করোনা অতিমারিতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা সংকটে রয়েছে, তা বোঝার জন্য সময়সীমাই যথেষ্ট- প্রায় দেড় বছর ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম না থাকার কারণে অন্তত তিনটি শিক্ষাবর্ষের সূচি যেভাবে তিগ্রস্ত হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা কঠিন। মঙ্গলবার সমকালে প্রকাশিত শীর্ষ প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞরা যথার্থ বলেছেন যে, আন্তরিকতা থাকলে এই কঠিন পরিস্থিতিরও উত্তরণ সম্ভব। আমরা দেখেছি, এরই মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী অনলাইনে এবং রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ শিক্ষার্থীই অনলাইন কিংবা দূরশিক্ষণে অংশ নিতে পারেনি। একই সঙ্গে এই মাধ্যমে শিক্ষার অর্জনও সন্তোষজনক নয় বলে বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপ প্রতিবেদনে এসেছে। তাছাড়া অনলাইন শিক্ষার প্রভাবে মোবাইল-কম্পিউটার ডিভাইস ও ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তিসহ শিক্ষার্থীদের এক ধরনের মানসিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। ফলে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আমরাও এক মত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলাই অগ্রাধিকারে নিতে হবে। ন্যূনতম সুযোগ থাকলেও প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। ইউনিসেফের সূত্রে সমকালের আলোচ্য প্রতিবেদনে প্রকাশ, বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মতো এত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে অল্প ক'টি দেশে। এমনকি এ তালিকায় দণি এশিয়ায় একমাত্র দেশ বাংলাদেশ। পৃথিবীর বিপুল অধিকাংশ দেশেই যেখানে বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে এবং প্রয়োজনে করোনার সংক্রমণ বাড়ায় আবার বন্ধ করেছে, সেখানে আমাদের শিক্ষা প্রশাসন কেন এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সে প্রশ্ন করা অসঙ্গত নয়। আমরা দেখেছি, করোনার ঊর্ধ্বমুখী দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয় এ বছরের মার্চ থেকে। তার আগে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে প্রায় সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। তখন স্বাস্থ্যবিধি মানা, শ্রেণিকে দূরত্ব বজায় রাখাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যেত। এমনকি কোথাও করোনা সংক্রমণ দেখা দিলে পুনরায় বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়ে হলেও পরীা গ্রহণসহ আনুষ্ঠানিক শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করা যেতো। অথচ তা না করে শিক্ষার্থীদের পাঁচটি পাবলিক পরীা বাতিল করা হয়েছে। পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিকসহ তার নিচের দিকের সব শিক্ষার্থীকে 'অটোপাস' দেওয়ার মাধ্যমে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তরণের যে ব্যবস্থা করা হয়, তাও সমালোচনাযোগ্য। সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, এভাবে পাস করার পরও অনেকেই নতুন শ্রেণিতে এখনও ভর্তি হননি। তার মানে করোনার ফলে নতুন করে ঝরে পড়া, বাল্যবিয়েসহ আরও নানাবিধ সংকট স্পষ্ট হচ্ছে। অস্বীকার করা যাবে না, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টিতে জোর দিচ্ছে। সে জন্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের করোনার টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করছে প্রশাসন। আমরা চাই, শিক্ষা প্রশাসনের সর্বস্তরের শিক-কর্মচারীদেরও দ্রুত টিকার আওতায় আনা হোক। অতিসম্প্রতি জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ এবং জাতিসংঘ শিক্ষাবিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো যথার্থ বলেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য আর অপো করা যায় না। এমনকি সংস্থা দুটি বলছে, স্কুলে প্রবেশের আগে টিকাদান বাধ্যতামূলক না করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উচিত যত দ্রুত সম্ভব শ্রেণিকে এসে শিক্ষার্থীরা যাতে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে- সেই ব্যবস্থা করা। চলমান শিক্ষার সংকট কাটানোর পদপে হিসেবে সিলেবাস সংপ্তিকরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য শ্রেণিক প্রস্তুতকরণ এবং দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারের শিশুদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। দেশে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি ঊর্ধ্বমুখী। চলমান লকডাউন ঈদের জন্য শিথিল হলেও পরে আবারও কঠোর বিধিনিষেধ বলবৎ থাকবে বলে সরকারের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে। তবে যখনই লকডাউন শিথিল করা হবে, অন্য সব প্রতিষ্ঠান খোলার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টিও অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ায় কিনা তা প্রমাণিত নয়, সেখানে এভাবে দিনের পর দিন শিক্ষার্থীদের ছুটি বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই।