জলবায়ু
পরিবর্তনের অভিঘাত ও বৈশ্বিক বাজারের অস্থিতিশীলতা মোকাবিলায় জ্বালানি ও
বিদ্যুৎ খাতে নতুন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে- শনিবার জাতীয় দৈনিকে
প্রকাশিত প্রতিবেদনের এই ভাষ্য আশাজাগানিয়া, সন্দেহ নেই। কিন্তু এ উদ্যোগকে
আমরা সতর্কতার সঙ্গে স্বাগত জানাতে চাই মূলত বিদ্যমান মহাপরিকল্পনা
বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার দিকে নজর রেখে। যেমন- চলমান জ্বালানি মহাপরিকল্পনায়
প্রথমে ২০১৫, পরে ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিত
করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। বাস্তবে সেই লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও
পূরণ করা সম্ভব হয়নি। নতুন মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে তা ২০
শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব হবে- এতে আস্থা রাখা কঠিন। অথচ সময় থাকতেই কয়লার
ব্যবহার কমানোর বিকল্প নেই। স্বীকার করতে হবে, আসন্ন মহাপরিকল্পনায়
বিষয়টিতে জোর দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বাস্তবায়নে ধীরগতিসম্পন্ন ১০টি
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পও বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু মহাপরিকল্পনা
বাস্তবায়নে গতি আনা এবং প্রতিশ্রুতির তুলনায় প্রয়োগে জোর দেওয়া ছাড়া
লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন।
মনে রাখতে হবে, বৈশ্বিক জ্বালানি খাতে যে মূল্য
ও সরবরাহ-সংক্রান্ত অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, তা আগামী দিনগুলোতে আরও বাড়বে
বৈ কমবে না। প্রকাশিত অপর এক প্রতিবেদনে আমরা দেখেছিলাম, গ্যাস-কয়লাসহ
জ্বালানি খাতের প্রধান সব উৎস ও সরবরাহ-শিকল ক্রমেই অস্থির ও অনিশ্চিত হয়ে
পড়ছে। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি, বাংলাদেশের জ্বালানি খাত মূলত
গ্যাসনির্ভর হলেও ক্রমেই কমছে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদন। কয়েক বছর
আগেও যেখানে দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ২৭০ কোটি ঘনফুট ছিল, এখন তা কমে ২৪০ কোটিতে
নেমে এসেছে। এর বাইরে মজুদ ও উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ নিয়েও সুড়ঙ্গের
শেষ প্রান্তে আলো নেই; বরং আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই উত্তোলনযোগ্য অবশিষ্ট
গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভরসা জোগাতে পারত
সমুদ্র এলাকায় অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জোর দেওয়া। সে ক্ষেত্রেও আমরা
হতাশাজনক চিত্র দেখতে পাচ্ছি।
সাত বছর আগেই প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের
সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হলেও এখনও কেন জরিপ ও অনুসন্ধান কাজ
বহুলাংশে আটকে আছে- এ নিয়ে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে চলতি মাসেই আমরা তাগিদ
দিয়েছিলাম। এখন পর্যন্ত যে সরবরাহ লাইন মোটামুটি 'স্থিতিশীল' দেখা গেছে,
সেই এলপিজি খাতেও দেখা দিচ্ছে অস্থিরতা। এর কাঁচামালের ৯৮ শতাংশ আমদানি
করার বিষয়টিও না হয় আপৎকালীন বলে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু একদিকে যেমন দেশে
এনএলজি-নির্ভরতা বাড়ছে, তেমনই বিশ্ববাজারে 'হুহু করে' বাড়ছে এর দাম। কেবল
আর্থিক সাশ্রয়ের লক্ষ্যে নয়; পরিবেশগত দিক বিবেচনাতেও আমাদের এ খাতের ওপর
নির্ভরতা কমিয়ে আনতেই হবে। আর দীর্ঘ মেয়াদে হলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ
বাড়ানোই সময়ের দাবি।
দীর্ঘ সেই উল্লম্ম্ফনের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো
আশাব্যঞ্জক হারে দেখা যাচ্ছে না। সৌরবিদ্যুৎ ছাড়া অন্যান্য নবায়নযোগ্য
উৎসকে আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। সরকার যদি সত্যিই বিদ্যুৎ-বৈচিত্র্যের ওপর
জোর দিতে চায়, তাহলে বরং জলবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য উৎস খুঁজতে হবে।
হিমালয় অঞ্চলের খরস্রোতা প্রবাহগুলোকে কেন্দ্র করে লক্ষাধিক মেগাওয়াট
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের যে সম্ভাবনা রয়েছে, এ বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে। অভিন্ন
অববাহিকার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যে সেখানে অংশীদার হতে পারে, তাও বহুল
আলোচিত। মূল অধোগতি আসলে অগ্রগতির প্রশ্নে।
মনে রাখতে হবে, আমাদের
প্রধানমন্ত্রী এখন সিভিএফ তথা ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের প্রেসিডেন্ট। ফলে
এই বৈশ্বিক দুর্যোগ মোকাবিলায় জ্বালানি খাত 'সবুজ' করে তুলতে বৈশ্বিক
উদাহরণ স্থাপন করাও আমাদের দায়িত্ব। নতুন মহাপরিকল্পনায় অবশ্য 'ক্লিন
এনার্জি' সম্প্রসারণে জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বড় কথা হচ্ছে
বাস্তবায়নযোগ্যতা। স্বাগত জানাতে গিয়ে সতর্কতার প্রয়োজন আসলে সেখানেই। আমরা
প্রতিশ্রুতি ও পরিসংখ্যানের বদলে প্রয়োগ দেখতে চাই। নতুন নতুন
মহাপরিকল্পনা ভালো; কিন্তু বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে তা কাগজের তোড়া ছাড়া আর
কী?