নিজস্ব
প্রতিবেদক।। কুমিল্লা শহরের নানুয়া দিঘির পাড়ে দপর্ণ সংঘের পূজামণ্ডপকে
ঘিরে বিশৃংখলার শুরুতে খুবই উত্তেজিত এবং মারমুখি ভূমিকায় ছিলেন কিছু তরুণ ও
কিশোর বয়সী ছেলে। এরা কারা?-এই প্রশ্নটি এখন ঘুরে ফিরে সামনে আসছে। বিশেষ
করে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার যখন তাদের শান্ত করার চেষ্টা
করছিলেন তখন তাদেরকে ক্রমান্বয়ে উত্তেজিত হতে এবং আপত্তিকর মন্তব্য করতে
দেখা যায়। এমনকি ধর্মীয় নেতা ও আলেমরা যখন হাতজোড় করে তাদেরকে বিশৃংখলা না
করার আহবান জানাচ্ছিলেন তখন এই কিছু তরুণ ও কিশোর বয়সী ছেলেরা তাদের
বিরুদ্ধেও উগ্রভাব দেখিয়েছে। সেই সাথে তারা সম্মুখে থেকে সরাসরি অংশ নিয়েছে
সংঘর্ষে। এই কিছু তরুণ ও কিশোর বয়সী ছেলেদের গ্রেপ্তার করে আইনে আওতায়
আনলে অনাকাঙ্খিত এ ঘটনার রহস্য উন্মোচন সম্ভব বলে মনে করছেন তদন্ত
সংশ্লিষ্টরা। গত ১৩ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কুমিল্লার নানুয়া দিঘির
পাড়ে বিশৃংখলার নানাভাবে তোলা ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে কিছু তরুণ ও কিশোর
বয়সী ছেলেদের তৎপরতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এ দিকে পুলিশের অপরাধ
তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) কুমিল্লার বিশেষ পুলিশ সুপার খান মোহাম্মদ রেজোয়ান
জানান, আরো প্রায় বিশ জন গ্রেপ্তারের অপেক্ষায় আছে। এরাও আস্তে আস্তে
গ্রেপ্তার হয়ে যাবে। ধর্ম অবমাননার মামলায় গ্রেপ্তার ইকবাল হোসেনকে রিমাণ্ড
শেষে আদালতে উপস্থাপন করা হবে। অভিযুক্ত প্রধান আসামী ইকবাল হোসেন মানসিক
ভারসাম্যহীন নয়, সে একজন চতুর সুস্থ্য মস্তিস্কের মানুষ। আদালতে
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিবে কিনা বা আবার রিমাণ্ডে নেওয়া হবে কিনা তা
আজ জানা যাবে।
কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ আনওয়ারুল
আজিম জানান, ভিডিও ফুটেজ দেখে কিছু কিছু গ্রেপ্তার হয়েছে। আরো কিছু শনাক্ত
করা হচ্ছে। এদেরকেও ধরা হবে। তৎপরতা অব্যাহত আছে।
অনুসন্ধানে জানা ও
ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ঘটনাস্থলের দক্ষিণ পূর্ব কোনার বাসিন্দা কুমিল্লা
সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু গাড়িতে করে পূর্ব পাড় দিয়ে সকাল
৯টা ৫৯ মিনিটে ঘটনাস্থলে আসেন। এ সময় পূর্ব-উত্তর কোনায় অবস্থান নেওয়া কিছু
লোক শ্লোগান দেওয়া শুরু করে। একই সময়ে উত্তর পাড়েও প্রয়াত সাবেক মন্ত্রী
কর্ণেল অব. আকবর হোসেনের বাসার সামনে কিছূ যুবক দু’একটি শ্লোগান দেওয়া শুরু
করে। সকাল ১০টা ৪৬ মিনিটে উত্তর পাড়ে কিছু উশৃংখল যুবক রাস্তার উপর লাগানো
আলোকসজ্জার বাঁশ সজোরে নারাতে থাকে। কিছু বাঁশ তারা উপড়ে ফেলে। উত্তর
পূর্ব কোনার এই দৃশ্য দেখে উত্তর পশ্চিম কোনায় অবস্থান নেওয়া কিছু যুবক
আলোকসজ্জার বাঁশ নাড়াতে থাকে এবং উপড়ে ফেলে। এ সময় উভয় প্রান্তে ডিভি
