এবং এখন তো আমার বাড়ি বলতে কুমিল্লা শহরের ঠাকুরপাড়ায়। হিসাব করে দেখলাম আমি ৬১ বছর যাবত এ শহরে বসবাস করছি। এখানে আমার ছাত্রজীবন পাঁচবছর, চাকরিজীবন ছাব্বিশ বছর, অবসরজীবন আঠার বছর, মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর পড়েছি এবং চাকরি সূত্রে দু’বার চট্টগ্রাম এবং একবার মৌলভীবাজারে অতিবাহিত করলেও মূলত কুমিল্লায়ই থেকেছি সে সময়। কারণ কলেজের চাকরি, বছরে আটমাস নানা কারণেই বন্ধ থাকে।
কুমিল্লা শহরে ছাত্রজীবনে সুপারিবাগান, চাকরি জীবনে দিগম্বরীতলা ও ঠাকুরপাড়ায় ভাড়া বাসায় থেকেছি। পরে ১৯৮৩ সালে ঠাকুরপাড়ায় পাঁচ শতক জায়গা ক্রয় করে ১৯৮৭ সালে বাড়ি নির্মাণ করে স্থায়ী নিবাসী হয়েছি। সুতরাং অবশ্যই বলতে পারি আমার শহর ‘কুমিল্লা’।
কুমিল্লার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হলো, এক সময় শহরটিই কুমিল্লা নামে পরিচিত ছিল। জেলার নাম ছিল ত্রিপুরা। ত্রিপুরা রাজ্যের দুটি অংশ-পার্বত্য ত্রিপুরা ও ত্রিপুরা (সমতল/সমতট)। ত্রিপুরা ছিল ‘চাকলা রোশনাবাদ’ নামে- ত্রিপুরা রাজার জমিদারি। এই জমিদারি পরিচালনা করার জন্য কুমিল্লা শহরে ছিল ত্রিপুরারাজার নানা স্থাপনা। তার স্বাক্ষর বর্তমান সময়ও পরিচিতি বহন করছে। ১৯৪৭ সালে ত্রিপুরা (সমতল বা চাকলা রোশনাবাদ) পাকিস্তানের অন্তর্গত হয়। তখন ত্রিপুরাকে জেলা হিসেবে প্রশাসনের সুবিধার্থে চারটি মহকুমায় ভাগ করা হয়। কুমিল্লা উত্তর ও দক্ষিণ, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে ‘ত্রিপুরা’ শব্দটি বাদ দিয়ে জেলার নামকরণ ‘কুমিল্লা’ করা হয়। এই কুমিল্লা জেলাই এখন তিনটি পৃথক জেলায় বিভক্ত- কুমিল্লা-চাঁদপুর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া। আমি যখন ১৯৬১ সালে কুমিল্লা শহরে কলেজে ভর্তি হই, চিঠিপত্রে তখনও জেলা হিসেবে ত্রিপুরাই লিখতাম।
ত্রিপুরা বলতে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী অধিক বাস করে বলেই হয়ত রাজ্যটির নাম ত্রিপুরা। মূলত তা নয়। পার্বত্য ত্রিপুরায় বহু আদিবাসীর বাস, তন্মেধ্যে রাজাসহ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ই বেশি। কিন্তু সমতল ত্রিপুরা হলো বাঙালি অধ্যুষিত জনপদ। ত্রিপুরা বা টিপরা সম্প্রদায়ের অধিবাসী কমই ছিল। তাদের অস্তিস্ত¡ খুঁজলে দেখা যায়- টিপরা বাজার নামটি এখনও জনশ্রুতিতে প্রচলিত আছে, কোটবাড়ি এলাকায় একটি টিপরাপাড়া আছে। আমার গ্রাম মাহাম্মদপুরে একটি পরিবার ছিল, এখন আছে কীনা জানি না। সুতরাং এ অঞ্চলটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে পরিচিতি থাকলেও ত্রিপুরা বা টিপরা অদিবাসীদের ব্যাপক বসতি ছিল না।
ইতিহাসের ক্রমধারায় ত্রিপুরা রাজাদের রাজত্বের সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে বর্তমান কুমিল্লা যে গৌরব বহন করেছে বা করছে, তা অস্বীকার না করে বলা যায়- কুমিল্লার একটি স্বকীয় ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের ধারা পূর্বথেকেই স্বাতন্ত্রিকভাবে বহমান ছিল, তা যতটা না রাজা-প্রভাবিত, তার চেয়ে বেশি বাঙালি সংস্কৃতি চেতনাবাহী। উল্লেখ্য, ত্রিপুরাজাতির নিজস্ব ভাষা ও সাহিত্য থাকা সত্ত্বেও মহারাজা বীরচন্দ্রমাণিক্য বাহাদুরের সময় থেকে ত্রিপুরার রাজভাষা ছিল ‘বাংলা’। এ প্রেক্ষিতে আমার আলোচনায়-ত্রিপুরা নয়, কুমিল্লাই প্রাধান্য পাবে, বিশেষত আমার শহর ‘কুমিল্লার’ কথাই বলতে সচেষ্ট থাকব।
(ক্রমশ)
৬