ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ ||
যখন চলমান সময় স্বস্তি দিতে পারে না; সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি- সর্বক্ষেত্রে স্থবিরতা, যুক্তিহীনতা, অন্যায় ও অমানবিকতা মানুষকে হতাশ করে দেয়; সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আসে বন্ধ্যত্ব; তখন বেঁচে থাকা এবং এগিয়ে চলার আশায়-আশ্বাসে মানুষ শুভ্র, নিষ্কলঙ্ক নতুন সকালের প্রত্যাশা করে। তাই বদলে যাওয়া নতুন দিনের জন্য অসহায় মানুষের ব্যাকুল প্রতীক্ষা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতি কখনো স্থিতিশীলতা নিয়ে যৌক্তিক জায়গায় দাঁড়াতে পারেনি। এ পর্বে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনক্ষমতাকালে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা ও ঐকান্তিকতায় উন্নয়নের পথে পা দিয়ে দেশবাসী যখন নতুন ও উজ্জ্বল ভোরের স্বপ্ন দেখছে, তখনই লাগাম ছাড়া দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন রাহুর ছায়া ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে।
আমি ইতিহাসের ছাত্র বলেই বারবার ইতিহাস থেকে পাঠ নিতে চাই, আনন্দ পেতে চাই, আশাবাদী হতে চাই। আবার ভুল থেকে শিক্ষা নিতে চাই। ক্লাসে আজকাল যখন পড়াই- তখন বৃত্ত এঁকে সভ্যতার উত্থান, বিকাশ, পতন আর নবউত্থান দেখাতে গিয়ে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। শিক্ষার্থীদের চোখের দিকে তাকিয়ে কতটা আনন্দ ওদের ছুঁয়ে গেল, তা বোঝার চেষ্টা করি। আমি ওদের বলি- দেখো, ১৫-২০ বছর আগেও তেমন আত্মবিশ্বাস ছিল না আমার। মনটা ম্রিয়মাণ থাকত। কোনো আশার কথা শোনাতে পারতাম না। বলতাম, এই দেখো সভ্যতার উত্থান, বিকাশ আর পতনের বৃত্ত। বৃত্তের নিচে ইংরেজি ‘আর’ লিখে বলতাম, সভ্যতার উত্থান অর্থাৎ ‘রাইজ’ হচ্ছে এখানে। তার পর বৃত্তের বাঁদিকে ঊর্ধ্বমুখী তীর এঁকে বলতাম, দেখো চলমান বৃত্তে সভ্যতার বিকাশ দেখাচ্ছে। তীর বৃত্তের মাথায় এলে বলতাম, সভ্যতা এর সর্বোচ্চে পৌঁছে গেছে। যেহেতু ঘূর্ণায়মান বৃত্ত, সেহেতু তীর এবার নিম্নমুখী। অর্থাৎ পতন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটিই নিয়তি। তীর এসে নেমেছে নিচে। অর্থাৎ চূড়ান্ত পতন ঘটেছে। তখন বলি, বাংলার ইতিহাসে হাজার বছর ধরে এ বৃত্তেরই ঘূর্ণন দেখেছি আমরা। বাঙালির সভ্যতা দীর্ঘকাল ধরে বিকাশয়মান ছিল। সমৃদ্ধির চূড়ান্তে পৌঁছেছিল। এর পর অবধারিতভাবে এর পতন ঘটেছে।
তখনকার বাস্তবতায় এমন কোনো আশাবাদ দেখাতে পারিনি যে, আবার আমাদের সভ্যতার নবউত্থান ঘটবে। আমাদের ভঙ্গুর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা আশাবাদ জাগাতে পারেনি। কিন্তু গত এক দশকে অবস্থার পরিবর্তন যেন হচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনেকটা একক শ্রম, আত্মবিশ্বাস ও নিষ্ঠায় দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। শিল্প-অর্থনীতিও গতি পায়। অবকাঠামোগত উন্নতিও চোখে পড়ার মতো। একটি আনন্দময় সম্ভাবনার কথা ভেবে ক্লাসের হোয়াইট বোর্ডে আবার বৃত্ত আঁকি। দেখাই সভ্যতার অমোঘ নিয়মেই পতন থেকে আবার নবউত্থান ঘটছে। তীরটি আবার বৃত্তের বাঁয়ে চলে আসছে। এখন ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা শুরু করবে। দেখি শিক্ষার্থীদের চোখ চক চক করছে। ওদের প্রশ্নের জবাবে বলি- কতটা দ্রুত আমরা উন্নতির চূড়ান্তে পৌঁছব, তা নির্ভর করছে এই প্রজন্মের তোমাদের ওপর। নেতৃত্বে আসবে তোমরা। যদি তোমরা দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গড়তে পারো আর রাজনীতির অঙ্গন কলুষমুক্ত রাখতে পারো, তা হলে দেখবে উন্নতির সূচক-তীর দ্রুত ওপরের দিকে উঠবে। আর এখানেই যদি ব্যর্থ হও, তা হলে সম্ভাবনা জাগানো তীর ঘুরে যেতে পারে নিচের দিকে। নির্বাপিত হতে পারে সব সম্ভাবনার আলো। চারপাশের বাস্তবতা দেখে হঠাৎ জেগে ওঠা আশার আলো আবার নিভু নিভু হয়ে যাচ্ছে।