পুলিশের সদস্যদের উত্তেজিত যুবকদের শান্ত করার চেষ্টা করতে দেখা যায়।
কিন্তু উত্তেজিত যুবকরা পূজামন্ডপের দিকে যাওয়া শুরু করলে কিছু মাদ্রাসা
ছাত্র তাদের সাথে শ্লোগান দিতে দিতে যায়। পুলিশ তাদের পূজামণ্ডপের গেইটে
আটকে দেয়। কিন্তু বেলা ১১ টা ১১ মিনিটের দিকে উত্তর-পূর্ব কোনায় অবস্থান
নেওয়া যুবক ও কিছু মাদ্রাসার লোককে উত্তর পশ্চিম পাড়ে কর্ণেল অব. আকবর
হোসেনের বাসার সামনে আসতে দেওয়া হয়। এ সময় কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ
কামরুল হাসান, পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র
মনিরুল হক সাক্কু ও কুমিল্লা মহানগর যুবলীগের আহবায়ক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ
সহিদকে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। এ সময় মেয়র
মনিরুল হক সাক্কু উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করা উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতে দেখা
যায়। কিন্তু উত্তেজিত লোকজন আরো উত্তেজিত হয়ে পড়লে তিনি দুএকজনকে ধমক দেন।
ঠিক এ সময়েই উত্তেজিত লোকজন শ্লোগান দেয় ‘নারায়ে তাকবির’, ‘আল্লাহু আকবর’।
এই শ্লোগান ধরতে দেখা যায় হালকা দাড়ি থাকা এক যুবককে। শ্লোগান তুলে দিয়ে
আস্তে করে সরে পড়েন ঐ যুবক। ঘটনার ছতি তুলতে দেখা যায় কুমিল্লার জেলা
প্রশাসক কামরুল হাসানকে। এরপর বক্তব্য রাখার চেষ্টা করেন কুমিল্লা মহানগর
যুবলীগের আহবায়ক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সহিদ। এ সময় ধাক্কা ধাক্কি শুরু হয়।
৮/১০ জন তরুণ ও কিশোর বয়সী ছেলেকে এ সময় সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত অবস্থায় দেখা
যায়। সে সময় তারা মারমুখি হয়ে উঠে। কিছু ধর্মীয় নেতা এ সময় তাদেরকে ধাক্কা
দিয়ে পিছনে নেওয়ার চেষ্টা করেন। বেলা ১১ টা ১৩ মিনিটের উত্তর-পূর্ব পাড়
থেকে আকস্মিকভাবে পূজামণ্ডপে হামলা শুরু হয়। পূজামণ্ডপের বাঁশ হাতে মণ্ডপের
প্যান্ডেল ও প্রতিমা ভাংচুর করে। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ার সেল
নিক্ষেপ করে। উত্তর পশ্চিম পাড়ে মেয়র সাক্কু বক্তব্য রাখার সময় উত্তেজিত
৮/১০ জন তরুণ ও কিশোর বয়সী ছেলে এসময় পুলিশকে লক্ষ্য করে ব্যাপক ইটপাটকেল
নিক্ষেপ করতে থাকে। ধর্মীয় নেতারা তাদের হাতজোড় করে বারিত করার চেষ্টা করলে
উত্তেজিত ঐ ৮/১০ জন তরুণ ও কিশোর বয়সী ছেলে তাদের লক্ষ্য করে অশ্লিল
অঙ্গভঙ্গি করে।
এ দিকে পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখা ইকবাল হোসেন
ভাংচুরের সময় উত্তেজিত জনতাকে আরো উৎসাহিত করা জন্য পুলিশকে লক্ষ্য করে এবং
সরকার ও হিন্দু সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে অশ্লিল কথা বলতে দেখা যায়। পুলিশের
ধাওয়ার সময় সে পুলিশ লক্ষ্য করে বলে ‘ আইনের লোক চোর’, ‘সব মুসলমানের টাকা
পয়সা’, ‘কিসের আইনের লোক, তোরা শত্রু’, ‘ তোরা রাজাকার, তোরা আলবদর’।
সেখানে থাকা সাংবাদিকের ক্যামেরায় ধরা পড়বে বলে সে ক্যামেরার পেছন থেকে
