ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
একটি ভ্রমণের সাতকাহন
Published : Tuesday, 26 October, 2021 at 12:00 AM
একটি ভ্রমণের সাতকাহনশান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||

চতুর্থ অধ্যায়
রাজা দশরথের উদ্দেশ্যে জানকীর শ্রদ্ধাস্বরূপ পিণ্ডদান।
    একদা পিতা দশরথের আদেশে শ্রীরামচন্দ্র লক্ষ্মণ ও সীতাকে সঙ্গে নিয়ে গয়ায় ফল্গুনদীর তীরে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। সে সময় একদিন পিতৃশ্রাদ্ধের সময় উপস্থিত হয়েছে দেখে রাম চঞ্চল হয়ে ওঠেন। শ্রাদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ করতে নিকটেই এক গ্রামে লক্ষ্মণকে পাঠালেন। এদিকে ভাইয়ের ফিরতে বিলম্ব হচ্ছে দেখে রাম নিজেই লক্ষ্মণের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। কারণ, আর কিছুক্ষণের মধ্যে শ্রাদ্ধের সময় পেরিয়ে যাবে।
    সকাল গড়িয়ে দুপুর। জানকী একাকিনী। এদিকে দুপুরও যে প্রায় গড়িয়ে যায়। জানকী চিন্তান্বিত। শ্রাদ্ধ কীভাবে হবে? দেবর লক্ষ্মণ এখনও এসে পৌঁছলেন না। প্রাণনাথেরও দেখা নেই। শ্রাদ্ধের সময় প্রায় সন্নিকটে। এরপরই রাক্ষসীবেলা উপস্থিত হবে। তখন শাস্ত্রানুযায়ী কোনও পুণ্যকর্মই করা আর সম্ভব হবে না। এইরূপ বিচার করে জানকী ফল্গুনদীতে যথাবিধি স্নানকার্য সমাধা করলেন। তারপর ইঙ্গুদী তেলের প্রদীপ প্রজ্বলন করে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। রাম-লক্ষ্মণ কেউ উপস্থিত নন দেখে জানকী সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি নিজেই পতির পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে পিণ্ড প্রদান করবেন। তারপর জানকী নিজেই দশরথ ও পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশ্যে অন্য কোনও বস্তু না থাকায় বাধ্য হয়ে বালুকার পিণ্ডদান করলেন। পিণ্ডদান করা মাত্রই ‘হে জনক নন্দিনী! আজ আমরা পরিতৃপ্ত হলাম। তাতে তুমিও ধন্য হলে।’ এ রকম কিছু কথা উচ্চারিত হলো। পিণ্ডগ্রহণের জন্য নানা অলংকার ভূষিত হাত জানকীর দিকে প্রসারিত হলো। জানকী জানতে চাইলেন-কারা পিণ্ডগ্রহণের জন্য উপস্থিত হয়েছেন?
    পুত্রবধূর বাক্য শ্রবণে অদৃশ্য দশরথ বললেন,
‘হে সুব্রতে সীতে! আমি তোমার শ্বশুর। আমার নাম দশরথ। তোমার পিণ্ডদানে আমরা পরিতৃপ্ত হয়েছি। তোমার এই পবিত্র পিণ্ডদান কর্ম সর্বার্থ সফল হয়েছে।’
    সীতা বললেন, ‘হে পিতঃ! আপনারা যে আজ হস্ত প্রসারিত করে আমার নিবেদন করা পিণ্ড গ্রহণ করেছেন এই অভূতপূর্ব ঘটনা আমার স্বামী বিশ্বাস করবেন না। এখন কী করণীয় আমার?’
    দশরথ বললেন, ‘তুমি এ বিষয়ে কতকগুলো সাক্ষী রাখো।’ এই আকাশবাণী শ্রবণ করে জানকী যথাক্রমে ফল্গুনদী, ধেনু, অগ্নি ও কেতকীকে বললেন, ‘তোমরা কিন্তু এ বিষয়ে সাক্ষী রইলে।’ তাঁরা অন্তর্হিত হওয়ার পর রামচন্দ্র ফিরে এলেন। জানকীকে যত শীঘ্র সম্ভব শুচি হয়ে কিছু রান্না করে দিতে বললেন। স্বামীর কথা শুনে বৈদেহী একটু বিস্মিতই হলেন। নিরুত্তর রইলেন।
    জানকী কেন নিরুত্তর রাম জানতে চাইলে তিনি আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা বললেন। ততক্ষণে লক্ষ্মণ এসে গিয়েছেন। রামচন্দ্র ভাইকে সম্বোধন করে বললেন, ‘ভাই আমার, সীতা যা বললেন তুমি তো সবই শুনলে। আমরা শাস্ত্রমতো আহ্বান করেও যাঁর দর্শন পাই না তিনি জানকীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দর্শন দিলেন, এ তো বড় আশ্চর্যের ব্যাপার। সীতা নিশ্চয়ই মিথ্যা বলছেন।’ সে মুহূর্তে লজ্জিতা সীতা যেন মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিলেন। অধোবদনে বললেন, ‘হে রঘুনন্দন! আমার নিবেদন করা পিণ্ড আপনার পূর্বপুরুষগণ যে প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করেছেন তার সাক্ষী আছে ফল্গুনদী, ধেনু, অগ্নি আর কেতকী পুষ্প।’ রাম বললেন, ‘এরা যদি তোমার কথা সত্যি বলে জানায় তাহলেই আমি গ্রাহ্য করব।’ রামচন্দ্রের আহ্বানে তারা উপস্থিত হলো। কিন্তু তারা বলল, ‘আমরা কিছুই জানি না।’
    এ কথা শোনার পর সংগতকারণেই রামচন্দ্র ও লক্ষ্মণ পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করতে উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। রামচন্দ্র শ্রাদ্ধের কাজ শুরু করলেন। দশরথসহ পিতৃপুরুষগণকে আহ্বান করলেন। প্রাণাধিক পুত্রের আহ্বানে দশরথ সাড়া দিলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে বৎস! কেন তুমি আমাকে স্মরণ করেছ? জানকী ইতোমধ্যে আমাদের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করেছে আমরা তৃপ্ত।’ তারপরও আকাশবাণী হলো, -‘হে রাম! জানকী পিণ্ডদান করেছে। আর পিণ্ডদানের প্রয়োজন নেই।’ সীতার সুকর্মের সাক্ষী থেকেও ফল্গুনদী, ধেনু অগ্নি ও কেতকী কেন এরকম করল? তাই জানকী দু:খভারাক্রান্ত মনে ফল্গুনদীর প্রতি এই অভিশাপ উচ্চারণ করলেন, ‘হে ফল্গুনদী, তুমি যা শুনেছ, যা দেখেছ, তা সত্য নিবেদন করলে না। এর ফলভোগ করো, এজন্য পাতালে প্রবাহিত হও।’ কেতকী ফুলকে অভিশাপ দিলেন-‘তুমি সকল সময়েই শিবের অপ্রিয় হবে।’ ধেনুর প্রতি এই অভিশাপ উচ্চারিত হলো,-‘হে নিষ্পাপে! তুমি যে মিথ্যা বললে, এই কারণে তুমি পুচ্ছদেশে পবিত্রা ও মুখে অপবিত্রা হও।’ আর অগ্নিকে বললেন, ‘তুমি দেবগণের মুখে হয়েও যে মিথ্যা বললে, এই কারণে আমার অভিশাপে সর্বভক্ষক হও।’
    মতান্তরে ফল্গুনদী, তুলসীবৃক্ষ এবং অক্ষয়বট এই পিণ্ডদানের সাক্ষী ছিল। রামচন্দ্রের জিজ্ঞাসায় ফল্গুনদী ও তুলসী মিথ্যা বলেছে। অক্ষয়বট সত্যভাষণে আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়।
দ্বাপর যুগের কাহিনি।
    গঙ্গাপুত্র চিরকুমার ভীষ্ম এলেন গয়ায়। পিতা শান্তনুর উদ্দেশে গয়াশিরে পিণ্ডদান করলেন। সেই মুহূর্তে শান্তনুর দুটি হাত এলো পিণ্ডগ্রহণ করতে। ভীষ্ম পিণ্ড হাতে না দিয়ে সেটি রাখলেন শ্রীবিষ্ণুপাদপদ্মে। আনন্দিত হলেন শান্তনু। পুত্রকে ইচ্ছামৃত্যুর বর দিলেন।
    প্রথম পাণ্ডব ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির পিতা পাণ্ডুর পিণ্ডদান করতে এলেন গয়াতে। পিতামহ ভীষ্মের পিণ্ডদানের সময়ে যা ঘটেছিল একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো, যুধিষ্ঠিরের পিণ্ডদানের সময়ে পাণ্ডুর দুটি হাত আসে পিণ্ডগ্রহণের উদ্দেশ্যে। যুধিষ্ঠির পিতার হাতে সেই পিণ্ড না দিয়ে শ্রীবিষ্ণুপাদপাদ্মে সমর্পণ করলেন। এর ফলে পাণ্ডুর অতৃপ্ত আত্মা তৃপ্তিলাভ করলেন। তিনি অত্যন্ত প্রীত হয়ে জ্যেষ্ঠ পুত্রকে আশীর্বাদ করলেন-‘বৎস, তুমি সশরীরে স্বর্গগমনে সমর্থ হবে।’

কলিযুগের কথা
    গৌরহরি এসেছেন গয়াধামে। পিতার আত্মার উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করবেন। পিতা জগন্নাথ মিশ্র তাঁর পিণ্ডদানের কথা বলে গিয়েছেন মৃত্যুর আগে।
    ‘গয়াতে আমার বাপু দিহ পিণ্ডদান।’
                (জয়ানন্দ-চৈতন্যমঙ্গল)
অতএব পিতার ইচ্ছা পুত্রের শিরোধার্য। মায়ের অনুমতি নিয়েই গয়াযাত্রা গৌরাঙ্গের।
    ‘জননীর আজ্ঞা লই মহাহর্ষ মনে।
    চলিলেন মহাপ্রভু গয়া দরশনে।।’
                (বৃন্দাবন দাস)
গয়াতে পিতার উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করলেন গৌরাঙ্গ। শ্রীবিষ্ণুপাদপদ্মে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন তিনি। যিনি বিষ্ণু তিনিই শ্রীকৃষ্ণ। গৌরাঙ্গের আরাধ্য। শ্রীবিষ্ণুপাদপদ্ম দর্শনে দু’নয়নে অবিরাম বারিধারা শচীনন্দনের। বিষ্ণুর পাদপদ্মে আত্মপিণ্ডদান করলেন। ফল্গুর পর শ্রীবিষ্ণুপাদপদ্মে পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান। এরপর অক্ষয়বটেও পিণ্ডদান করলেন।
(ক্রমশঃ)
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
 মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