খালেদ চৌধুরী ||আপনি নাক বরাবর হাঁটলে একটা পুকুর
দেখবেন। তার পাশে আরেকটা পুকুর। আপনি দেখবেন একটা পুকুরে জল আছে। আরেকটা
পুকুরে চৈত্রের খরা। পাশের পুকুরটা জলপুকুরের কবর। পুকুরেরও কবর হয়! এই
ফাঁকে আপনার মাথার ওপর দিয়ে বাজ পাখি উড়ে যায়। স্বভাব বুঝেন? স্বভাবই সব
ঠিক করে দেয়। স্বভাবের জন্য কাক হয়েছে উচ্ছিষ্ঠজীবী আর কবুতর হয়েছে গৃহী।
কবুতর নিরীহ পাখি তাই তাকে যদি গৃহী ভাবেন ভাবতে পারেন। পাখিদের মধ্যে
সংগঠকের স্বভাবটা কাক পেয়েছে। মানুষ কবুতরকে কাছে রাখে কাককে দুর দুর করে।
আপনি বলবেন, কাক নোংরা। শুয়োর কিন্তু খাবারের টেবিলে। সব কিছুই কসা মাংসের
স্বাদ বুঝলেন।
আচ্ছা কাক চাষ করলে কেমন হয়। কাকের ডিম ও মাংস বেশ
উপাদেয়। চীনা প্লাস্টিকের ডিম না-খেয়ে কাকের ডিম তো সুস্বাদু। আচ্ছা আপনি
যে বুড়োর কাছে যাচ্ছেন, আপনি কী জানেন-তার চিকিৎসা পদ্ধতি। বৃদ্ধ গল্প
শুনিয়ে চিকিৎসা করে। যদি একটা গল্পে হয়ে যায়। আপনাকে আর গল্প শুনতে হবে না।
আর যদি দুটো গল্পের দরকার হয়-আপনাকে তার বাড়িতে রাত্রি যাপন করতে হবে।
জোড়া
পুকুরপাড়ে যে গাব গাছ দেখেছেন তার বয়স দুইশ বছর। এ গাছে কেউ কোপ মারে না।
কয়েকজন সাহস দেখিয়েছিল। প্রত্যেকেই মুখে রক্ত বমির সাক্ষ্য রেখে মারা গেছে।
এই গাছে একটা পানক সাপ থাকে। সাপটার দাড়ি আছে। এই বৃষ্টির দিনে আপনি ঘেমে
গেছেন। একটা কাজ করেন। গাব গাছের নিচে একটু বসেন। বসলেই দেখতে পাবেন লেংটা
টেডি একটা ছেলে আপনার দিকে আসছে। তার এক হাটে লেবেন চুষ আরেক হাতে ইঙ্গটা
ধরে রেখেছে। এ গায়ের মানুষরা তার বাঁকা ইঙ্গটাকে সুবোধ শিশুর বাইরে আর কিছু
ভাবে না। কেউ একজন বলেছে, নির্বোধ ছেলেটা নিষ্পাপ। যে কথা বলতে পারে না।
তার পাপ নেই। কেউ একজন বলেছে, তার ইঙ্গে তেল মেখে দিলে মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়।
আপনি ভাবছেন মশকরা করছি। আপনি কী আমার শালা লাগেন। আপনার তো দেখছি রস নাই।
হাসেন না কেন? হাসেন। এর মধ্যে কার্তিক দাস আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে যায়। আপনি
যে নাক বরাবর হাঁটছেন। আপনি জানেন, কীভাবে যাবেন? আপনাকে রাজামেহার যেতে
হবে-সেখানেই গল্পবুড়োর বাস। তার আগে আপনাকে চুলাশ বাজার অতিক্রম করতে হবে।
সেখানেই কার্তিক দাসের বাড়ি। কার্তিক দাসের অনেক কষ্ট। ভাবতে পারেন তাঁর কী
কষ্ট? কার্তিক দাসের সঙ্গে এ গাঁয়ের কেউ কথা বলে না। লোকে বলে তাকে দেখলে
নাকি যাত্রা হয় না। গ্রামবাসী তাকে এক শালিক বানিয়ে রেখেছে। সেদিন রহমত
