আইনুল ইসলাম ||
কভিড-১৯ এর আঘাতে বিশ্বব্যাপী স্বা¯’্য এবং আর্থিক খাতে ব্যাপক সংকট সৃষ্টি হয়। জীবন ও জীবিকাকে বাঁচিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করেন বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞরা। ইতোমধ্যে ভাইরাস নির্মূলে টিকা আবিস্কার হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে উপযুক্ত ব্যব¯’া গ্রহণ সম্ভব হয়েছে। ব্যাপক টিকা সরবরাহ এবং প্রয়োগে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার অনেকটাই নিচে নেমে এসেছে। একই সঙ্গে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে একাধিক কৌশল গ্রহণ করায় দেশগুলোর অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়া”েছ।
অর্থনীতিতে পরপর দুটো ত্রৈমাসিক পর্বে মোট জাতীয় উৎপাদন-জিডিপি যদি কমে যায়, তবে অনেক দেশই তাকে মন্দা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ বলছে, মন্দা হ”েছ যখন সর্বক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কর্মকাÐ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায় এবং সেটা কয়েক মাসের বেশি সময় ধরে ¯’ায়ী হয়। সাধারণত এটা প্রকৃত জিডিপি, প্রকৃত আয়, কর্মসং¯’ান, শিল্পোৎপাদন এবং পাইকারি ও খুচরা বিক্রির মধ্যে প্রতিফলিত। আইএমএফ বলছে, অর্থনীতিতে কভিডের সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে ২০২০ সালের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে অর্থাৎ এপ্রিল, মে ও জুন- এই তিন মাসে। ২০২০ সালের কভিড অর্থনীতির মন্দা গ্রেট লকডাউন বা গ্রেট শাটডাউন নামে পরিচিতি পেয়েছে। বলা হ”েছ, ১৯৩০-এর দশকে বিশ্বে যে মহামন্দা পরি¯ি’তি (যা গ্রেট ডিপ্রেশন নামে পরিচিত) তৈরি হয়েছিল, তারপর করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে আবার বড় রকমের ধস নেমেছে।
করোনাভাইরাসের অভিঘাতের বিশ্ব অর্থনীতি ২০২০ সালে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। ১৯৩০-এর দশকের অতিমন্দার পর এই প্রথম বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেল। গত বছর চীনের প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ২ শতাংশের বেশি। অথচ দুই দশক ধরে চীনের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশের ওপরে। করোনা অতিমারি পৃথিবীর সব দেশে কর্মনিয়োজনকেও সংকুচিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী অর্থনীতিতেও বেকারত্বের হার ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ শতাংশ হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেবামূলক খাত, যেখানে কর্মনিয়োজন সবচেয়ে বেশি। বৈশ্বিক বাণিজ্যও উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
করোনার প্রকোপ অনেকটাই শাসনে নিয়ে এসেছে বিশ্বের দেশগুলো। বেশিরভাগ দেশ এখন টিকা সরবরাহ এবং বিতরণ নিয়ে ব্যস্ত। ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে দেশগুলো গ্রহণ করেছে একাধিক আর্থিক এবং মুদ্রানীতি। ফলে অর্থনীতির চাকা সচল হতে আর বেশি সময় লাগবে না বলে প্রত্যাশা করছে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সং¯’ার (আঙ্কটাড) একটি প্রতিবেদন। সং¯’াটির ধারণা, ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ ৪ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির একটি হিসাব প্রণয়ন করেছে সরকার। গত এক অর্থবছরে (২০১৯-২০) এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন বা এক হাজার কোটি মার্কিন ডলার। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় ৮৪ হাজার কোটি, যা কিনা সে বছরের জিডিপির প্রায় ৩ শতাংশ।
কভিড-১৯জনিত অভিঘাত মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার ৪টি নীতি-কৌশল অবলম্বন করে। এগুলো হ”েছ- সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ প্রণয়ন, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি এবং মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা। সরকার নীতিগুলোর আলোকে কৌশলগত কর্মসূচি দিয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে; যা তাৎক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদ ও দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়িত হবে। এরই আলোকে পর্যায়ক্রমে ২৩টি অর্থনৈতিক প্রণোদনা ও সামাজিক সুরক্ষা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ এক লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মোকাবিলায় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা দ্রæত বাস্তবায়নের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো অব¯’ানে রয়েছে বাংলাদেশ। অতিস¤প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১৯-২০ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) চূড়ান্ত হিসাব এবং ২০২০-২১ অর্থবছরের সাময়িক হিসাব প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং সাময়িক হিসেবে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। করোনা মহামারিতেও এ প্রবৃদ্ধি সারাবিশ্বে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের এক উল্লেখযোগ্য অর্জন। বিশ্বব্যাংকের জুন ২০২১-এর 'গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস' প্রতিবেদনে বিশ্বে ২০২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করা হয়েছে মাইনাস ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে মাইনাস ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ধনাত্মক প্রবৃদ্ধির হার প্রাক্কলন করা হয়, যা ছিল ২ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয়ের ভালো প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়া”েছ বলে জানিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
অতীতেও বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা ছিল। বিশেষ করে ১৯৩০ সালের মহামন্দা, ২০০৭-০৮ সালের আর্থিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল বিশ্ব। এবারের গ্রেট লকডাউনও কাটিয়ে উঠতে পারবে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। বৈশ্বিক যে কোনো সংকট থেকে উত্তরণে ছোট-বড় সব দেশেরই ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, করোনাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের কিছুদিন চলতে হবে। এর সঙ্গে প্রাক-করোনা জলবায়ু সমস্যাকে যুক্ত করে টেকসই সমাধান খুঁজতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতিকে অন্তত আগের অব¯’ায় ফিরিয়ে আনতে গঠনমূলক সর্বজনীন উদ্যোগ প্রয়োজন। উন্নয়নশীল, উন্নত এবং স্বল্প উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এ কাজটি টেকসই করতে দ্রæত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়