
অজয় দাশগুপ্ত ||
নৈতিকতা
এক সময় ভূষণ ছিল সমাজের। আমাদের জীবন ছিল প্লেইন লিভিং আর হাই থিংকিংয়ের
আদর্শে এক সরল জীবন। আমরা এখন ব্যাকডেটেড মানুষ। পুরনো যুগের অচল মাল। সেটা
যেমন জীবনযাপন, পোশাক, খাদ্য কিংবা কথায় টের পাই, তেমনি মনে করিয়ে দেয়
নানা ঘটনার আকস্মিক ধাক্কা। এ এক আজব যুগ। এখন কোন্টা নৈতিক কোন্টা অনৈতিক
বোঝা দায়। শিশু-কিশোর-তরুণ-তরুণীকে দোষারোপ করি আমরা। ভাবি যুগের প্রবাহে
তারা নানা ধরনের আজগুবি কা- ঘটায়। তাদের ভাষা, পোশাক আমাদের চোখ পীড়ার কারণ
হয়। আসলে কি তা সত্যি? আমরা যখন যৌবনের শুরুতে বেলবটম প্যান্ট পরতাম তখনও
আমাদের অভিভাবকরা বিস্ময়ের চোখে তাকাতেন। ভাবতেন এ আবার কী রে বাবা! হঠাৎ
নিচের দিকে এসে ঢোলাঢালা এ এক আজব পাতলুন। এটাও ঠিক হিল দেয়া জুতা না পরলে
সে পাতলুনের নিচের দিকটা ময়লা-আবর্জনা কুড়িয়ে নিত মহানন্দে। এমন সব ঘটনা যে
কোন সমাজে ঘটে। পরিবর্তন মানুষকে মানতে হয়। আর পরিবর্তনের ভেতর দিয়েই
মানুষ পৌঁছে যায় আধুনিকতায় নতুন কোন গন্তব্যে। সম্প্রতি আমাদের দেশে
যতগুলো অঘটন আর মুখরোচক কাহিনী তার পেছনে ক’জন তরুণ-তরুণী আছে আসলে? সব
ঘটনার নেপথ্যে মধ্যবয়সী পুরুষ কিংবা নারী। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত পুরুষ
মানেই এখন যৌনতার ইন্ধন কিংবা অপকর্মের নায়ক। কেউ কাউকে ভোগ করে, কেউ কাউকে
প্ররোচনা দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ বা লুটপাট করে সংবাদ শিরোনাম হয়। আর নারীরা কি
পিছিয়ে? নৈতিকতার কথাই যদি বলেন দেখবেন তার দেয়াল এরাও ভেঙ্গে ফেলেছে অনেক
আগে। কেউ লুটপাট, কেউ মধুচক্রের হোতা, কেউ কেউ রাজনীতির নামে দাঁড়িয়ে
গিয়েছিল সমাজে মাফিয়া হয়ে। এদের একেকজন যখন ধরা পড়ে আমরা অবাক হই। এমন সরল
ভাবনার কি আসলে কোন মানে হয়?
প্রত্যেকটি ঘটনা মিডিয়ায় বের হয়ে আসার পর
দেখা যায় এসব নারী-পুরুষের বাড়িতে পাওয়া যায় বিয়ার বা মদের বোতল। কোনটা
খালি আবার কোনটা আধাভর্তি। পাওয়া যায় হরিণের চামড়া বা এমন জাতীয় কিছু। হয়ত
পাওয়া যায় । প্রশ্ন থেকে যায় এসব কোথায় ছিল এতদিন? কেনইবা কর্তারা এসব
জানতেন না? আর জানলেও কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল? আইন তার নিজস্ব গতিতে চলুক।
হোক বিচার। আসল কথা আমরা চাই সব ধরনের দুর্নীতি ও অপরাধমুক্ত দেশ এবং
সমাজ। ভাবনাটা এদের নিয়ে যতটা তারচেয়ে অধিক আরও এক ঘটনায়। আমি একটু পেছন
ফিরে তাকাতে চাই।
প্রাইমারী ও হাইস্কুলের পর কলেজ জীবন। এটুকু আমার
জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আজ এই শ্রেষ্ঠতার কারণ বুঝি। প্রাইমারী স্কুলে আমাদের
শিক ছিলেন অভিভাবকের চাইতেও বড়। তারা আমাদের কাছে দেবতুল্য। বুঝতে না
পারলেও এটা জানতাম এরাই মানুষের বীজতলা তৈরি করেন। ভয় পেতাম তাদের। ভয়
পেতাম মার খাব বলে। মাঝে-মধ্যে তাদের স্নেহ আর ভালবাসা বয়ে যেত নদীর ধারার
মতো। এরপর হাইস্কুল জীবন। সে মাস্টার মশাইরাও ছিলেন আমাদের অভিভাবক। আমাদের
ইংরেজী স্যার ছিলেন কড়া একজন মানুষ। তার অনেক নির্দেশনার মধ্যে একটি ছিল
জামার হাত গুটানো যাবে না। লম্বা হাতের যে কোন জামার আস্তিন গুটানো থাকলে
হয় প্রহার, নয়ত বকা। তিনি আমাদের অভিভাবকদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতেন। যে কোন
অভিযোগ বা পড়াশোনার ঘাটতির কথা অভিভাবকদের বলতেন। মাঝে মাঝে তার ভাষা পথ
হারাত বটে; কিন্তু সেগুলো এখন হাসির খোরাক মাত্র। বড় জোর এই ‘কুলাঙ্গার’
ছেলেকে নিয়ে কি করবেন আপনারা? বা এই ‘ছাগল’ তো মানুষ হবে না। এমন কঠিন কঠোর
মানুষটি আমাদের স্কুল শেষ হওয়ার দিন কাসে এসেছিলেন একটা লম্বা ছিপছিপে বেত
নিয়ে। আমরা সবাই অবাক। শেষদিনও তিনি আমাদের মারবেন নাকি? সে দিনটি আমি
কখনও ভুলব না। কাস শেষ হয়েছিল কান্না আর ভালবাসা দিয়ে। সে বেতটি তিনি টুকরো
করে ভেঙ্গে কেঁদে দিয়ে বলেছিলেন, এটা দিয়ে তোদের অনেক মেরেছি। শুধু একটা
কারণে, তোদের মানুষের মতো মানুষ বানাতে চেয়েছি। তার কান্না আমাদের এই কথা
বলেছিল, কঠিন হলেও এরাই তোমাদের আলোর দিশারী।
দিনকাল পাল্টেছে। এখন এমন
সব কথাবার্তা ফাঁস হয় যা শুনে আমরা লজ্জায় মুখ লুকাই। দেশের নামকরা
স্কুল-কলেজের স্বনামধন্যদের মানুষ এখনও অভিভাবক মানে। জানে এদের কাছে তাদের
সন্তানদের ভবিষ্যত গচ্ছিত। ছেলেমেয়েরা এদের কাছেই শিখবে নৈতিকতা। সম্প্রতি
কি দেখছি, কি শুনছি আমরা? আমি কারও ব্যক্তিগত নিন্দা বা বিদ্বেষ ছড়ানো
লেখার উপজীব্য মনে করি না। আমার একটাই প্রশ্ন, যত বড় আঘাত আর রাগ এসে ভিড়
করুক, আমাদের ভাষা তার সীমা ছাড়াবে কেন? বিষয়গুলো দুইদিক থেকেই ভাবা দরকার।
একদিকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ফাঁস আর বেইমানি। অন্যদিকে কঠিন এক নিদারুণ
বাস্তবতা। যাদের আমরা ছোটলোক বলে তুচ্ছ করি তারাও এই ভাষায় কথা বলে না। বরং
আজ দেখা যাচ্ছে তারাই ভদ্রলোক। আর আমাদের শেষ আশ্রয় অভিভাবকের চাইতে বড়
মাস্টারদের আচরণ ও কথা অসংযত।
জিহ্বা এমন একটা অঙ্গ যা বত্রিশ পাটি কঠিন
শক্ত দাঁতের ভেতর নিরাপদে থাকতে পারে। যে দাঁতগুলো মাংস চিবিয়ে হাড্ডি
টুকরো করে থাকে তাদের ফাঁকে জিহ্বার নিরাপদ থাকাকে তার নমনীয় অবস্থানের
কারণে। সেই জিহ্বা নিয়ে চমৎকার লিখেছেন সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। আর
আমরা সবাই জানি এই এক ফালি জিনিসটা সময়মতো তলোয়ারের চাইতেও বেশি শক্তিশালী।
এ যেমন মায়া-ভালবাসা-প্রেম বাড়াতে পারে, কাউকে দুশমন থেকে বন্ধু করে তুলতে
পারে, তেমনি পারে বন্ধুকে দুশমন করে ছাড়তে। তার জন্য খুব বেশি সময়ের দরকার
হয় না। আমাদের সমাজে, দেশে, রাষ্ট্রে বহু খ্যাতিমান মানুষের সবর্নাশ হয়েছে
শুধু জিভের কারণে। তবু আমরা একে বাগে রাখতে ভুলে যাই।
অহঙ্কার,
রাজনৈতিক দম্ভ আর জিভের অসংযততায় আজ যখন সবাই কমবেশি আক্রান্ত তখন
বাল্যপাঠের সেই বাণী মনে পড়ে। যেখানে বলা হয়েছিল: স্বীয় জিহ্বাকে শাসনে
রাখিবে। এ কথা না মানলে যে কি হয় তাও আমাদের অজানা নয়। নৈতিকতার এই স্খলন
বিপজ্জনক । দেশ ও জাতির জন্য এর সুরা আজ জরুরী।
[email protected]