ইকরাম আহমেদ ||
বাংলাদেশে ইতোপূর্বে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিফর্মের কতিপয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও এ পর্যন্ত বিষয়টি অসম্পূর্ণই থেকে গেছে। এই অবকাশে অনেক সময় নীতিনির্ধারক এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রেও ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ ঘটে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও অনেক সময় অর্পিত দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য প্রদর্শন করে থাকেন। নিজ নিজ নির্ধারিত দায়িত্ব বা কর্ম সম্পাদনে তাদের কারও কারও সক্ষমতাও প্রশ্নাতীত নয়। আবার আত্মাভিমান বা আত্মগরিমাও কাজের সাফল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনুভূমিক সম্পর্ক বা পারস্পরিক সহযোগিতাও অনেক সময় সন্তোষজনক নয়। এর ফলে চূড়ান্ত পর্যায়ে জনগণকে সেবা বা সার্ভিস প্রদান বিঘ্নিত হয়। পরিণতিতে সরকারের ভাবমূর্তি হ্রাস পায় এবং জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অধিকন্তু দুর্নীতির কালো ছায়া ক্রমশ সমাজকে অন্তঃসারশূন্য করছে। সরকারি কর্মচারীরাও দুর্নীতির চোরাবালিতে পথহারা হচ্ছে। এটা কোনো জাতির জন্যই শ্নাঘার বিষয় নয়। দুর্নীতি দমন কমিশন এখন আগের তুলনায় অধিক ক্ষমতার অধিকারী। এ ছাড়া তথ্য কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রভৃতি গঠন করা হয়েছে। তবে সম্ভবত এসব প্রতিষ্ঠানের ম্যান্ডেট জনপ্রশাসনে সংস্কার আনয়নের বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ে পরিব্যাপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের প্রয়োজন স্ট্রাকচারাল পরিবর্তন এবং সেটা কোনো দাতা সংস্থা প্রদত্ত মডেল অনুসরণ করে নয়। সেটা হতে হবে প্রকৃতই গতিশীল এবং আমাদের অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
জনপ্রশাসনকে একটি প্রাণবন্ত এবং গতিশীল সার্ভিস হিসেবে গড়ে তোলা অতি জরুরিভাবে প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে দুটি মৌলিক বিষয়ের প্রতি আমাদের বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। একটি হচ্ছে 'উন্নয়ন প্রশাসন', অন্যটি 'প্রশাসনিক উন্নয়ন'। উন্নয়ন প্রশাসন বিষয়ে সমগ্র বিশ্বে প্রভূত লেখালেখি, জরিপ, গবেষণা সন্দর্ভ প্রভৃতি চলমান। এ বিষয়ে সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলা চলে, যেহেতু আমাদের সম্পদ সীমিত, আয়তনের তুলনায় বিপুল জনগোষ্ঠী, যা এখনও মানবসম্পদে রূপান্তরিত হয়নি, কারিগরি বা কৃৎকৌশলগত দক্ষতা এখন অপর্যাপ্ত; সেহেতু আমাদের দ্রততম উপায়ে উন্নতি সাধন করতে হলে কিছু বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা জরুরি। যেমন স্বল্প, মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সব পর্যায়েই মৌলিক বা উদ্ভাবনী দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে হবে। উন্নয়নকে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। পরিকল্পনাবিদরা নিশ্চয় অনবহিত নন যে, আমাদের বিগত কয়েক দশকের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রধানত নগরকেন্দ্রিক ও রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠার ওপরেই গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অবশ্য গ্রামীণ ও প্রান্তিক পর্যায়ে জীবনমান উন্নয়নে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি দেশে চলমান। এখন প্রয়োজন ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন নীতি। জনসংখ্যা বিবেচনায় আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজার বিপুলাকার। একটা ন্যূনতম পর্যায়ের শিক্ষা সম্পন্ন করে কারিগরি বা পেশাগত দিক থেকে অমিত সম্ভাবনাময় জনশক্তি বা মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে হবে আমাদের বিপুল জনসংখ্যাকে। ১৭ কোটি জনসংখ্যার ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে শুধু অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মেটাতেই প্রয়োজন হবে অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের। চীনের উদাহরণ এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রিকেও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়ার চমকপ্রদ উন্নয়নকে উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। কোনোরূপ প্রাকৃতিক সম্পদ এমনকি কৃষিজমির পরিমাণ একেবারে সীমিত হওয়া সত্ত্বেও একমাত্র ও দক্ষ মানবসম্পদের ওপর নির্ভর করেই তারা এরূপ বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জনকে সম্ভব করে তুলেছে। আবার এই মানবসম্পদের ওপর নির্ভর করেই সিঙ্গাপুরের মতো একটি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। গ্রেট ব্রিটেনের বিগত কয়েক দশকের উন্নয়ন নীতিমালায় সার্ভিস সেক্টরকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে উন্নয়নের প্রয়োজনীয় প্রায় সব মৌলিক উপাদান বিদ্যমান। আমাদের রয়েছে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ, বিস্তীর্ণ কৃষিভূমি, বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের প্রায় সমান আয়তনের সামুদ্রিক সীমা (অধুনালব্ধ), যার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এখনও আমাদের ধারণার বাইরে। দক্ষ পরিকল্পনার সাহায্যে, দূরদর্শী ব্যবস্থাপনার আওতায় এ সমুদয়ের সদ্ব্যবহার বাংলাদেশকে এনে দিতে পারে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি। বাংলাদেশের জন্য উন্নয়ন প্রশাসন অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
