ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
ব্রাহ্মণপাড়ায় বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৫ জয়ীতা
Published : Wednesday, 30 June, 2021 at 12:00 AM, Update: 30.06.2021 1:07:47 AM
ব্রাহ্মণপাড়ায় বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৫ জয়ীতা ইসমাইল নয়ন ।। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৫ জয়ীতা অনুমোদন পেলেন। তারা সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান, শিক্ষা ও চাকরি সাফল্য, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন উদ্যোমে জীবন শুরু, অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য এবং সফল জননী হিসেবে খ্যাত ৫জয়ীতারা হলেন, সালমা আক্তার, আলেয়া বেগম, সাহানা বেগম, কাজল রেখা ও রমুজা বেগম।
'সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী' চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার শিলার চান গ্রামের মৃত শফিকুল ইসলাম মাস্টারের মেয়ে সালমা আক্তার। ১৯৭৭ সালের ২০ মে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব কেটেছে কষ্টের মাঝে। কৈশোরে নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি বাল্যবিয়ের শিকার হন। ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে তিনি ব্রাহ্মণপাড়ার বেজুরা গ্রামের  মতিউর রহমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহের ২৫ বছরে তিনি তিন পুত্র সন্তানের মা হন। বর্তমানে প্রথম সন্তান পুলিশে চাকরি করে, দ্বিতীয় সন্তান কোরআনে হাফেজ এবং তৃতীয় সন্তান লেখাপড়া করছে। বিয়ের পর পরই তিনি অর্থনৈতিক অসচ্ছলতায় পড়েন। স্বামী বেকার হয়ে যাবার কারণে ঘর থেকে বের হয়ে ১৯৯৯ সালে একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি নেন। ২০০০ সালে ব্রাকে স্বাস্থ্যসেবা ও লিগ্যাল এইড এ আইন সেবিকা হিসেবে এবং পল্লীসমাজ এর সাথে যুক্ত হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সমাজে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে থাকেন। তিনি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এবং নারীদের উন্নয়নে উপজেলায় ব্যাপক অবদান রেখে যাচ্ছেন।

'শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী যে নারী'
কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার দলগ্রাম গ্রামের আব্দুল কাদের জিলানীর স্ত্রী আলেয়া বেগম।  ১০ ভাইবোনের মধ্যে সে ছিল নবম। বাবা কৃষি কাজ করতো অভাব-অনটনের মধ্যেই তাকে আস্তে আস্তে বড় হতে হয়েছে। অনেক অভাব অনটন এবং অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে ১৯৯৫ সালে এসএসসি পাস করেছে। বাবা মাকে বুঝিয়ে শুনে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করে ১৯৯৭ সালে এইচএসসি পাশ করে আলেয়া। টিউশনি করে এবং মা হাঁস-মুরগি বিক্রি করে ১৯৯৯ সালে বিএসএস পাস করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মা-বাবা বিয়ে দিতে চাইলে তাদেরকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে টিউশনি করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে এমএসএস ভর্তি হয় সে। ২০০১ সালে ব্রাহ্মণপাড়া সরকারি হাসপাতালে ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটি প্রোগ্রামে দুই বছর মেয়াদে একটি চাকরি হয় তার। চাকুরীর পাশাপাশি এমএসএস পরীক্ষা দেওয়ার পর সেখানে সফল ভাবে পাশ করে। ২০০৫ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় আলেয়া। স্বামীর পরিবারে এত বেশি সচ্ছল ছিল না, যার কারণে ২০০৬ সালে ব্র্যাকের শিক্ষা প্রোগ্রাম অর্গানাইজার হিসেবে তার চাকুরি হয়। চাকুরী হবার পর সে তার বাবা-মাকেসহ শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের আর্থিক সহায়তা করতে পারছে। এখন তাকে যৌথ পরিবারের সবাই খুব বেশি মূল্যায়ন করে। শিক্ষা ও চাকরির কারণে সে আজকে একটি ভালো অবস্থানে বসবাস করছে।

'নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোমে জীবন শুরু করেছে যে নারী'
কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা সদরের মন্তাজ মিয়ার মেয়ে সাহানা বেগমের  জন্ম হাজার ১৯৮৭ সালের ১৫ এপ্রিল। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে সে ছিল দ্বিতীয়। পিতা-মাতার অনুসারী থাকার কারণে তাকে সবাই স্নেহ করতো। প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে উঠার সাথে সাথেই তখনকার সমাজ ব্যবস্থার প্রচলিত নিয়মে মাতা-পিতার সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাল্যবিবাহের শিকার হয় সে। ২০০০ সালে সাহানা বেগম কসবা থানার কইখোলা গ্রামের লালমিয়ার প্রবাসীপুত্র মিজানুর রহমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় ।দাম্পত্য জীবনে এসে দুই সন্তানের জননী হয় সে। বিয়ের চার বছর সংসার জীবনে প্রথমে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অত্যাচার ও পরবর্তীতে স্বামী বিদেশ থেকে ফিরে এসে স্বামীর অত্যাচার সইতে না পেরে অসহায় দরিদ্র বাবার পরিবারে সন্তানসহ ফিরে আসে সাহানা। ২০০৪ সালে স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে দরিদ্র পিতার আশ্রয়ে এসে তার সংগ্রামী জীবন শুরু করে। নিজ বাড়িতে ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন এবং পাশাপাশি নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির পথ নাটকের সাথে যোগ দিয়ে সক্রিয়ভাবে বাল্যবিয়ে নারী নির্যাতন রোধে ভূমিকা পালন করতে থাকে। তখন স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তখন সে বাসা বাড়িতে কাজের পাশাপাশি একটি এনজিও কোম্পানিতে চাকরি নেয়। শত প্রতিকূলতার মাঝে সাহানা তার সন্তানদের নিয়ে ভাড়া বাসায় থেকে ছেলে এসএসসি ও মেয়ে দশম শ্রেণীতে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে তার তিন লক্ষ টাকা সঞ্চয় রয়েছে।

'অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী যে নারী'
কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার দুলালপুর গ্রামে জন্ম কাজল রেখার। ৪ ভাই ২ বোনের সংসারে বাবা সামান্য চাকরি করতেন। অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৯২ সালে তাকে বিয়ে দিয়ে দেন তার দাদা। বিয়ের তিন বছর পর স্বামী ছোট্ট একটি কাপড়ের ব্যবসার দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু করে। স্বামীর পাশাপাশি ১৯৯৭ সালে সেলাই মেশিনের কাজ শুরু করে সে ।  সন্তান ও সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। ২০০৮ সালে বিটিভির খবর থেকে জানতে পারে গরু-ছাগল হাস-মুরগী ও কাঁথা সেলাই করে স্বাবলম্বী হওয়া যায়। তারপর ২০০৯ সালে ৫০০ মুরগি নিয়ে একটি  ব্যবসা শুরু করে কাজল রেখা। অনেক প্রতিকূলতা, লাঞ্ছনা-বঞ্চনার মধ্যে সে সাহস করে ব্যবসা শুরু করে। ৫০০ মুরগি থেকে পর্যায়ক্রমে তা ৩৫০০ মুরগিতে উন্নত হয়। সে ১১০০ কোয়েল পাখি নিয়ে একটি খামার তৈরি করে। সেই খামারে দুইজন বেতনভুক্ত কর্মচারী রয়েছে। সংসারের সবাই তাকে সহযোগিতা করতে থাকে। ইতিমধ্যে খামারের আয় দিয়ে সে ৭ শতাংশ জমি ক্রয় ও  ৫ শতাংশ জমি ভরাট করেছে এবং ৪ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি ঘর তৈরি করেছে। সন্তানদের নিয়ে সে এখন খুব ভালোভাবে দিনাতিপাত করছে ।

'সফল জননী যে নারী'
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার দুলালপুর ইউনিয়নের বালিনা গ্রামে ১৯৬১ সালে জন্মগ্রহণ করেন রমুজা বেগম। ১০ ভাই বোনের সংসারে ছোটবেলায় তার বাবা মা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। ফলে স্কুলে পড়ার কোনো সুযোগ তার ছিল না। তার স্বামী ছিল একজন ভূমিহীন দরিদ্র বর্গাচাষী কৃষক। স্বামীর সংসারে শশুর শাশুড়ি ননদ দেবরকে নিয়ে অনেক দুঃখ কষ্টের সংসারে কোনো রকম জীবন অতিবাহিত করতেন তিনি। বিয়ের কয়েক বছর পর একে একে ছয় সন্তানের জন্ম হয় তার। দোচালা একটি ঘরে কোনরকমে স্বামী-সংসার নিয়ে জীবন-যাপন করেছেন। অনেক কষ্ট করে ভাঙ্গা ঘরের মধ্যে থেকে তিনি তার সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। শত প্রতিকূলতার মাঝে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। লেখাপড়ায় সব কয়টি সন্তান ছিল ভালো। সে কারণে তাদের লেখাপড়ায় উৎসাহ দিতে তিনি পছন্দ করতেন। জীবনে অনেক কষ্ট করে নিজে না খেয়ে সন্তানদের ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করেছেন। আজকে তার সেই ছয় সন্তান সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।