ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
মৃত্যু কিনি ঘামের দামে
Published : Sunday, 11 July, 2021 at 12:00 AM
মৃত্যু কিনি ঘামের দামেতুষার আবদুল্লাহ ||
কারখানার চিমনি দেখলে চোখে জল আসে। মন খারাপ হয়ে যায়। বুক শূন্য শূন্য লাগে। কী যেন, কাকে যেন হারাচ্ছি এমন মনে হয়। ছোটবেলায় খেলার মাঠ থেকে একজন একজন করে বন্ধু কমতে থাকে। ওরা মাঠ থেকে গিয়ে ঢুকে পড়তো কারখানায়। তখন গুলশান, তেজগাঁও, রামপুরা, মহাখালী, মিরপুরের দালানে দালানে গার্মেন্টস। বন্ধুরা ওই গার্মেন্টসগুলোতে সকাল-রাত কাজ করে। কেউ কেউ অন্য কারখানাতেও গেছে।
তেজগাঁও শিল্প এলাকার বেশিরভাগ কারখানায় আমার পড়া ও খেলার সাথীরা ছিল। সকাল ৮ টায় কারখানায় ঢুকে ওভারটাইম শেষ করে যখন রাত ১০/১১টায় বাড়ি ফিরতো হেঁটে হেঁটে তখন আমি দেখতে পেতাম কান্ত, বিধ্বস্ত কিছু যন্ত্রকে। ভয়ে থাকতাম এই বুঝি কোনও যন্ত্রাংশ য়ে পড়ে। না, হাজার দেড়েকের কড়কড়ে নোটের লোভে পরদিন আবার তারা ছুটে যেত কারখানায়। স্কুল বেঞ্চের পাশে বা খেলার মাঠে আর কখনও ওই বন্ধুদের ফিরে পাইনি। তেজগাঁও শিল্প এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখেতাম কারখানার চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আমার কাছে মনে হতো,ওই ধোঁয়া আমার বন্ধুদের দগ্ধ হয়ে পুড়ে যাওয়ার বাস্প।
এতদিনে আমার বন্ধুদের কলকব্জা য়ে গেছে। তাদের কারো কারো সন্তানও একই জীবন চক্রে কারখানা মুখি। কেউ কেউ পাতে খাবারের জোগান ঠিক রাখতে শিশু বয়সেই সন্তানকে কারখানায় ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছে। মেশিনের কালির মতোই তাদের শৈশব বিবর্ণ। এর মধ্যে আগুনে দুর্ঘটনায় পুড়ে মরেছে একজন। অঙ্গহানি ঘটেছে কারো কারো। ওদের জীবন একদম গা ঘেঁষে দেখা আমার। তাই যখন তাজরীন পুড়ে, ধসে পড়ে স্পেকট্রাম, রানা প্লাজা, চুড়িরহাট্টার কেমিক্যাল, গাজীপুরের ফোম কারখানা কিংবা সেজান জুস কারখানায় বন্দি শ্রমিকেরা যখন কারাগারের বন্দির মতো পুড়ে মরে, মনে হয় আমার বা আমার কোনও বন্ধুর সন্তান পুড়ে ‘কাবাব’ হলো। কিংবা আমার কোনও খেলার সাথীর কঙ্কাল ভিজে আছে দমকলের জলে।
কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনা নতুন নয়। প্রতিবছরই একাধিক ভয়াবহ অগ্নিকা-ের সাী হয়ে থাকছি। অভিজাত এলাকার অফিসেও দেখেছি মানুষ পুড়তে। দিন শেষে তো সকলেই শ্রমিক আমরা। কারখানা থেকে করপোরেট অফিস সকল জায়গাতেই নিরাপত্তার ছুঁতোয় আমাদের বন্দি করে রাখা হয়। কারাগারের বন্দিদের সঙ্গে আমাদের তফাৎ নেই। শ্রম বিক্রি করে আমরা মৃত্যু কিনি।
আমাদের দফতরের শেষ নেই। তদারকির হাঁকডাঁকও অনেক। কমিটি অফুরন্ত। প্রতিবেদন দিস্তার পর দিস্তা। কিন্তু সবই যেন সাদা কাগজ। ছাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে উড়ে যায় আমাদের শোক। তাই কাটে না শ্রমিকের বন্দি দশা। হাজিরা খাতার মতোই শ্রমিক, মৃত্যু সবই সংখ্যা মাত্র। তাই বরাবরই মালিকেরা দুঃসাহস দেখায়- কারখানা থাকলে মানুষ থাকবে, আগুন লাগবে, মানুষ পুড়বে। এতে মালিকের কী দোষ। মৃত্যু মুছে দিয়ে আবার তারা গড়ে তোলে পুঁজির সৌধ।
শুধু অপরাধী মালিকেরা নন। যারা তাদের অপরাধ ও দুর্নীতির সঙ্গী, সেই সেবা দফতরের কর্মী-কর্তারাও রয়ে যায় বিচারের সীমানার বাইরে। ফলে দুর্নীতির চক্র ও তাদের অপকর্ম প্রবাহমান। মুনাফার ছিটে ফোঁটা দিয়ে বদলে যায়, ভুলিয়ে দেওয়া হয় মৃত্যুর সংখ্যা, দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া মালিক, ব্র্যান্ডের নাম। কিন্তু সন্তানকে খুঁজতে আসা বাবা-মা, বাবা কিংবা মাকে খুঁজতে আসা সন্তান ভুলতে পারে না আগুনে দগ্ধ হওয়া, জীবন বাঁচাতে উঁচু ভবন ঝাঁপ দেওয়া প্রিয়জনের ওই মুহূর্তের বিপন্নতাকে,ধসে পড়া দেয়ালের নিচে চাপা পড়া প্রিয়জনের শেষ নিশ্বাসটি বুকে নিয়ে তারা বেঁচে থাকতে চায়। কিন্তু জীবন বিক্রি করা সেই সংখ্যাগুলোকে জলের দরে তিপূরণ দেওয়ায়, মৃত ও কর্মহীন হয়ে মানুষগুলো জীবনের আরও নির্মম কারাগারে নিিেপত হয় মাত্র।
জুস কারখানার ৫২ জনকেও আমরা ভুলে যাবো। শোকের আয়ু ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই। আমরা যেমন এইতো সেদিন মগবাজারে বিস্ফোরণে নিহত ৬ জনকেও ভুলে বসে আছি। মগবাজারতো চলছে আগের মতোই মৃত্যু ঝুঁকি নিয়েই। কারখানাও চলছে, চলবে দুর্ঘটনার সকল আয়োজন সঙ্গী করেই। কারণ এখানে মৃত্যু একেবারে সস্তায় ঘামের দামে পাওয়া যায়।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী