স্কুল ছেড়ে ‘নরককুন্ডে’
Published : Sunday, 11 July, 2021 at 12:00 AM
মহামারীর ধাওয়ায় স্কুল ছেড়ে কারখানায় ঢুকেছিল রোজিনা। আগুনে সেখান থেকেও প্রাণ বাঁচাতে হয়েছে লাফিয়ে পড়ে। গালে-মুখে সেলাই আর হাতে-পায়ে আঘাত নিয়ে তিনি এখন হাসপাতালে। গত বৃহস্পতিবার হাসেম ফুডস কারখানার দোতলায় রোজিনা টোস্ট বিস্কুট প্যাকেট করার সময়ই আগুনটা লাগে। বের হওয়ার একটি মাত্র খোলা সিঁড়ি দিয়েই উঠে আসছিল লেলিহান শিখা। তিনি জানান, উপায় না পেয়ে দুই তলা থেকেই লাফিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচায়।
রোজিনার বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইলে। সেখানেই স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়তেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে বোন আর দুলাভাই নারায়ণগঞ্জের বাসায় নিয়ে আসেন। ৫ হাজার ৬০০ টাকা বেতনে একটি কাজও জুটে যায়।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় হাসেম ফুডসের কারখানায় বৃহস্পতিবারের আগুনে রোজিনার মতো অনেক প্রাণে বেঁচে গেলেও অর্ধশতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী প্রাণ হারিয়েছে।
সজীব গ্রুপের এই কারখানায় জুস এবং বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী তৈরি করা হতো। এক মাস আগে আরও একবার এ কারখানায় আগুন লেগেছিল বলে জানায় ১৫ বছরের রোজিনা।
রূপগঞ্জের ইউএস-বাংলা হাসপাতালে রোজিনার মতো আঘাত নিয়ে ভর্তি আছে একই কারখানার আরও সাতজন। এদের মধ্যে ছয়জনই কিশোরী, যাদের বয়স ১৪ থেকে ১৭ বছর।
অগ্নিকা-ের পর এই কারখানা শিশু শ্রমিকদের কাজে লাগানোর বিষয়টি প্রকাশ্য হয়েছে।
আগুন লাগার সময় দোতালায় বসে টোস্ট বিস্কুট প্রক্রিয়াকরণের কাজ করছিলেন সোমা। এই কিশোরী জানান, এসি রুমের ভেতর কিছু শোনা যায় না। হঠাৎ একটা ছেলে বলে আগুন লেগেছে। তখন সুপারভাইজার তাদের নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ায়।
দোতলা থেকে নামার আর কোনো পথ ছিল না। তাই জানালা দিয়েই লাফিয়ে পড়েন সোমা। নিচে পড়ে হাত ভেঙে যায়, পায়েও গুরুতর আঘাত পায়।
সোমা বলেন, “১৫-২০ দিন আগে কারখানায় আরেকবার আগুন লেগেছিল। উপরের তলায় আগুন লাগার পর নামতেও দেওয়া হয়নি। ওই আগুনটি কারখানার কর্মীরাই নিভিয়ে ফেলে।”
কিছুদিন আগেই পাঁচ তলায় আগুন লাগার কথা জানায় একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হাসেম ফুডসের আরেক কর্মী রুমাও। তখন তারা নিচ তলায় ম্যাংগো বার প্যাকেজিং এর কাজ করছিল।
সেবার আগুন লাগার পর ফ্লোর থেকে বের হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “সুপারভাইজাররা আমাদের আগুনের খবর জানিয়েছিল, তারা বলে কিছু হবে না, তোমরা কাজ কর।”
ছয়তলা কারখানার নিচতলায় জ্যাম জেলি সেকশনে নয় মাস ধরে কাজ করেছেন ১৫ বছরের রুমা। তার ভাষ্য, “আগুন লেগেছিল দোতলায় নুডলস সেকশনে। সেখানে আমার চার মামাতো বোন কাজ করত।”
আগুন লাগার খবরে বোনদের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে রুমা দোতলায় ছুটে যায়। কিন্তু সেখানে তাদের পাননি। দোতলায় যাওয়ার পর আর নামার পথ পাচ্ছিলেন না। ধোঁয়ায় ছেয়ে যাচ্ছিল চারদিক।
উপায়ান্তর না পেয়ে দোতলা থেকে লাফ দিয়েছিলেন এই কিশোরী কর্মী। এতে তার বুকের পাঁজর ভেঙে যায়। পা ও কোমরেও গুরুতর আঘাত পান।
হাসপাতালে রুমার পাশে বসে থাকা মা সালমা বলেন, “ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ত রুমা। এমন সময়ে করোনার কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে তাকে জামালপুরের তারাকান্দি থেকে ঢাকায় নিয়ে এসে এই কারখানায় কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়।”
তিনি জানান, একই কারখানায় রুমার আরও চার মামাতো বোন কাজ করতো। ওদের সবার বয়স ১৪ থেকে ১৭ এর মধ্যে। ওরা দোতালায় কাজ করত। তবে আগুন লাগার পর নিরাপদে বের হতে পেরেছে সবাই।
কোমরে আঘাত নিয়ে একই হাসপাতালে শয্যাশায়ী কারখানার প্রোডাকশন সুপারভাইজার ২৬ বছরের আশরাফুল ইসলাম। নরসিংদী পলিটেকনিক থেকে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পাশ করে তিনি ৬ হাজার টাকা বেতনে সেখানে কাজ করতেন।
লিচি এবং লাচ্ছি সেকশনে কাজ করা আশরাফুল বলেন, “আমি তিনতলায় ছিলাম। আগুন লাগার পর ধোঁয়ায় কিছু দেখা যাচ্ছিল না। নিচে দেখি কারখানার ফর্ক লিফটটি উঁচু করে ধরে লোকজনকে উদ্ধারের চেষ্টা করছেন চালক।
“দোতালার কর্মীরা ফর্ক লিফট এ পা রেখে নামছেন। আমিও ফর্ক লিফট বরাবর লাফ দেই। লাফ দিয়ে ফর্ক লিফটে ড্রপ খেয়ে টেনিস বলের মতো মাটিতে আছড়ে পরি।”
পেশাগত জীবনের শুরুতেই এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হয় মুষড়ে পড়েন এই তরুণ প্রকৌশলী। তিনি জানান, কিছু দিন আগেও একবার আগুন লেগেছিল। তখন তিনি অন্য ভবনে ছিলেন।
শনিবার দুপুর ১টার দিকে রূপগঞ্জের এই হাসপাতালে আহতদের দেখতে আসেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহ নুসরাত। এসময় তিনি আহতদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে দেন।
এসময় কারখানায় শিশুশ্রমিকদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে একাধিক তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত করে শিশুশ্রম ও অন্যান্য গাফিলতির বিষয়গুলো প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”