কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলায় জীবন সংগ্রামে সফল পাঁচ জয়িতা
Published : Thursday, 2 September, 2021 at 12:00 AM
অদম্য ইচ্ছা শক্তির কারণে তাদের কাউকে দমাতে পারেনি নিজের লক্ষ্য থেকে। তাঁরা দীর্ঘ লড়াই ও সংগ্রাম করে টিকে থেকেছেন সমাজে। নিজেদের প্রচেষ্ঠায় তাঁরা আজ প্রতিষ্ঠিত। তাদেরকে এ অবস্থায় আসতে স্বীকার করতে হয়েছে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা। সমাজের নানা কুসংস্কার ও বাধা অতিক্রম করে তাঁরা প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে জানিয়ে দিয়েছেন তাদের অস্তিত্বের কথা। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলায় আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস-২০২০ উদযাপন উপলক্ষে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় এর উদ্যোগে ‘জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ’ কার্যক্রমের আওতায় পাঁচটি ক্যাটাগরিতে পাঁচজন সফল নারী নির্বাচিত হয়েছেন। যারা বেগম রোকেয়ার আদর্শকে ধারণ করে সমাজে সকল প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁরা হলেন-অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী আনজুমানারা বেগম, শিক্ষা ও চাকুরির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন কারী নারী মিনু রানী শীল, সফল জননী নারী হিসেবে সাফল্য অর্জনকারী নারী গীতা রানী পাল, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোমে জীবন শুরু করা নারী মোসাঃ সেলিনা আক্তার ও সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখা নারী ফাতেমা বেগম মজুমদার। তাঁদের জীবন সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত গল্প জানাচ্ছেন মো. মিজানুর রহমান।
আনজুমানারা বেগম
নারীর চলার পথের অনেক রকম বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে জয়ের পাথে এগিয়ে চলেছেন আনজুমানারা বেগম। গলিয়ারা দক্ষিণ ইউনিয়নের শুভপুর গ্রামে জন্মেছেন তিনি। পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। তিন ভাই ও এক বোনের সংসারে কোন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন না। ১৯৯২ সালে এসএসসি পাশ করে গ্রামের নিরক্ষর লোকদের অক্ষরজ্ঞান দান করা শুরু করেন। পাশাপাশি সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে বিনামূল্যে গ্রামের কিছু অসহায় দরিদ্র মহিলাদের কাজ শিখিয়ে তাদের কর্মের ব্যবস্থা করেন। এরই মাঝে বিয়ে হলেও সংসারের পাশাপাশি ১৯৯৭ সালে বি.এ পাস করেন। গ্রামের মহিলাদের সাথে নিয়ে “যশপুর মহিলা কল্যাণ সমিতি” গঠন করেন। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর হতে নিবন্ধন নিয়ে সমিতির সদস্যদের ব্লক ও বাটিক, হাঁস-মুরগী ও গাভী পালন, সবজি ও মৎস্য চাষের উপর প্রশিক্ষণ করিয়ে আনেন বিভিন্ন সরকারী দপ্তর হতে। প্রশিক্ষণ শেষে তারা সকলে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এদেরকে নিয়েই গ্রামে নারী নির্যাতন এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, মাদকদ্রব্যের কুফল ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সক্রিয় কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। তাঁর নিজের বাড়ীতে গাভী পালন এবং মৎস্য চাষ করে তিনি বর্তমানে সুখী জীবনযাপন করেছেন।
মিনু রানী শীল
গরীব কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহনকারী মিনু রানী শীল, স্বামী সুভাষ চন্দ্র শীল, গ্রাম-কৃষ্ণপুর, বিজয়পুর ইউনিয়ন। লেখাপড়া করাতো দূরে থাক নিয়মিত পুষ্টিকর খাবারই খেতে পেতেন না। লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। এসএসসি পাশ করার পর আথিক অনটনের কারণে বাবা যখন বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন তখন তিনি তার মায়ের সহযোগিতায় বিয়ে বন্ধ করে নিজের পায়ে দাড়ানোর স্বপ্নকে এক ধাপ এগিয়ে নিতে সক্ষম হন। টিউশনির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে এইচএসসি-তে ভর্তি হন এবং ভাল রেজাল্ট নিয়ে পাশও করেন। এরপর বিয়ে হয় এবং শশুরবাড়িতে এল পুনরায় লেখাপড়ায় বাধা আসে। পরবর্তীতে তাঁর স্বামীর সহযোগিতায় কুমিল্লা অজিতগুহ কলেজ হতে বি.এ পাশ করে লাইব্রেরী সাইন্সে ডিপ্লোমা কোর্স সম্পূর্ণ করেন এবং বিজয়পুর মহিলা কলেজে চাকুরীতে যোগদান করেন। এরপর আর থেমে থাকেননি। চাকুরীরত অবস্থায় ঢাকা এশিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে লাইব্রেরী সাইন্সে এম.এ পাশ করেছেন। বর্তমানে তিনি শুধু আর্থিকভাবেই স্বচ্ছল নন তাঁর বেতনের টাকায় তাঁর ছেলের উচ্চশিক্ষার খরচ ও মেটাতে পারছেন।
গীতা রাণী পাল
দুই ছেলে এবং এক মেয়ের জননী গীতা রাণী পাল। স্বামী জগদীশ চন্দ্র পাল, উত্তর বিজয়পুর, বিজয়পুর ইউনিয়ন। সংসারে মাটির বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরী করে বাজারে বিক্রির মাধ্যমে কোনরকম দিন চলে। এক সময় দ’ুবেলা ঠিকমত খাবারও খেতে পারতেন না। তবুও ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে স্বাবলম্বী করার ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখতে পারেননি। এনিয়ে অনেকে বিরুপ মন্তব্যও করেছেন। তবুও থেমে থাকেননি তিনি। সমাজের স্বচ্ছল ব্যক্তিদের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে তাদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর বড় ছেলে লালমাই ডিগ্রী কলেজ থেকে বি.এ পাশ করে বর্তমানে এসএসএস নামে এনজিওতে কর্মরত রয়েছেন। ছোট ছেলে ঢাকা কলেজ থেকে এম.এ পাশ করে বর্তমানে ওয়ান ব্যাংকে কর্মরত রয়েছেন। তার একমাত্র মেয়ে লেখাপড়া শেষে বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে রয়েছেন।
সেলিনা আক্তার
জীবনের সাথে যুদ্ধ করে বেড়ে ওঠা লড়াকু এক নারীর নাম মোসাঃ সেলিনা আক্তার। পিতা মৃত নুরুল হক, গ্রাম-মঙ্গলমুড়া, বারপাড়া ইউনিয়ন। বাবার দশ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারে মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানো যার জন্য অসম্ভব ছিল। বান্ধবীদের কাছ থেকে বইপত্র এবং নোট ধার করে নিয়ে লেখাপড়া চালাতেন। এরই মধ্যে ৭ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় বাবা অসুস্থ হয়ে পরলে বড় ভাই সংসারের হাল ধরেন অনেক কষ্টে এসএসসি পাশ করার পর পরিবার হতে বিয়ে দেয়া হয় তাঁকে। শ^শুরবাড়ির নতুন অধ্যায় ও শুরু হয় নির্যাতন দিয়ে। নানা অজুহাতে অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুনতে হতো বিভিন্ন সময়ে। গায়ের রং কালো বলে তাঁকে তার স্বামীর অযোগ্য মনে করা হতো। গালাগালি সহ্য করতে না পেরে এক সময় রাগ করে বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন অন্তঃসত্ত্বাবস্থায়। নির্যাতনের কথা চিন্তা করে সবাই পেটের সন্তানকে নষ্ট করার পরামর্শ দিলেও তিনি তা করতে রাজি হননি। সন্তানের মুখ দেখে স্বামী হয়ত সংশোধন হতে পারেন বলে আশা করছিলেন। সালিশের মাধ্যমে সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার কথা বললেও তাঁর বড় ভাই সে কথা না মেনে লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলার খরচ নিয়ে মা এবং বড় ভাইয়ের মধ্যে বাকবিতন্ডা দেখে তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন সন্তানের জন্ম হলে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবেন। তাঁর একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান জন্ম নেয় কিছুদিন পর। কিন্তু তাঁর কন্যা সন্তানের চিকিৎসা খরচ চালাতে তাঁর ভাই অস্বীকৃতি জানালে তিনি গোপনে শাশুড়ির সাথে যোগাযোগ করেন। শাশুড়ি তাঁকে সন্তানসহ তাদের বাড়িতে চলে আসার পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ মেনে শ্বশুর বাড়ি চলে যান। এলাকার সাধারণ মানুষ একসাথে হয়ে জানতে চান কেন তিনি সেখানে গেলেন। সারাদিন পার হয়ে গেলেও মা অথবা বড় ভাই কেউ তার কোন খোঁজ-খবর নেননি। দিনশেষে ভাত খেতে বসলে তাঁকে তিনটি ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্প এনে দেয়া হয় স্বাক্ষর করার জন্য। প্রচুর কান্নাকাটি করে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালেও তাঁরা জোরপূর্বক তাতে তাঁর স্বাক্ষর নিয়ে সন্তানকে রেখে তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। তাঁর চাচী শাশুড়ীর মাধ্যমে খবর পেয়ে বাবার বাড়ির লোকজন মিলে পুনরায় সালিশ বসান। সালিশে এসে তিনি জানতে পারেন যে, জোরপুর্বক-স্বাক্ষর নেয়া স্ট্যাম্পে লেখা হয়েছে তিনি স্বেচ্ছায় মামলা উঠিয়ে নিয়েছেন, দেনমোহরের টাকা বুঝে পেয়েছেন এবং সন্তানকে তাঁদের