যে কোনো দেশের 'উন্নয়ন প্রশাসন' যথাযথভাবে কার্যকর করতে এবং অর্থবহ করে দেশের মৌলিক ও টেকসই উন্নয়নের জন্য যা করা প্রয়োজন, তা হচ্ছে 'প্রশাসনিক উন্নয়ন'। এই প্রশাসনিক উন্নয়নের বিষয়টিও বহুমাত্রিক এবং বেশ জটিল বলা যেতে পারে। সংক্ষেপে এটুকু উল্লেখ করা যায়, আমাদের জনপ্রশাসন কার্যকর উন্নয়ন প্রশাসনের উপযোগী করে পুনর্বিন্যস্ত করতে আমাদেরকে খুঁটিনাটি দিক পর্যালোচনাপূর্বক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের জনপ্রশাসনকে যথার্থই সক্ষমতা দিতে হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেন দ্বিধা ও শঙ্কামুক্ত হয়ে কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারেন, সেরূপ পরিবেশও সৃষ্টি করতে হবে। যথেষ্ট জনবল ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যেন তারা ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে সমর্থ হতে পারেন। টেক্সট বুকনির্ভর রুটিন অনুসরণের বাইরে তাদেরকে উদ্ভাবনী দক্ষতারও স্বাক্ষর রাখতে হবে, যেন তারা কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারেন। প্রো-অ্যাকটিভ হয়ে কাজ করার মনোভাব তাদের থাকতে হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হওয়ার সুবাদে তারা যেমন যথেষ্ট সুবিধাভোগী এবং সম্মানের পাত্র, তেমনি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যও বিশাল। শুধু চাকরির জন্য চাকরি নয়, বরং নিজের যথার্থ সার্থকতা, নিজ পরিবার; সর্বোপরি দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনে তাদের নিবেদিত হতে হবে। জাপানে 'মেইজি' শাসনামলে পূর্ববর্তী সময়ের নীতির অবসান ঘটিয়ে জাপানের সমাজ ও অর্থনীতিকে যখন উন্মুক্ত করা হয়, তখন জাপানের সিভিল সার্ভেন্টরাই সেখানে শিল্প, বাণিজ্য, অর্থনীতি এবং শিক্ষার প্রসারে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। আধুনিক জাপান তারই ফল।
জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সরকারের চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা হিসেবে কাজ করে থাকেন। সরকারের সফলতা-ব্যর্থতাও অনেকাংশে এসব কর্মকর্তার ওপর নির্ভর করে। সুতরাং তাদের অবশ্যই দায়িত্বশীল এবং প্রয়োজনে যথাযথ ভূমিকা গ্রহণের মানসিকতা ও সৎ সাহস থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, জনগণের কষ্টার্জিত অর্থেই তাদের সবরকম সুযোগ-সুবিধা, আরাম-আয়েশ ও মর্যাদা।
এসব এবং সংশ্নিষ্ট আবশ্যিক বিষয়াদির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য সিভিল সার্ভেন্টদের নিয়োগ থেকে মৌলিক এবং বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ, পদায়ন, পরবর্তী সময়ে তদারকি প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ। নিয়োগের ক্ষেত্রে পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে যথেষ্ট গতিশীল থাকতে হবে এবং প্রয়োজনে নিয়োগ পদ্ধতিতে যথোপযুক্ত সংশোধন আনতে হবে। আমি পিএসসিতে কর্মরত থাকাকালে দেশের প্রাজ্ঞজনকে সম্পৃক্ত করে বিভিন্ন পরীক্ষার সিলেবাসে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ পরিমার্জন/সংযোজন করা হয়েছিল। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যানের সঙ্গেও আমার ফলপ্রসূ মতবিনিময় হয়েছিল। এ ছাড়া প্রশিক্ষণের সময়োপযোগী আধুনিকীকরণ বিষয়ে দেশের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গেও পিএসসি কার্যালয়ে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অবশ্য এর থেকে কোনো ফলপ্রসূ অগ্রগতি বিষয়ে পরে তেমন কিছু জানা যায়নি। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক এবং নিয়ন্ত্রক বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গেও মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছিল।
উল্লেখযোগ্য, পাবলিক সার্ভিস কমিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও এর চেয়ারম্যান এবং মেম্বারদের মর্যাদা সংবিধানসম্মত নয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে পিএসসির চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের অবস্থান সমমানের হওয়াটা যুক্তিযুক্ত নয়।
আমরা জানি, সরকার জনপ্রশাসনকে গতিশীল করতে বিশেষভাবে সচেতন। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপও গৃহীত হয়েছে। ২০১১ সালেই তৎকালীন 'সংস্থাপন মন্ত্রণালয়'কে 'জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়' হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে 'ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট উইং' নামে একটি নতুন অনুবিভাগও গঠন করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করা হয়েছে। তাদের জন্য রাজধানী ঢাকা ছাড়াও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আবাসন সুবিধা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে মাঠ পর্যায়ে সব ধরনের সেবাদান কার্যক্রম এক ছাদের নিচে আনার জন্যও কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে জনগণ এর সুফলও পেতে শুরু করেছে। তবে এখনও অনেক কিছু করার অবকাশ রয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, জনপ্রশাসনকে প্রকৃত প্রস্তাবে একটি কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য 'উন্নয়ন প্রশাসন' এবং 'প্রশাসনিক উন্নয়ন' এই উভয়ই সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটিকে পাশাপাশি অগ্রসর করে নেওয়ার সাফল্যের ওপর একটি গতিশীল জনপ্রশাসন এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও নির্ভরশীল। বাংলাদেশকে একটি প্রকৃত কল্যাণ রাষ্ট্রে রূপান্তর এবং রূপকল্প ২০৪১ কাঙ্ক্ষিত বাস্তবায়নে তাই অধিক কালবিলম্ব না করে প্রশাসনিক সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা সুবিবেচনার কাজ হবে।
সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন