মাসুদ আলম।।
চলমান
একাদশ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনে শোক প্রস্তাব উত্থাপনের পর সদ্য
প্রয়াত কুমিল্লা-৭ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার আওয়ামী লীগ
দলীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফের ওপর আলোচনা হয়েছে।
বুধবার বিকাল
৫টায় শুরু হওয়া সংসদ অধিবেশনে শোক প্রস্তাব উত্থাপনের পর অধ্যাপক আলী
আশরাফকে নিয়ে স্মৃতিচারণ মূলক বক্তব্য রাখেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,
আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল
করিম সেলিম, মতিয়া চৌধুরী এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সময়বায়
(এলজিআরডি) মন্ত্রী তাজুল ইসলামসহ দলীয় ও বিরোধী দলীয় অনেক সংসদ সদস্য।
অধ্যাপক আলী আশরাফের মতো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন সংসদ সদস্যকে হারালাম-প্রধানমন্ত্রী
অধ্যাপক
আলী আশরাফের মৃত্যুতে স্মৃতিচারণ মূলক বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
বলেন, অধ্যাপক আলী আশরাফের মতো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন সংসদ সদস্যকে
আমরা হারালাম। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি একাধারে রাজনীতিবিদ ও
ব্যবসায়ী ছিলেন। করেছেন অধ্যাপনাও। ৫ বারের এই সংসদ সদস্য সপ্তম জাতীয়
সংসদে তিনি ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও বিভিন্ন কমিটিতে
কখনও সভাপতি আবার কখনও সদস্য হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে
গেছেন।
প্রধান মন্ত্রী বলেন, অধ্যাপক আলী আশরাফের সাথে সর্বপ্রথম ১৯৭৫
এর পর আমার দেখা হয়। ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের ঘটনার যেমন প্রতিবাদ করেছেন
আবার তেশরা নভেম্বর যে জেল হত্যাকা-ে তিনি বিরোধীতা করেন এবং স্বাক্ষীও দেন
সেই খুনিদের বিরুদ্ধে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন,
দুর্ভাগ্যের বিষয় অধ্যাপক আলী আশরাফ যে এলাকা থেকে নির্বাচন করতেন সেটি
কুমিল্লার চান্দিনা। চান্দিনা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি
কর্ণেল রশিদের বাড়ি। তার পাশেই খন্দকার মুস্তাকের বাড়ি। ১৯৯৬ সালের ১৫
ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে একটি নির্বাচন হয়। বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থেকে সেই
নির্বাচন করা করেছে, যে নির্বাচন দেশের সকল রাজনৈতিক দল বয়কট করেছেন।
ভোটারবিহীন, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে যে নির্বাচন করা
হয়, সেই নির্বাচনে ওই চান্দিনা থেকে কর্ণেল রশিদকে সংসদ সদস্য করে সংসদে
এনে বিরোধী দলের আসনে বসিয়ে ছিলেন। ১৫ আগস্টের খুনিদেরকে জনগণের সংসদে বেগম
খালেদা জিয়া বসান। পরবর্তীতে আবার ওই আসনে অধ্যাপক আলী আশরাফই জয়যুক্ত হয়
জনগণের ভোটে।
অত্যন্ত কঠিন একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে অধ্যাপক আলী আশরাফ রাজনীতি করে গেছেন- মতিয়া চৌধুরী
আওয়ামী
লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফ
অত্যন্ত কঠিন একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে গেছেন।
নির্বাচন করে জয়লাভও করেছেন। ৭ বারের সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফ সকল
লড়াই সংগ্রাম সামলে অনেক দক্ষতা ও কৌশলের সঙ্গে জনগণের বিপুল ভোটে
নির্বাচনে জয়লাভ করতেন। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের পরে।
তিনি বলেন, আমি
খবরের কাগজের একজন কর্মী হিসেবে শুনতাম অধ্যাপক আলী আশরাফ সবার কাছে
অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য মানুষ ছিলেন। বিভিন্ন সংকটে ফর্মূলা দিয়ে সকলকে মানিয়ে
কাজ করতে পারতেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংকট সময়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে
ধারণ করে কাজ করতে চেষ্টা করেছেন।
রাজনীতি করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের বিভিন্ন অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করে অধ্যাপক আলী আশরাফ- শেখ ফজলুল করিম সেলিম
আওয়ামী
লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, অধ্যাপক আলী আশরাফ
বঙ্গবন্ধুর একজন সৈনিক ছিলেন এবং নিবেদিত কর্মী। ছাত্রজীবন থেকে তিনি
রাজনীতি করতেন। তাকে রাজনীতি করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের বিভিন্ন অত্যাচার ও
নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। ১৯৭৫ সাথে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কুমিল্লার
চান্দিনা থেকে তার রাজনীতি শুরু। সেখানে ছিলো খুনি কর্ণেল রশিদ। রশিদের
পাশেই ছিলো খুনি খন্দকার মুস্তাক। তারা বিভিন্ন ভাবে অধ্যাপক আলী আশরাফকে
চাপ প্রয়োগ করতেন। কিন্তু তারপরও তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে এক পাও পিছবা
হননি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে তিনি নির্যাতন ভোগ করেন।
তিনি বলেন,
অধ্যাপক আলী আশরাফ বিভিন্ন সময় সংসদে যে বক্তব্য দিতেন, সেই বক্তব্য থেকে
অনেক কিছু শিখার ছিলো। তিনি যাই বলতেন বাস্তব কথা বলতেন। তিনি যখন ডেপুটি
স্পিকার ছিলেন তখনও তিনি পরিশুদ্ধভাবে কথা বলতেন। তিনি কখনও অন্যায় প্রশ্রয়
দিতেন না। ১৯৭৫ থেকে এই পর্যন্ত অনেক প্রতিকূলতার মাঝে রাজনীতি করতে
হয়েছে। ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর
খুনিরা সেইখানে পদচারণ করেছে।
খুনি খন্দকার মুস্তাকের হাত থেকে বাবাকে বাঁচিয়ে আনেন অধ্যাপক আলী আশরাফ- আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক
আত্মার
মাগফেরাত কামনা করে আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক বলেন, অধ্যাপক আলী আশরাফ
আমার চাচা। ওনাকে ১৯৬৯ সাল থেকে ছিনি। আমার বাবার অত্যন্ত ঘনিষ্ট ছিলেন
সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফ। বাবার আপন ছোট ভাই না হলেও তিনি কোন দিকে কম
ছিলেন না। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৫ বলেন প্রায় প্রত্যেক দিনই তিনি আমাদের বাসায়
আসতেন। সেই হিসাবে তিনি আমাকে ছেলের মতো করে দেখতেন। ১৯৭৩ সালে স্বতন্ত্র
প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন । পরে বঙ্গবন্ধুর কথায় তিনি আওয়ামী
লীগের সংসদ সদস্য হয়ে যান। সবসময় বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবে নিজের রাজনৈতিক
আদর্শ পরিচালনা করতেন।
তিনি বলেন, অধ্যাপক আলী আশরাফের এলাকায় জন্ম
নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্ণেল রশিদ। ওই খুনির সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে
টিকে থাকতে হয়েছে। আমি আনিসুল হক অধ্যাপক আলী আশরাফের কাছে কৃতজ্ঞ। তার
কারণ ১৯৭৫ সালেল অক্টোবর মাসে দুই দুইবার স্থানীয় সকল সংসদ সদস্যকে খুনি
মুস্তাক ডেকেছিলেন। দুইবারে আমার বাবার সাথে খন্দকার মুস্তাকের সাথে বিরোধ
হয়েছিলো। তখন সেখান থেকে আমার বাবাকে বাঁচিয়ে আনেন অধ্যাপক আলী আশরাফ। এরপর
থেকে আমার পরিবার সবসময় তার কাছে কৃতজ্ঞ ছিলো।
১৫ আগস্টের পর লড়াই, সংগ্রাম করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধরিয়ে রাখে অধ্যাপক্ষ আলী আশরাফ- এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলাম
অধ্যাপক
আলী আশরাফের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে স্মৃতিচারণ মূলক বক্তব্যে স্থানীয়
সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সময়বায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন,
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনিত প্রার্থী হিসেবে অধ্যাপক আলী আশরাফ প্রথম
সংসদ সদস্য হন। এর পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর তিনি
গ্রামগঞ্জে, হাটে-বাজারে ঘুরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধরে রাখার চেষ্টা
করেছিলেন। কুমিল্লার রাজনৈতিতে অধ্যাপক আলী আশরাফের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা ছিলো। বিশেষ করে প্রিয় নেত্রী বাংলাদেশে ফিলে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব
নেন, তখন তার পাশে থেকে লড়াই, সংগ্রাম ও আন্দোলনে কুমিল্লা অঞ্চল থেকে তিনি
নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগত ভাবে ১৯৯৬ সাথে সংসদ
সদস্য হওয়ার পরে অধ্যাপক আলী আশরাফের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। তিনি উচ্চ
মানষিকতার মানুষ ছিলেন। কুমিল্লার মানুষের কাছে তিনি অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তি
ছিলেন। চান্দিনার মানুষ তাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসেন বলেনই বাংলাদেশ আওয়ামী
লীগের মনোনিত প্রার্থী হিসেবে বার বার সংসদ সদস্য হয়েছেন। সেই স্মৃতিতে
চান্দিনার মানুষ এখনও অধ্যাপক আলী আশরাফকে স্মরণ করে।