এরশাদুল আলম প্রিন্স ||
আগামী ১২ সেপ্টেম্বর থেকে সারাদেশের প্রাথমিক থেকে উ”চ মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদান শুরু করা যাবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তবে, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কোনও সিদ্ধান্ত এখনও নেওয়া হয়নি।
এদিকে গত ১১ আগস্ট থেকে খুলে দেওয়া হয়েছে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান, শপিং সেন্টার, বাজারঘাট। এমনকি এরইমধ্যে পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রও খুলে দেওয়া হয়েছে। চলছে সব গণপরিবহনও। সব প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যায়, সরকার জনগণের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে আগ্রহী।
সবকিছু খুলে দিলেও বন্ধ ছিল কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সবশেষ ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়েছিল। ১৮ মাসের দীর্ঘ ছুটিতে অচল হয়ে পড়ে আছে দেশের স্বাভাবিক শিক্ষা ব্যব¯’া। ক’দিন পরপর ছুটির মেয়াদ বাড়ানো ও অটোপাস ঘোষণা ছাড়া শিক্ষা নিয়ে কোনও কার্যক্রম চোখে পড়েনি।
এদিকে দেশের করোনা পরি¯ি’তি স্বাভাবিক হয়নি, শিক্ষার্থীরাও টিকা পায়নি, তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও এতদিন খোলেনি। এই চক্র থেকে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে হবে। অটোপাসের নামে একটি ‘অটো জেনারেশন’ সৃষ্টির পথ বন্ধ করতে হবে। সরকার হয়তো এটা বিবেচনায় রেখেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দি”েছ। বর্তমানে যে টিকা কার্যক্রম চলছে সেখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেছিলেন, আগস্ট মাসে কতসংখ্যক শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়া যাবে এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার কেমন থাকবে, তার ওপর নির্ভর করছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টি। কিš‘ সেপ্টেম্বরে এসে করোনা পরি¯ি’তির কিছুটা উন্নতি হলেও শিক্ষার্থীদের টিকা পরি¯ি’তির চিত্র আশাব্যঞ্জক নয়। তাই শিক্ষার্থীদের টিকায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। আগস্টে শিক্ষার্থীদের শতভাগ টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা যায়নি। অগ্রাধিকার না দিলে সেপ্টেম্বরেও শতভাগ অর্জিত হবে না।
এ অব¯’ায় শতভাগ টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত না করেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হ”েছ। সরকার শিক্ষার্থী তথা আগামী প্রজন্মের নিরাপত্তার কথা ভেবে এতদিন যে সিদ্ধান্ত নেয়নি, এখন ছাত্রছাত্রীদের শতভাগ টিকা দেওয়া ছাড়াই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলো। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও শিগগিরই তাদের জন্য টিকা নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলে সেখানে সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি উপেক্ষিত হবে। হাট-বাজার-স্কুল-কলেজ-পাবলিক প্লেসে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা আমাদের মতো একটি দেশে সহজ কিছু নয়। কাজেই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও সেখানে সামাজিক দূরত্ব ও স্বা¯’্যবিধি মেনে চলতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকেই এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হ”েছ, যেকোনও মহামারি ও রোগবালাইয়ে শিশু ও বৃদ্ধরাই বেশি সংক্রমিত হয় বা হওয়ার শঙ্কা থাকে। সেক্ষেত্রে শিশুদের মধ্যে যদি একযোগে করোনা সংক্রমিত হয়, তবে তা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এই আশঙ্কা উপেক্ষা করা যায় না। মহামারিকালে কোনও আশঙ্কাকেই উপেক্ষা করা উচিত নয়। ফলে, এসব বিষয়ের ওপর প্রতিষ্ঠানের ব্যব¯’াপনাকে খেয়াল রাখতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সরকারের কোনও ফায়দা নেই। বরং শিক্ষকদের বেতন দিতে হ”েছ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হ”েছ। কাজেই, সরকার সবকিছু বিবেচনা করেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দি”েছ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্র¯‘তি হ”েছ শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া। শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার ব্যাপারে সরকার স¤প্রতি কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ১৮ বছর ও এর ঊর্ধ্ব শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র দিয়ে টিকার আবেদন করতে পারবে। ১৮ বছরের ঊর্ধ্ব মানে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্যও (১৮ বছরের নিচে) এ ব্যব¯’া নিতে হবে। এখন যেহেতু প্রাথমিক থেকে উ”চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত খুলে দেওয়া হ”েছ, তাই তাদের জন্য আগে টিকার ব্যব¯’া করতে হবে।
স্বা¯’্য অধিদফতরের তথ্যমতে, ২ আগস্ট পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭২ হাজার ২৫৭ জন এবং চিকিৎসা শিক্ষার ৩ হাজার ৬৬২ জন শিক্ষার্থীকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ২ হাজার শিক্ষার্থী দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিয়েছে। তার মানে পূর্ণ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে মাত্র ২ হাজার শিক্ষার্থীকে!
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা এখনও টিকা নেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হিসাব মতে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রায় ৯০ লাখ ডোজ (প্রায় ৪৫ লাখ শিক্ষার্থী) টিকা দেওয়া গেলে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা টিকা পাবে। অর্থাৎ ২ ডোজ টিকা দেওয়া হলেই বলা যাবে সবাই টিকা নিয়েছে। এটাই যথার্থ। কিš‘ এখনও বেশিরভাগই দুই ডোজ টিকা পায়নি। এক ডোজ টিকা পেয়েছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও খুব বেশি নয়। কাজেই শিক্ষার্থীদের জন্য অতি দ্রæত টিকা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এখন যেহেতু প্রাথমিক ও উ”চ মাধ্যমিক খুলে দেওয়া হ”েছ তাই তাদের জন্য একযোগে টিকা কর্মসূচি চালু করতে হবে।
তবে, বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পরও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অব¯’ার ওপর নজরদারি করতে হবে। যদি বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পর, তাদের মধ্যে করোনার প্রকোপ দেখা যায়, তবে বিদ্যালয় বন্ধসহ জরুরি ব্যব¯’া নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার মানে এই নয় যে দেশ করোনামুক্ত হয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। তবে, এটি যেন করোনা ছড়ানোর মাধ্যম না হয়, সেজন্য ¯’ানীয় পর্যায়ে প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজগুলো তাদের ছাত্রছাত্রীর জন্য নিজস্ব ব্যব¯’াপনায় টিকাদান কর্মসূচির আয়োজন করতে পারে। ¯’ানীয় পর্যায়ে একেকটি স্কুল ও কলেজকে টিকার আওতায় আনতে হবে। আগে বাড়ি বাড়ি ও স্কুল কলেজে গিয়ে টিকা দেওয়া হতো। এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে না হলেও স্কুল-কলেজে গিয়ে টিকা দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। প্রয়োজন শুধু অগ্রাধিকার দেওয়া।
বাস্তবতা হ”েছ, অনেক শিক্ষার্থী এখনও প্রথম ডোজই পায়নি। সবাইকে ২ ডোজ টিকা দেওয়ার পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা আরও সময় সাপেক্ষ। টিকা ছাড়া প্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও টিকাদান কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে। এভাবে আগামী ২/১ মাসের মধ্যে সবাইকে টিকার সব ডোজ দেওয়া গেলেও তা কম কিছু নয়।
ইউনিসেফ-এর গত মার্চের জরিপ বলছে, বিশ্বের যে ১৪টি দেশে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এরপর হয়তো অনেক দেশই তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে। আর আমরা হয়তো তালিকার আরও ওপরে উঠেছি। বিপরীতে এই দীর্ঘ ছুটিতে দেশের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার এ সিদ্ধান্তে আশা করি দেশের শিক্ষাঙ্গনে প্রাণ ফিরে আসবে।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট