ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
আমার শহর ‘কুমিল্লা’
Published : Tuesday, 6 July, 2021 at 12:00 AM
আমার শহর ‘কুমিল্লা’শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
(২)
ষাটের দশকে আমার দেখা ‘কুমিল্লা শহর’।
    ১৯৬১ সালে কলেজে ভর্তি হই। কুমিল্লা জেলায় তখন তিনটি কলেজ- ভিক্টোরিয়া কলেজ, চাঁদপুর কলেজ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ। মুরাদনগরের শ্রীকাইলে দত্তরা যে কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘শ্রীকাইল কলেজ’ তখন বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া আমাদের এলাকার কেউ কেউ নারায়ণগঞ্জে তোলারাম কলেজে পড়তে যেতেন। চাঁদপুরে লজিং পাওয়া যেত, নারায়ণগঞ্জে টিউশনি পাওয়া যেত সেজন্য অনেকে ঐ দু’কলেজে পড়তে যেতেন। আমি আমার পিতার একান্ত ইচ্ছায় ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হই। আমার পিতাও এ কলেজের ছাত্র ছিলেন। এ কলেজে পড়লে মানের দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমপর্যায় এরূপ ছিল তাঁর মূল্যায়ন। কারণ, কলেজের অনেক অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি পেয়েও এ কলেজেই অধ্যাপনা করতেন। উল্লেখ্য, আমরা যখন কলেজে ভর্তি হই, তখন চর্থায় পরিত্যক্ত একটি অডিটরিয়ামে নবাবদের জায়গায় মহিলা কলেজের পঠনপাঠন কার্যক্রম শুরু হয়। ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যাপকবৃন্দ বিনা বেতনে বা সম্মানীতে কাস নিতে থাকেন। কথাটি বললাম এজন্য যে, বিজ্ঞান বিভাগ ও স্নাতক শ্রেণিতে ছাত্রী থাকলেও আই,এ কাসে আমাদের সহপাঠী হিসেবে ছাত্রী ভর্তি বন্ধ করে দেয়া হয়। কুমিল্লা মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠায় প্রশাসন বা ব্যক্তি উদ্যোগকে সম্মান জানিয়ে বলতে চাই, এ কলেজকে গড়ে তুলতে ভিক্টোরিয়া কলেজের কর্তৃপক্ষ ও অধ্যাপকদের সহযোগিতা ছিল অপরিশোধ্য। কারণ, এ কলেজটি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে কীনা এ নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। শুনেছি, মহিলা কলেজর প্রতিষ্ঠানকালীন ভিক্টোরিয়া কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপিকা লায়লা নূরকে অধ্যক্ষ হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল, তিনি সম্মত হননি, কাসও নেননি।
কলেজে ভর্তি হয়ে যখন কুমিল্লা শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই, বাড়ি থেকে তিন মাইল পায়ে হেঁটে গৌরিপুর বাসস্ট্যান্ডে আসতে হয়। সাথে যে বোঝাটি ছিল তা মাথায় করেই আসতে হয়েছে এবং বাসে (তখন বলা হতো মুড়ির টিন) ১২/১৪ আনা ভাড়ায় কুমিল্লা এসেছি। ইলিয়টগঞ্জ ও চান্দিনায় বাসটি অনেকক্ষণ অবস্থান করত, পরবর্তী বাস আসার শব্দ পেলেই রওয়ানা দিত। কথাটি বললাম এজন্য যে, ২৫ মাইল বাসের পথ অতিক্রম করতে ৪/৫ঘণ্টা লেগে যেত। সকালে বাড়ি থেকে রওয়ানা হয়েছি, বিকেলে কুমিল্লা শহরে, সারাটা দিন শেষ।
    শাসনগাছায় পৌঁছার পর রিক্সায় সুপারিবাগান। ভাড়া চার আনা। শাসনগাছায় তখন ওদুদ মিঞা সাহেবের পেট্রোল পাম্প ও দালান, ডাকবাংলো, ২/৪টি দোকান। যতক্ষণ না পুলিশ লাইন পাড় হয়েছি, উত্তরদিকে জেলখানা রোড নয়, কান্দিরপাড় রোডে প্রবেশ করেছি, ততক্ষণ পর্যন্ত শহরের বাতাস গায়ে লাগত না। রাস্তার দু’পাশে অস্থায়ী দোকানপাঠ, বাদশা মিঞার বাজারের কথা শুনেছি, তখন চোখে দেখিনি। রাস্তার পাশে ভগা মিঞার মটর গ্যারেজ, পুকুর ইত্যাদি সব। কান্দিরপাড় হলো কুমিল্লা শহরের রাজধানী। অন্যরকম পরিবেশ। উত্তরে বীরচন্দ্র নগরমিলনায়তন, কাব বলতে টিনের ঘর, টেনিস কোর্ট, কয়েকটি চা-স্টল, মধুডাক্তারের হোমিওপ্যাথ ডিসপেসারি, লির্বার্টি সিলেমা হল, উত্তর পাশে সাধনা ঔষধালয়, তারপর রাস্তার দক্ষিণ পাশে বনিক ব্রাদার্স, জাফর খান-এর মনোহারি দোকান, একটু অগ্রসর হলে নূরমিঞা বেকারি, নতুনঘর, করুণাভা-ার কাগজের দোকান, ভৈষজ্যভবন, টং-এর মনোহারি দোকান, দক্ষিণপাশে অধ্যাপক মনীন্দ্র মোহন দেব-দের বাড়ি, হাতে খড়ি কাগজের দোকান, লাভলি স্টোর, মায়াভা-ার, কালীবাড়ি, দক্ষিণ পাশে তিনটি মিষ্টিদোকান এভাবেই শহরের প্রধান পথ ধরে রাজগঞ্জ পেরিয়ে ছাতিপট্টি-সুপারিবাগান।
আমি তখন আস্তে আস্তে কলেজ পড়–য়া শহরবাসী হতে চলেছি। যে ছাত্রটি বাড়ি থেকে মাথায় সুটক্যাস ও বই-এর বা-িল মাথায় নিয়ে বাসষ্ট্যা-ে এসেছি, শহরে পৌঁছেই রিক্সায় উঠে গেছি। তখন বাবার দেয়া টাকাটার ওজন বেড়ে যেত, কেউ যখন নামের সঙ্গে ‘বাবু’ শব্দ যোগ করে সম্বোধন করত, তখন অবস্থা দাঁড়াত রাজসিক। তখনকার মানসিক উত্তরণের বিষযটি বর্ণনা দেয়ার মতো এত পড়াশোনা বা লেখালেখির পরও ভাষা সংকট যাপন করছি। কীভাবে বুঝাব? হাতে ধোয়া জামা-পাজামা। কতদিন? মনে পড়ে দ্বিতীয় বর্ষে যখন প্রথম মাখনজীন কাপড়ের প্যাণ্ট তৈরি করি, তখন তো আর হাতে ধোয়া কাপড় পরা যায় না। সুপারিবাগানের বাসায় ধোপা আসত, কাপড় নিয়ে যেত, তাদের আবাস চর্থায়। সপ্তাহান্তে দিয়ে যেত। একসপ্তাহের জন্য কাপড় যদি ধোপাবাড়ি থাকে, তাহলে পরার কাপড় এতটা কোথায়? তাই বজ্রপুরে সেকান্দর মিঞার ধোপাঘরে কাপড় দিলে তিনদিন পর পাওয়া যেত। ধোপা-ধোয়া কাপড় পরে কি স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করা যেত, নিশ্চয়ই নয়। ভাজ যেন ঠিক থাকে, সবসময় সচেতন থাকতে হতো। বসতে-চলতে সাবধানতা অবলম্বন করতে হতো, তা এখন কাউকে বুঝানো যাবে না।
বাবার টাকার ওজন বেশি, খরচ করতে গেলে প্রাণে বাজত, তারপরও কোনো কারণে একটি সিনেমা দেখতে দিয়ে পরে মনে মনে হাহাকারও করতে হয়েছে, তখন ভেতরটা কেঁপে উঠত। তখন মনে পড়ত বাবা-মার কথা। বাড়ি থেকে রওয়ানা হওয়ার সময় আশীর্বাদ করে বলতেন ‘লেখাপড়া করবে, মানুষের মতো মানুষ হতে চেষ্টা করবে। আপেতাপে পয়সা খরচ করবে না। বিদেশে থাকতে হলে টাকা পয়সার প্রয়োজন বেশি’ ইত্যাদি। তাই যখনই একটু বাড়তি খরচ করতে গেছি, এসব উপদেশ বাক্যগুলো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও তো সিনেমা দেখেছি। বিশেষত উত্তম-সুচিত্রার কোনো সিনেমা এলে তখন কোনো উপদেশই কার্যকর ছিল না। এমন কি আমার শহর ‘কুমিল্লা’য় কলেজে পড়তে এসে লিবার্টি সিনেমা হলে অপরাহ্নে সিনেমা আরম্ভ হওয়ার আগে মাইকে যখন মনকাড়া গানগুলো বেজে উঠত, তখন ভাবতাম, পড়াশোনা তুচ্ছ। যদি কোনো সিনেমা হলের গেইট কীপার অথবা কোনো ছোটখাট কর্মী হতে পারতাম তাহলে জীবনটা সার্থক হতো। এই অসার্থক জীবনকে বিসর্জন না দিয়ে পড়াশোনায় যখন মন দিলাম, তখন বুঝলাম, সিনেমার জগৎ বা জীবন কৃত্রিম। আসল জীবন তো পড়ে আছে সামনে, এ পথে হাঁটলেই গ্রামের ছেলের জীবনটাই সিনেমা হয়ে যাবে। তখন একটি উপদেশমূলক কথা কোনো একটি বই-এ পড়লাম। লিখেছে- একটি ছেলে কলেজে পড়তে এসে মেয়েদের পিছু নেয়। এ নিয়ে মহাকা-। একদিন একমেয়ে ছেলেটির বিরুদ্ধে শিক্ষকের কাছে নালিশ করে। শিক্ষক তাকে ডেকে এনে সত্যতা যাচাই করে কোনো শাস্তি না দিয়ে বলেন-‘শোন, ভালো করে পড়াশোনা কর, পাশ করে ভালো চাকরি কর, তখন কত মেয়ের বাপ তখন তোমার পিছনে ঘুর ঘুর করবে। যাও।’ এই উপদেশটি মনে ধরল এবং বাস্তবে তা দেখতেও পেলাম। আমার এলাকায় (নাম বলব না) একজন বি,এসসি পাশ করে যখন ভালো চাকরি পেল, কত মেয়ের বাপ পেছন নিল, তা তো দেখেছি। কাজেই সিনেমার দ্বারোয়ান হওয়ার সখ তখন থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। তারপরও ছাত্রজীবনে সিনেমা তো স্বপ্নের রাজ্যের দ্বিতীয় ঠিকানা। তবে রূপকথা-লির্বাটি হলে সিনেমা দেখেছি, পারত পক্ষে রূপালী হলে নয়। পরে এ নিয়ে বলব।
কলেজে পড়াকালীন বন্ধু-বান্ধব হয়েছে অনেক, তবে তা পোষাকী। অন্তরঙ্গ বন্ধুর সংখ্যা কম। আমার শহর ‘কুমিল্লা’য় যারা বাস করতেন, তারা শহরবাসী হলেও শহরটিকে আমার তখন শহর মনে হতো না। উন্নত গ্রামই বলব। হাতে গোনা দালান, অধিকাংশ টিনের ঘর, কেরোসিন তৈলের টিনে আলকাতরা দিয়ে ছাউনি বিশিষ্ট ঘর, মাটির ঘরও দেখেছি। আর ছিল প্রচুর পুকুর। পুকুরপাড়ে ছিল বসতি। পৌরবাসীর জন্য জলের ব্যবস্থা ছিল রাস্তার কান্দায় টেপে। দু’বেলা খাওয়ার জল নিত অনেকে। আর সব কাজ পুকুরের জল দিয়ে, পুকুরের জল খাওয়া না গেলেও অপরিষ্কার ছিল না, স্বচ্ছ ফটিকের মতো ছিল। পুকুরে স্নন ছাড়া কি তৃপ্তি মিটে? আমি সুপারিবাগানে গুহপরিবারে থাকি, বড় রাস্তা থেকে বাসায় ঢুকতেই একটি পুকুর। বাসার ভেতর আরেকটি পুকুর। আমি দু’পুকুরেই স্নান করেছি ছাত্রজীবনে।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমার বড় কাকা তাঁর শ্বশুর বাড়ি থেকে বিয়েতে পাওয়া ঘড়িটা আমাকে দিয়ে দেন। তখন ঘড়ি সচরাচর কেউ ব্যবহার করত না। কারণ সামর্থও ছিল না। বিষয়টি ছিল আভিজাত্যের। মোট কথা এই ঘড়িটি আমাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল সে সময়। আবার কষ্টও পেয়েছি। ঘড়িটি যখন অঘোষিতভাবে চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়, তখন আর তাকে প্রাণ সঞ্চার করা গেলো না। তারপরও তিনমাস হাতে ধারণ করেছিলাম। এ কথাগুলো উল্লেখ করলাম এজন্য যে তখনকার আমাদের দিনকালের পালাবদলে বিশেষত গ্রাম থেকে শহরে আসার পর যে বিবর্তন বা পরিবর্তন অথবা উত্তরণ তার প্রেক্ষাপট বুঝানোর জন্য।
(ক্রমশ)