নারায়ণগঞ্জের
রূপগঞ্জে হাসেম ফুড কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনায় একসঙ্গে এত শ্রমিকের
মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত। ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক। আমরা
জানি, দেশ এমনিতেই করোনা দুর্যোগের অভিঘাতে বিপর্যস্ত। এমনকি এ ভাইরাসের
সংক্রমণে শনাক্ত ও মৃত্যুহার বাড়ায় কঠোর লকডাউনে যখন অফিস-আদালতসহ বাইরের
প্রায় সব কাজ বন্ধ, তখন কারখানাগুলো চলছিল প্রশাসনের বিশেষ অনুমতিতে। এমন
এক সময়ে রূপগঞ্জের কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনা আমাদের বেদনা আরও বাড়িয়েছে।
বস্তুত আগুন লাগার দ্বিতীয় দিন শুক্রবারই ভয়াবহতা স্পষ্ট হয় ৪৯ মরদেহ
উদ্ধারের মাধ্যমে। ঘটনার দিন আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্যে আতঙ্কে
দিজ্ঞ্বিদিক ছোটাছুটি করা শ্রমিকদের আর্তনাদ যে কোনো সংবেদনশীল মানুষকেই
আহত না করে পারে না। এমনকি আগুন থেকে বাঁচতে ছাদ থেকে লাফ দিয়েও তিনজন
প্রাণ হারান। আমরা দেখছি, দেশে বিশেষত ঢাকায় প্রায়ই এমন বেদনাদায়ক
অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে এবং প্রায় প্রতিটি ঘটনায়ই আমরা এ সম্পাদকীয় স্তম্ভে
উদ্বেগ প্রকাশ করলেও অবস্থার উন্নতি স্পষ্ট নয়। রূপগঞ্জের খাদ্যপণ্যের
কারখানাটিতে দাহ্য পদার্থ থাকায় অগ্নিকা- আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে। বস্তুত,
বৃহস্পতিবার আগুন লাগার পর থেকেই ফায়ার সার্ভিস কাজ করলেও পুরোপুরি আগুন
নেভাতে সম হয়নি। বরং শুক্রবার দুপুরে এসে চতুর্থ তলায় যখন ফায়ার সার্ভিসের
কর্মীরা পৌঁছেন, তখনই হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
সেখান থেকে একের
পর এক মৃতদেহ বেরিয়ে আসার মর্মন্তুদ দৃশ্যে স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারি
হয়ে ওঠে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, আগুন লাগার সময়ও চতুর্থ তলার
ফোর তালাবদ্ধ ছিল। স্বাভাবিকভাবেই ফোরের তালা খুলে না দেওয়ায় শ্রমিকরা বের
হতে পারেননি, তাতে হতাহত আরও বেশি হয়েছে। কারখানাটিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক
শিশু শ্রমিক কর্মরত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি সংবাদমাধ্যম সূত্রে আমরা
জেনেছি, অনেক অভিভাবক তাদের এমন সন্তানদের খুঁজে এসেছেন, যাদের বয়স ১২ থেকে
১৫ বছরের মধ্যে। এই ঘটনাগুলোর সত্যাসত্য যাচাই করে কঠোর ব্যবস্থা নিতেই
হবে। রূপগঞ্জ থেকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া অধিকাংশ মৃতদেহের অবস্থা এতটাই
শোচনীয় যে, তাদের অভিভাবকদের কাছে হস্তান্তরের জন্য ডিএনএ পরীা করতে হবে। এ
ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। প্রতিটি দুর্ঘটনা
ঘটার পর তদন্ত কমিটি গঠন হয়ে থাকে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত কমিটির
প্রতিবেদন ঠিকভাবে প্রকাশ হয় না, কিংবা হলেও তাদের সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়
না। বিশেষত, শ্রমিকদের জন্য কর্মপরিবেশ নিরাপদ করার দাবি অনেক দিনের। সে
অনুযায়ী অনেকেই তাদের কারাখানা শ্রমিক ও পরিবেশবান্ধব করার ব্যবস্থা গ্রহণ
করেছেন। আমরা প্রত্যাশা করি, রূপগঞ্জের কারখানায় অগ্নিকা-ের জন্য গঠিত
তদন্ত কমিটি যথাযথ তদন্ত শেষে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। ভবনের ত্রুটিসহ
আগুন লাগার পেছনে দায়ীদের শাস্তির ব্যবস্থা করবে।
তবে সবকিছুর আগে
আহতরা যাতে উপযুক্ত চিকিৎসা এবং তিগ্রস্তরা যথাযথ ভাবে তিপূরণ পান, তার
ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা জানি, যেসব পরিবার স্বজন হারিয়েছে তাদের ফিরিয়ে
আনা যাবে না এবং কোনো কিছুতেই তাদের বিনিময় হতে পারে না। কিন্তু অসহায়
পরিবারগুলো যেন সাময়িক স্বস্তি পায় সেজন্য তিপূরণ যথাযথ হবে বলেই আমাদের
প্রত্যাশা। তবে আমরা কারখানাগুলোর নিরাপত্তায় জোর দিতে চাই। শ্রমিকের
শ্রমে-ঘামে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান যেন শ্রমিকের জন্য মৃত্যুকূপ না হয়। আর
যেন কোনো শ্রমিক কাজ করতে এসে এমন মর্মন্তুদ মৃত্যুর সম্মুখীন না হন, তা
নিশ্চিত করতেই হবে। ভবনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাসহ সার্বিক নিরাপত্তা
নিশ্চিতে প্রশাসনেরও তদারকির বিকল্প নেই। অগ্নিকা-ে মৃত্যু কতটা ভয়ানক তা
বলার অপো রাখে না। এতজন শ্রমিক কতটা কষ্টের মধ্যে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন,
তা আমরা অনুমানও করতে পারি না। এ ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি তারা যে
গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন এর সঙ্গে আমরাও একাত্মতা প্রকাশ করছি।