মেম্বার মেয়ের জন্য পাত্র দেখতে যাচ্ছিল। পথে কার্তিককে দেখে বাড়ি ফিরে
আসে। বিজ্ঞান পড়–য়া নবম শ্রেণির নাতনি তাকে বলে দাদা আর কতকাল কুসংস্কার
বিশ^াস করবা। বিজ্ঞানের কথা বলায় গ্রাম্য মেম্বার পুনরায় রওয়ানা হয়।
পাত্রের বাড়িতে মেম্বারকে চরম অপমানিত হতে হয়।
জ্ঞানের কথা কখনো গম্ভীর
হয় না। পাখির পালকের মতো হালকা অথবা তুর পাহাড়ের মতো ভারী হয়। আপনি সেই কখন
থেকে হাঁটছেন। কী করবেন বলুন। কিছু পাওয়ার জন্য একটু কষ্ট তো করতেই হয়।
কোথাও চিকিৎসা করে যখন ভালো হচ্ছে না। গল্পবুড়োর কাছে গিয়ে দেখেন। শেষ
চিকিৎসা। যদি কিছু একটা হয়। টাকা তো আর কম খরচ করলেন না। শুধু মাত্র গল্প
শুনে রোগ ভালো হলে মন্দ কী। একটা কথা কি জানেন? আজ পর্যন্ত এ গায়ের কেউ
জানে না। বুড়ো কী গল্প বলে। গল্পবুড়ো কানেমুখে গল্পটা বলে। রোগীকে শর্ত
দেয়া থাকে সে কারও কাছে গল্প বলতে পারবে না। যদি বলে তাহলে তার মৃত্যু হবে।
আমরা বুড়োর ওপর প্রচ- বিরক্ত। তিনি কেন আমাদেরকে গল্পটা বলেন না। কোনো
কোনো সময় মনে হয়ে বেটাকে খুন করি।
আরে মিয়া আপনি দ্রুত হাটেন। না-হলে
কবিরাজের বাড়িতে পৌঁছাতে পারবেন না। আপনি তো হাঁপিয়ে উঠেছেন। রাজামেহার
বাজার গিয়ে প্রথমে মোস্তাফার দোকানে এক কাপ লাল চা খাবেন। আর জসিমের দোকান
থেকে ২টা কাকড়া পুরি। আপনি পুরি খাবার সময় উপকথা শুনবেন। খবরদার কান দিবেন
না। আপনি কালীপদ কবিরাজের কথা শুনবেন। তিনিও একজন আধ্যাত্মিক চিকিৎসক। চা
স্টলে আপনি কবিরাজের অনেক কেরামতির কথা শুনবেন। তখন আপনার মনে হবে-চামড়া
বটা বুড়োর কাছে না গিয়ে কালীর কাছে গেলেই ভালো। তাহলে আপনি ভুল করবেন।
আপনাকে
যদি কেউ প্রশ্ন করে কোথায় যাবেন? খবরদার উত্তর দিবেন না। আপনি বোকা
থাকবেন। যদি পাকনামি করেন তাহলে রাজামেহার বাজারের সবাইকে চা-বিস্কুট
খাওয়াতে হবে। তখন মাইকে ঘোষণা করা হবে। রাজামেহার গ্রামের ভোটার সংখ্যা কত
জানেন? ২৫ বছরের পুরানো রোগ সারাতে এসেছেন-একটু খরচ তো করতে হবে। আর হাঁটতে
পারছেন না। পা ফুলে গেছে। বাসায় গিয়ে বউকে বলবেন, সরিষার তেল মেখে দিতে।
আপনিও মাঝেমাঝে বউয়ের পায়ে তেল মেখে দিবেন।
লোকটা সেই কখন থেকে বকবক
করছে। মৌন থেকে কবিরাজের কাছে যেতে হয় তাই তাকে কিছুই বলতে পারছি না।
মাগরিবের আজানের ঠিক আগে-পশ্চিম আকাশ কমলার রঙ ধারণ করে। সুরা ফাতেহা, সুরা
এখলাছ তিনবার পড়ে একটা ফুঁ দিলাম। বাতাসে ধোঁয়ার কু-লি ভাসিয়ে লোকটা নাই
হয়ে যায়।