উনিশ শতকের ইংরেজ ঐতিহাসিক আর্নল্ড জোসেফ টয়েনবি তার বিখ্যাত সূত্র ঞযবড়ৎু ড়ভ ঈযধষষবহমব ধহফ জবংঢ়ড়হংব প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, বিরুদ্ধ প্রকৃতি-পরিবেশ সব প্রাণীর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এটিকে মোকাবিলা করতে পারলেই টিকে থাকা, নয়তো হারিয়ে যাওয়া। লাখো বছর ধরে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তেলেপোকা টিকে থাকলেও বরফ যুগের অতিকায় প্রাণী ম্যামথ রূপান্তরিত উষ্ণ প্রকৃতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে নির্বংশ হয়েছে। আমরা এখন আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন সংগ্রামের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। তাই চাতক পাখির মতো সকরুণ দৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জমুক্ত নতুন দিনের প্রত্যাশা করি। বিএনপি-জামায়াত পরিচালিত জোট সরকারের সময় অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাসের বাড়বাড়ন্ত একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল এ দেশের মানুষকে। রাজনৈতিক সংঘাত ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছিল। সব চরমই ধ্বংস বা রূপান্তরের পথ তৈরি করে। আমাদের সংঘাতের রাজনীতি পথ করে দিল রূপান্তরের। বিবদমান রাজনীতিকরাই ডেকে এনেছিলেন বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অতঃপর দুই বছরের চড়াই-উতরাইয়ে বড় সাফল্য একটি অবাধ নির্বাচনের পথ তৈরি হওয়া। দীর্ঘ সংগ্রামী ঐতিহ্য ধারণ করা বাঙালির বড় সুবিধা- হাজার সংকটের পরও বারবার ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। নির্বাচন সামনে রেখে আবার স্বপ্ন বুনে। তখন সুবিধাজনক আবস্থানে ছিল আওয়ামী লীগ। জোট সরকারের শাসনকালের অপকীর্তি মুক্তমনের ভোটারকে বিক্ষুব্ধ করেছিল। বিপুলসংখ্যক ভুয়া ভোটার তালিকা ও সাজানো নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসন কর্মকর্তাদের বিন্যাস অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় কার্যত বিএনপি ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল। নির্বাচনের মাঠে জামায়াত কখনো খুব ধর্তব্যের মধ্যে থাকে না। অতীতের নানা হতাশার কথা ভুলে মানুষ গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার আশায় ঐতিহ্যিক দল আওয়ামী লীগকেই মন্দের ভালো বলে বিবেচনা করেছিল।
সবাই ভেবেছিল আন্তরিকতা নিয়েই আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিন বদলাতে চান। অর্থাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন জরাগ্রস্ত দিনের শাপমুক্তি ঘটিয়ে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে টেনে নেওয়ার মতো নতুন দিনের যাত্রা শুরু করবে মহাজোট সরকার। সুন্দর সকাল দেখার স্বপ্নে বিভোর এ দেশের মানুষ সরল হিসাব কষেছিল। ভেবেছিল ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগ অনুকূল পরিবেশ পেলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী হবে। অতীতের ভুলগুলো এ বেলা শুধরে নেবে। অন্যায়, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস বিএনপিকে কীভাবে জনবিচ্ছিন্ন করেছিল- আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কাছ থেকে দেখেছেন। ওপরি পাওনা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ স্নাত এ দলটি পেয়েছে বিপুল জনসমর্থন। এসব কারণে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছিল, এ দেশের নষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে জাতি এবার আওয়ামী লীগের হাত ধরে বেরিয়ে আসবে। ইতিবাচক রাজনীতির ধারায় ফিরবে দেশ। নেতৃত্বের মনোবল এবার আকাশছোঁয়া হবে। দলীয়করণের সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে নিঃশঙ্কচিত্তে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির দেশপ্রেমিক মানুষকে কাছে টেনে বন্ধু বৃদ্ধি করবে। তার পর দিনবদলে দেওয়ার কঠিন অথচ মহৎ সংগ্রামে সবাই একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