কথাগুলো বলতে থাকে। পরে পুলিশ তাদের দারোগা বাড়ির দিকে ধাওয়া করলে তারা সে
দিকে গিয়ে অবস্থান নেয়।
এদিকে ধর্ম অবমাননা মামলার তদন্তকারী সংস্থা
সিআইডি সূত্রে আরও জানা যায়, কুমিল্লায় পূজামণ্ডপ কান্ডের প্রধান অভিযুক্ত
ইকবালসহ চার আসামীর দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডও শেষ হচ্ছে আজ মঙ্গলবার। দুই দফার
টানা এগারো দিনের রিমান্ডে সিআইডি’র জিজ্ঞাসাবাদে আসামীদের কাছ থেকে
বেরিয়ে এসেছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। এখন শুধু যাচাই-বাছাই করে ইন্ধনদাতাদের
আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে সিআইডি। এছাড়া, এই এগারো দিনে ইকবালসহ চার
আসামীদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে স্থানীয়ভাবে জনপ্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক
সংশ্লিষ্টদেরও জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হয়েছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত
বিভাগ (সিআইডি) কুমিল্লার বিশেষ পুলিশ সুপার খান মোহাম্মদ রেজোয়ান বলেন,
কুমিল্লার ঘটনায় ধর্ম অবমাননা, হিন্দুদের পূজামণ্ডপ ভাংচুর ও মন্দিরে
হামলার ঘটনায় কুমিল্লার কোতয়ালী, সদর দক্ষিণ, দাউদকান্দি ও দেবিদ্বার থানায়
পৃথক ১২টি মামলা হয়েছে। তারমধ্যে অভিযুক্ত ইকবালের ধর্ম অবমাননা মামলাটিসহ
এখন পর্যন্ত পাঁচটি মামলা তদন্ত করছেন সিআইডি। অন্যান্য মামলাগুলো হচ্ছে
কোতয়ালী থানায় পুলিশের দায়ের করা আইসিটি আইনে ফেসবুকে লাইভ করা ফয়েজের একটি
মামলা। কোতয়ালী ও সদর দক্ষিণ থানায় মন্দিরে ভাংচুর করা পুলিশের দায়ের করা
দুইটি মামলা এবং সর্বশেষ ফেজবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেফতার সাজ্জাদ ও
ফয়সাল নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সিআইডির দায়ের করা একটি মামলা। এই পাঁচ
মামলায় ইকবালসহ এইপর্যন্ত অন্তত ২৫জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গত ১৩
অক্টোবর নগরীর নানুয়ারদীঘির পাড় পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনায়
কুমিল্লা নগরের কয়েকটি পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
এর জেরে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, নোয়াখালীর চৌমুহনী, রংপুরের পীরগঞ্জসহ দেশের
বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। পরে পুলিশের সংগ্রহকৃত
সিসিটিভির ফুটেজের মাধ্যমে পূজামণ্ডপে কোরআন রাখা প্রধান অভিযুক্ত ইকবালকে
শনাক্ত করে পুলিশ। পরে গত ২১ অক্টোবর অভিযুক্ত ইকবালকে কক্সবাজার থেকে
গ্রেফতার করে পুলিশ। ২২ অক্টোবর তাকে কুমিল্লা এনে ২৩ অক্টোবর আদালতে হাজির
করা হলে আদালত ইকবাল, মাজারের দুই খাদেম ও ৯৯৯-এ কল করা ইকরামকে সাতদিনের
রিমান্ড মঞ্জুর করে। পরে দ্বিতীয় দফায় গত ২৯অক্টোবর আদালত আবারও ইকবালসহ
চার আসামীর ৫দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।