ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপরিষদের অন্যতম সদস্য ড. এল মুরুগান। কিন্তু তার পিতা লোগানাথন (৬৮) ও মা এল ভারদাম্মাল (৫৯) এখনও অন্যের ক্ষেতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ছেলে মুরুগান তাদেরকে সঙ্গে রাখতে চেয়েছেন, কিন্তু আধুনিক জীবনধারার সঙ্গে তারা মানিয়ে উঠতে পারেন না। এ জন্য ছেলের সঙ্গে চারদিন থাকার পর নিজেদের গ্রামে চলে এসেছেন। আবার অন্যের ক্ষেতে কাজ শুরু করেছেন।
ছেলে মন্ত্রী, এতে তাদের জীবনধারায় কোনোই পরিবর্তন আসেনি। তারা চান নিজেদের পায়ে নিজেরা দাঁড়াতে।
পত্রিকাটি আরো লিখেছে- এল ভারদাম্মালের (৫৯) মাথার ওপর টগবগে সুর্যের রোদ। তার মধ্যেই তিনি তামিলনাড়ুর নামাক্কাল জেলার কোনুর গ্রামে এক ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করছেন। ঝোপঝাড় পুরিষ্কার করছেন। তার পরনে একটি লাল শাড়ি। গায়ে ময়লাযুক্ত বোতামওয়ালা একটি শার্ট। লাল তোয়ালে মাথায় পেচিয়ে রেখেছেন। এর পাশেই আরেকটি ক্ষেতে তার স্বামী লোগানাথন (৬৮) মাটির ঢেলা ভাঙছেন। খবর টাইমস অব ইন্ডিয়ার।
মাটি সমান করছেন। তাদের সন্তান এল মুরুগান ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হলেও সেই উৎসব তাদের স্পর্শ করেনি। তারা এখনও ক্ষেতে কাজ করে খান। ছেলের থেকে নিজেরা আলাদা থেকে স্বাধীন জীবনযাপনকে বেছে নিয়েছেন। নিজেদের শরীর থেকে ঘাম ঝরানো উপার্জন দিয়ে খাবার যোগাড় করেন।
এতে বলা হয়, শনিবার ওই কোনুর গ্রাম সফরে যান সাংবাদিক। গ্রামের ভূমিঅধিপতি তাদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি নিয়ে দেন। সাংবাদিকের সামনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে হাজির হলেন ভারুদাম্মাল। তিনি বললেন, আমার ছেলে যদি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়, তাহলে আমার তাতে কি করা উচিত? তার ছেলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রীপরিষদের অংশ হয়েছে বলে তিনি গর্ব করেন। এজন্য নিজে কোনো কৃতীত্ব দাবি করেন না। ভারুদাম্মাল বলেন, তার ক্যারিয়ার গড়ার জন্য আমরা তো কিছুই করিনি।
এই দম্পতি অরুণথাতিয়ার নামের একটি দলিত সম্প্রদায়ের। নামাক্কালের কাছেই অ্যাসবেস্টসে তৈরি ছাদের নিচে ছোট্ট ঘরে বসবাস তাদের। তারা দু’জনেই কুলি। দিনমজুর। তারা বন্ধুদের সঙ্গে কাজ করেন। যেখানে কাজ পান, সেখানেই চলে যান। তাদের সন্তান ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী- এর কোনো প্রভাবই নেই তাদের জীবনে। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে যখন এই খুশির খবর শুনেছেন, তখন তাদের খুব আনন্দ হওয়ার কথা। কিন্তু খবর শোনার পরও তারা মাঠের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কাজ বন্ধ করেননি।
মুরুগানকে ২০২০ সালের মার্চে তামিলনাড়ু রাজ্যে বিজেপির প্রধান নিয়োগ করা হয়। এরপর বাবা-মার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কোনুর গ্রামে গিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন ভক্তরা। ছিল পুলিশি নিরাপত্তা। কিন্তু মুরুগানকে কোনো বাহুল্য না দেখিয়ে তারা শান্তভাবে গ্রহণ করেন। যদিও তাদের সন্তানের অর্জনের জন্য গর্বিত, তবু একরোখাভাবে তারা স্বনির্ভর অর্থাৎ নিজেরা ছেলে বা অন্যের ওপর নির্ভর করেন না।
৫ বছর আগে তাদের ছোট ছেলে মারা যান। এরপর থেকে তারা সেই পুত্রবধূ ও তার সন্তানদের দেখাশোনা করছেন। পিতা লোগানাথান বলেন, শৈশব থেকেই পড়ালেখার প্রতি খুব ঝোঁক ছিল মুরুগানের। চেন্নাইয়ের আম্বেদকর ল কলেজে পড়াশোনা করতে যাওয়ার আগে সরকারি স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে সে। সে সময় তিনি বন্ধুদের কাছ থেকে অর্থ ধার নিয়ে ছেলেকে দিয়েছিলেন। মুরুগানের কলেজের পড়ার খরচ যুগিয়েছিলেন।
চেন্নাইয়ে নিজের সঙ্গে থাকার জন্য পিতা-মাতাকে অনুরোধ করেছিলেন মুরুগান। ভারুদাম্মাল বলেন, আমরা একবার তার (মুরুগান) সঙ্গে চারদিন ছিলাম। মুরুগানের যে ব্যস্ত লাইফস্টাইল তার সঙ্গে আমাদের জীবনধারা মানাসই নয়। তাই আমরা কোনুর গ্রামে ফিরে এসেছি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় স্থান পাওয়ার পর তাদের ফোন করেছিলেন মুরুগান। এ খবর শুনে লোগানাথন এবং ভারুদাম্মাল তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, রাজ্য বিজেপির প্রেসিডেন্ট হিসেবে যে পদ পেয়েছিলে, এই পদ কি তার চেয়ে বড়?
ওই গ্রামের ভূমিস্বামী কেজসাথাম্বুর পালানিস্বামী। তার জমিজমায় বেশির ভাগ সময় কাজ করেন এই দম্পতি। তিনি বলেছেন, এই দম্পতির ছেলে কেন্দ্রীয় একজন মন্ত্রী হয়েছেন। তারপরও তাদের জীবনধারায় বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসেনি। লোগানাথান যথারীতি তার কাজে যোগ দেন।
একই গ্রামের বাসিন্দা বসু শ্রীনিবাসন বলেছেন, রাজ্য সরকার যখন করোনার সময়ে সাহায্য বিতরণ করছিল, তখন স্থানীয় রেশনের দোকানে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন লোগানাথন। আমরা তাকে লাইনের বাইরে গিয়ে রেশন নিতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি। এই দম্পতি সাধারণ জীবনযাপনের জন্য সবার কাছে পরিচিত। আরও মজার বিষয় হলো, তাদের একখণ্ড জমি পর্যন্ত নেই। তারা বলেন, জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নিজেদের পায়ের ওপর দাঁড়াতে চান। তারা বলেন, আমাদের ছেলে উচ্চ পদে পৌঁছেছে। এজন্য পিতামাতা হিসেব আমাদের কাছে যথেষ্ট।