এ দেশের রাজনীতিতে সুস্থ গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি হতে না পারায় আইনব্যবস্থা কখনো স্বাধীন হতে পারেনি। বাংলার ইতিহাসে প্রকৃত অর্থে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই ২০০ বছর। বাংলার সুলতানরা বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীন করে দিয়েছিলেন। এ কারণে ক্ষমতাবান কাজি আইনের প্রকৃত রক্ষক হতে পেরেছিলেন। সুলতানরা ছিলেন বিচারব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক। তাই স্বয়ং সুলতানের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিঃশঙ্কচিত্তে গ্রহণ করতেন কাজি। সুলতানি বাংলার কাজির আদালতে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সম্রাট হাম্মুরাবি ধাঁচের আইন কার্যকর ছিল না। অর্থাৎ একই অপরাধে ধনী আর ক্ষমতাবানের জন্য লঘু শাস্তি এবং দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের জন্য গুরু শাস্তি। সুলতানের অপরাধ প্রমাণিত হলে কাজিরা আইনের বিধান অনুযায়ী শাস্তি দিতে দ্বিধা করতেন না। কিন্তু প্রকৃত অর্থে আমাদের দেশের ক্ষমতার রাজনীতি আইনের শাসনকে স্বাধীন হতে দিল না।
চলমান এই বাস্তবতা দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে বেপরোয়া করে তোলে। ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপির দুর্নীতিকে উন্মোচন করেছিল। হয়তো ক্ষমতায় থাকার সুবিধা তাদের দুর্নীতিবাজ করে তুলেছিল। আওয়ামী লীগ নেতাদের দুর্নীতির কিছু খতিয়ানও প্রকাশ্যে আসে তখন। তবে বিএনপির তুলনায় তা ছিল নস্যি। হয়তো ক্ষমতায় না থাকার অসুবিধা এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে। হেভিওয়েট দুর্নীতিবাজরা সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে আইনের হাতে তখন ধরাশায়ী হয়েছিল। এই ভূমিকম্পের পর এ দেশের স্বাপ্নিক মানুষ আশা করেছিল, বিএনপির দুর্নীতিবাজদের পরিণতি দেখে অন্যরা শিক্ষা নেবে। কিন্তু বর্তমানে দুর্নীতিবাজরা ওই শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে হয় না। এ কারণে আইনের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়ে গেছে। এ দেশের প্রায় প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঘুষ একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের মধ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির খতিয়ান।
বর্তমান সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠার যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও তা ব্যবহার করতে পারছে না। এটি খুবই হতাশার কথা। এখনো সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গায় আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমাদের শঙ্কার জায়গা হচ্ছে, অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্ত করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এ দেশে এখন বিকল্প কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্নাত, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে এগিয়ে চলা আওয়ামী লীগ এবং এই দলের সরকার ন্যায় ও আদর্শচ্যুত হয়ে দুর্বল হয়ে যাক, তা দেশপ্রেমিক সচেতন মানুষ চাইবে না। কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি ভাবে তারা প্রতারিত হচ্ছে, কঠিন দলতন্ত্র তাদের অধিকার বঞ্চিত করছে, সরকার তাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছেÑ তা হলে ঘুরে দাঁড়াতে তাদের সময় লাগবে না। এ দেশের হাজার বছরের ইতিহাস সেটিই বলছে। কঠোর দলতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্র কখনো স্বস্তিদায়ক হয় না। মানতে হবে, উন্নয়নের ভবিষ্যৎ আনন্দের চেয়ে যাপিতজীবনের কষ্ট মানুষকে হতাশ করে বেশি।
লেখক:অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়