ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
করোনাকালে নাগরিক দায়িত্ব
Published : Sunday, 11 July, 2021 at 12:00 AM
করোনাকালে নাগরিক দায়িত্বশেখর ভট্টাচার্য  ||
কঠোর, সীমিত কিংবা সর্বাত্মক লকডাউন যে নামেই আমরা অভিহিত করি না কেন, করোনার বিস্তার রোধ করতে হলে করোনাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি আমাদের যে পরামর্শ দিয়েছে, তা মেনে চলতে হবে। সরকারের ওপর সম্পূর্ণ দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে কোনোভাবেই করোনা সংক্রমণের গতি কমানো যাবে না। জীবন-জীবিকার ভারসাম্য রায় সরকার দৃঢ় ভূমিকা রেখে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে চলছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের ক্রমবর্ধমান এই বিস্তারকালের সব পদেেপর ল্য হলো জীবিকার কথা বিবেচনা করে জীবনকে রা করা। প্রাথমিক পর্যায়ে করোনা সংক্রমণের গতি কমিয়ে দেওয়া এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে নানামুখী সুরা ব্যবস্থা গ্রহণ করে সংক্রমণকে ধীরে ধীরে থামিয়ে দেওয়া।
করোনার প্রথম ঢেউ মোকাবেলায় বাংলাদেশ যে যথেষ্ট দতার পরিচয় দিয়েছিল, এ বিষয়টি বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞসহ আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষজ্ঞরা স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। গত মার্চ মাস থেকে সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করে। সম্প্রতি বিশেষজ্ঞরা এই বাড়ার কারণ হিসেবে তিনটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন। বিষয় তিনটি হলো—স্বাস্থ্যবিধি না মানা, আক্রান্তদের কোয়ারেন্টিনে বা আইসোলেশনে না যাওয়া এবং ডেল্টা ভেরিয়েন্টের অতিমাত্রার সংক্রমণের প্রবণতা। জুন মাসটি যেন দেশবাসীর জন্য এক মহাতঙ্কের মাস ছিল। এ মাসে চার দিনের ব্যবধানে করোনায় এক দিনের সর্বোচ্চ মৃত্যু এবং এক দিনের সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত করা হয়। জুলাই মাসের প্রথম দিন থেকে অবস্থা আরো অবনতির দিকে যেতে শুরু করে। এদিন মৃত্যুহার জুন মাসের রেকর্ড ভঙ্গ করে। জুলাই মাসের ১ তারিখে সর্বমোট ১৪৩ জন মানুষ করোনার কারণে মৃত্যুবরণ করে। আমরা জানি না ধীরে ধীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুসংখ্যার গ্রাফ কতটুকু ওপরে উঠবে।
সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, আমরা যত দিন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় শৌখিন খেলোয়াড়দের মতো শৌখিন ভাব দেখাব, মৃত্যু এবং আক্রান্তের গ্রাফ ওপরের দিকে উঠতেই থাকবে। জুলাই মাসের ৪ তারিখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কঠিন লকডাউন চলাকালে জানাল, করোনার সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, দেশে ডেল্টা ভেরিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ হয়েছে। এর ফলে প্রথমে সীমান্তবর্তী জেলা এবং পরে সেসব জেলা থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পাশের জেলাগুলাতেও এর বিস্তার ঘটেছে। পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনার সংক্রমণ রোধে বিধি-নিষেধ আরোপের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং ব্যক্তি পর্যায়ে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নে শিথিলতার কারণেই বিস্তারের গতি দ্রুত হচ্ছে।
করোনার প্রথম ঢেউয়ে আমরা দেখেছি, রাজধানীতে সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর হার ছিল সবচেয়ে বেশি। রাজধানী থেকে অদৃশ্য ভাইরাসটি ধীরে ধীরে দেশের অন্য প্রান্তে ছড়িয়েছে। এবারের ভয়ংকর দ্বিতীয় ঢেউয়ের সূচনা কাল থেকেই আমরা দেখছি, সংক্রমণ প্রবাহটি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হয়ে পড়েছে। এবার সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাসের সংক্রমণ। প্রথম ঢেউয়ে সংক্রমণ মূলত ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল। এবারের সংক্রমণ দেশব্যাপী। এই দেশব্যাপী দ্রুত সংক্রমণের প্রধান কারণ হচ্ছে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট। আর আমরা সংক্রমণের পালে হাওয়া দিয়েছি রোগটির যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে, সামাজিকভাবে ছোট-বড় সমাবেশে যোগ দিয়ে। স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট সংক্রমণের গতিকে বাড়িয়ে দেওয়ার কিছুটা দায় যে আছে আমাদের কিছুসংখ্যক দায়িত্বহীন নাগরিকের—এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শুধু কঠোর লকডাউন দিয়েই কি ভয়ানক ডেল্টা ভেরিয়েন্টের গতি শ্লথ করা যাবে? মনে রাখা উচিত, দেশে করোনায় আক্রান্তদের নমুনায় ডেল্টা ভেরিয়েন্ট মে মাসে ৪৫ শতাংশ ও জুন মাসে ৭৮ শতাংশ পাওয়া যায়। বর্তমানে দেশে করোনা সংক্রমণে ভয়ানক ডেল্টা ভেরিয়েন্টের প্রাধান্যের কথা আমাদের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান জনগণকে অবহিত করে একধরনের সাবধানতার বাণী উচ্চারণ করেছে।
আমরা যদি শুধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে চলতাম, তাহলে এখন প্রতিদিন শতাধিক মানুষের মৃত্যুর মতো দুঃখজনক ঘটনাকে এড়িয়ে যেতে সম হতাম। প্রধানমন্ত্রী ৩ জুলাই সংসদ অধিবেশনে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঢেউকে রোধ করার জন্য কঠোর লকডাউন চলাকালে সবাইকে ঘরে থাকার অনুরোধ করেন। প্রয়োজনে ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া হবে—এ অঙ্গীকারও তিনি সংসদ অধিবেশনে দৃঢ়কণ্ঠে ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশের মতো দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমানোর জন্য একজন রাষ্ট্রনেতা আর কিভাবে জনগণের পাশে থাকতে পারেন?
আমাদের জাতীয় পরামর্শক কমিটি নিজেদের বিশ্লেষণের পরিপ্রেেিত ২৪ জুন সংবাদমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সংক্রমণ ও রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং জনগণের জীবনের তি প্রতিরোধে সারা দেশে কমপে ১৪ দিন সম্পূর্ণ ‘শাটডাউন’-এর সুপারিশ করে। করোনাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির পরামর্শ সরকার যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার চেষ্টা করেছে। এই পরামর্শ সংবাদমাধ্যমে আসার পরপরই একে ‘যৌক্তিক’ বলে উল্লেখ করেছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। জীবন-জীবিকাসহ নাগরিকদের সার্বিক মানসিক প্রস্তুতির কথা মাথায় রেখে প্রথম পর্যায়ে ২৮ জুন থেকে সীমিত পরিসরে লকডাউন শুরু করে সরকার। জাতীয় পরামর্শক কমিটি তাদের পরামর্শ সরকারের কাছে পেশ করেছিল ২৪ জুন। সরকার পরামর্শক কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে দ্রুত সাড়া দেয়। সুপারিশ পেশের মাত্র তিন দিন পর সরকার সীমিত পরিসরে লকডাউন বাস্তবায়নের জন্য পদপে গ্রহণ করে। সীমিত পরিসরে লকডাউন ঘোষণার পরপরই সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণাও প্রদান করা হয়। কঠোর বিধি-নিষেধসংবলিত এই লকডাউন সর্বাত্মক নিবেদন নিয়ে পালিত হতে থাকে জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে। প্রাথমিকভাবে জুলাই মাসের ৭ তারিখ পর্যন্ত লকডাউন বলবৎ থাকার নির্দেশ দেওয়া হলেও সর্বাত্মক এই লকডাউনকে করোনার ক্রমাগত বিস্তার রোধে আরো এক সপ্তাহ বাড়িয়ে ১৪ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত বর্ধিত করেছে সরকার।
করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে, একই রকম দায়িত্ব আছে নাগরিকদের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যেমন দায়িত্বের সঙ্গে দায়ও আছে, একইভাবে সব মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত প্রয়াসের প্রয়োজন আছে। করোনার ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিলকে থামাতে হলে সরকারি মন্ত্রণালয়গুলোকে যেমন ‘টিম ওয়ার্ক’ করতে হবে, একইভাবে নাগরিকদেরও সচেতনতা এবং নিজেদের সুরা প্রদর্শন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ রকম অতিমারি কখনো বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে মোকাবেলা করা যায় না। এ রকম অতিমারির সময়েই জাতীয় সংহতি দেখানোর শ্রেষ্ঠ সময়। আমরা বিরোধী কোনো দলের সক্রিয় প্রয়াস দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের দেশে অজস্র নাগরিক সংগঠন আছে, তাদেরও তাৎপর্যপূর্ণ কোনো ভূমিকা ল করা যাচ্ছে না। সরকারের প থেকে সর্বাত্মক লকডাউন বা কঠিন বিধি-নিষেধ প্রদান হলো করোনা সংক্রমণ প্রশমনে সরকারের প থেকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়, সব রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের যুদ্ধকালীন নিবেদন নিয়ে এগিয়ে আসা খুব জরুরি। মনে রাখতে হবে, নগরে আগুন লাগলে দেবালয় রা করা যায় না। সরকারি প্রয়াস যেমন সর্বাত্মক আন্তরিকতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে হওয়া উচিত, একইভাবে কাদা ছোড়াছুড়ি না করে, সব ভেদাভেদ ভুলে নাগরিক সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠনের লকডাউনের মতো সর্বাত্মক সংহতি প্রদর্শন সময়ের দাবি। মনে রাখতে হবে, দিনের শেষে জনগণের সালতামামির খাতায় সবার কর্মকা-ের হিসাব কিন্তু লেখা থাকবে। আমরা এখন সব অংশীজনের সর্বোচ্চ ত্যাগ, সক্রিয় ভূমিকা দেখার অপোয় আছি।
লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও কলাম লেখক