শচীন কর্তার বাড়িতে
Published : Monday, 8 November, 2021 at 12:00 AM
মির্জা আবু হেনা কায়সার টিপু ||
‘শোন গো দখিনা হাওয়া প্রেম করেছি আমি’ এস ডি বর্মণের কণ্ঠে সেই প্রখ্যাত গান। বলছিলাম উপমহাদেশের সংগীতের রাজপুত্র কুমার শচীন দেববর্মণের কথা।
শচীন দেববর্মণ ছিলেন ত্রিপুরা রাজের রাজপুত্র। বাংলা ও হিন্দি গানের সংগীত পরিচালক সুরকার ও গায়ক হিসেবে বিশ্বখ্যাত এই সংগীত প্রতিভার জন্ম কুমিল্লা শহরে।
আমরা যখন কুমিল্লায় থাকতাম। শচীন দেববর্মণের ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িটার কাছে ছুটে যেতাম প্রায়ই। আমার জন্ম গ্রামটা বুড়িচংয়ের শিবরামপুর। কুমিল্লা জেলার একটি সবুজ শ্যামল গ্রাম। কুমিল্লা শহরটা আমার গ্রাম থেকে ১২ কিলোমিটারের পথ। কুমিল্লা শহরেই কেটেছে জীবনের অনেকটা সময়। আমি তো প্রায়ই পায়ে হেঁটে চলে যেতাম আমার মফস্বল শহরটার আঙিনায়। শহরের কোনো প্রান্তই আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে ছিল না। থাকতাম গ্রামেই। ছুটে যেতাম প্রিয় শহরের বুকে। ফিরতাম রাতে। জীর্ণশীর্ণ দাঁড়িয়ে থাকা শচীন কর্তার বাড়িটা আমার ভীষণ প্রিয়। বাড়িটার সামনে গেলেই মনে হয় শচীন কর্তা এই বুঝি গেয়ে উঠবেন সেই গানটি ‘তুই কি শ্যামের বাঁশি রে, ঘরের বার...’।
শচীন দেববর্মণ ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন কুমিল্লায়। শচীন দেববর্মণ ত্রিপুরা রাজ্যের রাজপুত্র হলেও তিনি মিশতেন সাধারণের সঙ্গে। অখণ্ড ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের খুবই জনপ্রিয় শহর ছিল কুমিল্লা। রাজ–রাজেরা এ শহরটাকেই বেছে নিয়েছিলেন বসবাসের জন্য। একজন অসাধারণ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে শচীনদার গায়কি কৌশলে ছিল ভিন্ন মাত্রা। বাংলা গান তথা ভাওয়াইয়া সুরের দরদ নিয়ে উপস্থাপনে তাঁর সমকক্ষ বিরল। সংগীতের অসামান্য অবদান তাঁকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে বাঙালি হৃদয়ে। শচীন দেববর্মণ পরে এস ডি বর্মণ নামে পরিচিত হয়েছেন। কলকাতা শহরে জীবনের হিসাব–নিকাশের চূড়ান্ত অধ্যায় রচনা করে ফেলেন এই মহাগুণী।
বাংলা গানকে উচ্চতায় নিতে কলকাতা তাঁর জীবনের মূল ভিত্তি রচনা করে দেয়। কলকতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও গানই ছিল শচীন কর্তার জীবনের মানে। বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) শহরেই সংগীতের শীর্ষস্থান দখল করেন হিন্দি জনপ্রিয় সব সিনেমার জন্য গান করে, গান সুর করে, সংগীত পরিচালনা করে। এই মহান মানুষটি যদিও শৈশবে আগরতলা শহরের একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে ভর্তি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি পরে ভর্তি হন কুমিল্লা শহরের ইউসুফ স্কুলে। তারপর পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন কুমিল্লা জিলা স্কুলে। ১৯২০ সালে জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৪ বছর বয়সে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে (বর্তমানে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া গভর্নমেন্ট কলেজ) ভর্তি হন। ১৯২২ সালে এ কলেজ থেকে আইএ ও ১৯২৪ সালে বিএ পাস করেন।
কুমিল্লা শহর শচীন কর্তার অস্তিত্বজুড়েই। একটি কথা বলে রাখি, তিনপুরুষের শচীন প্রেম যে আমার। দাদা হাফিজ উদ্দিন (আমার ছয় মাস বয়সে তিনি প্রয়াত হয়েছেন) শচীন কর্তার গানের ভক্ত ছিলেন শুনেছি। আব্বা আবদুল মজিদ (তিনি আমার ১১ বছর বয়সে পরলোকে গেছেন) শচীনদার গানের পাগল প্রেমিক। মা জাহানারা বেগম ছিলেম শচীন কর্তার গানের একজন মুগ্ধ শ্রোতা।
আমি, আমাদের তো শচীনদার গান ছাড়া চলেই না। শচীনদার বাড়িটি আমাকে এখনো টানে। দারুণ আকর্ষণ এই বাড়িটির প্রতি আমার। উপমহাদেশের এই প্রখ্যাত মানুষটি যদিও ৬৯ বছর বয়সে ৩১ অক্টোবর ১৯৭৫ সালে বোম্বেতেই পরলোকগমন করেন। তাঁর জন্য কুমিল্লার বাড়িটি কাঁদে, কাঁদে শহর কুমিল্লাও, কাঁদে আমারও মন। সময় পেলেই ছুটে যেতে মন চায় পৈতৃক নিবাস মজিদ কুটিরে, আর শচীন কর্তার ঘরে। এই দুয়ের ভেতর যে আমার আমি লুকিয়ে।
লেখক: অভিনয়শিল্পী, কবি ও লেখক