কাছে রেখে চলে এসেছেন। সালিশকারী লোকজন তার শ্বশুরের কাছ থেকে স্ট্যাম্পটি নিয়ে নেন এবং তিন দিনের জন্য তাঁকে সন্তানসহ একটি বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সালিশের দিন দুপুর বেলা গোপনে তিনি স্ট্যাম্পটি খুঁজে বের করে ছিড়ে ফেলেন এবং ছেঁড়া অংশগুলো তাঁর ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেন। রাতে সালিশে সকল পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেনমোহর আদায়পূর্বক তাঁর তালাকের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং তিন মাসের শিশু সন্তানকে জোরপূর্বক রেখে দেয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি জানতে পারেন যে, তাঁর মেয়েকে পালক দেয়া হয়েছে কারও কাছে। আজও তিনি জানেন না যে সেই আদরের সন্তান কোথায় আছে। কার কাছে আছে, কি অবস্থায় আছে। ছোট ফুটফুটে সন্তানটির মুখটি বুকে ধারন করে মানসিক বিপর্যস্ততা কাটিয়ে শুরু করেন নতুন যুদ্ধ। সকলের প্রেরণায় বন্ধ হয়ে যাওয়া পড়াশোনা আবারও শুরু করেন। পাশাপাশি আশা নামক এনজিও’র সহযোগিতায় একটি কোচিং সেন্টার খুলে সেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানো শুরু করেন। এইচএসসি পাশ করে কুমিল্লা মহিলা কলেজে অনার্সে ভর্তি হন। বর্তমানে ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী তিনি। এরই মধ্যে সেলাইয়ের কাজও শেখেন এবং অন্যান্য মেয়েদের শেখাতে থাকেন। বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে প্রচার প্রচারণা চালান। কোচিং ও প্রাইভেট পড়ানোর পাশাপাশি ০১ টি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়াচ্ছেন একই সাথে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হতে তিন মাসের নার্সিং ট্রেনিং ও গ্রহণ করেছেন। তাঁর আয়ের টাকা দিয়ে বর্তমানে মায়ের চিকিৎসা ও ছোট বোনের পড়াশোনার খরচ বহন করছেন।
ফাতেমা বেগম মজুমদার
গলিয়ারা দক্ষিণ ইউনিয়নের ফুলতলী গ্রামের ফাতেমা বেগম মজুমদার একজন সংগ্রামী নারীর প্রতিকী নাম। পিতার মুত্যুর কারণে অষ্টম শ্রেণী পাশ করা মাত্র ১৪ বছর বয়সে তাকে বিয়ে দেয়া হয়। দুই কন্যা সন্তানের জননী তিনি। ছোট মেয়ের বয়স যখন আট মাস তখন তাঁর স্বামী মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর শশুর তাঁকে দুই মেয়েসহ বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেন। এরকম অসহায় অবস্থায় কাজের সন্ধানে বের হলে কুমিল্লা কেটিসিসি হতে এক বছর সেলাই প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে একটি সেলাই মেশিন ক্রয় করেন। এরপর নগরীর চকবাজার কাপড়িয়াপট্টিতে একটি দোকানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন ধরণের পোশাক তৈরী করে সরবরাহ করতে থাকেন। ১৯৮৬ সালে আনোয়ারা কুটির শিল্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে গ্রামের দরিদ্র ও অসহায় নারীদের নিয়ে ফুলতলী গ্রাম উন্নয়ন মহিলা কুটির শিল্প এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলেন। এই কেন্দ্রে নারীদের সেলাই, এমব্রয়ডারী, উল, বুননের কাজ, বাঁশ ও বেতের কাজ, মাছ ধরার জাল বুননের কাজ, নকশী কাঁথা, ওয়ালম্যাট তৈরীর কাজ শেখানো হয়। এদেরকে নিয়ে তিনি গ্রামে বৃক্ষরোপন অভিযান, নারী ও শিশু নির্যাতন ও পাচার প্রতিরোধ এবং বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণা চালান এর পাশাপাশি উপজেলা আনসার ও ভিডিপি অফিস, প্রাণীসম্পদ অফিস, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসসহ বিভিন্ন সরকারী দপ্তর হতে বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অন্যদেরও শেখানোর ব্যবস্থা করেছেন। এলাকার নারীদের স্বাবলম্বী হতে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি সরকারী বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তিতে সহযোগিতা করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে ও সমাজের বিভিন্ন অসহায় দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করেছেন। এরই মাঝে ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের মহিলা সদস্য হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বর্তমানে তাঁর দুই মেয়েও সমাজে প্রতিষ্ঠিত এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী।