অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ||
গত ৪নভেম্বর গ্লাসগোয় চলমান বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে ১৯০টি দেশ ও সংস্থা জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার বন্ধ করতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশে ও দেশের বাইরে বিনিয়োগ বন্ধ করতেও রাজী হয়েছে। তবে চীন, ভারত, অষ্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মত সবচেয়ে বেশি কয়লা ব্যবহারকারী দেশসমূহ কয়লা ব্যবহার বন্ধে কোন প্রতিশ্রুতি দেননি। ব্যাপক কয়লা ব্যবহারকারী চিলি, পোল্যান্ড ও ভিয়েতনাম প্রতিশ্রুতি দেয়ার তালিকায় আছে। যুক্তরাজ্যের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, ২০৩০ সনের মধ্যে বড় অর্থনীতির দেশগুলো কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর গরীব দেশগুলো বন্ধ করবে ২০৪০ সাল নাগাদ। তবে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য ও জ্বালানি বিষয়ক ছায়ামন্ত্রী মিলিব্যান্ড বলেন, চীন ও অন্যান্য অধিক কার্বন নি:সরণকারী দেশগুলোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের ফাঁক রয়েছে। তারা আভ্যন্তরীণভাবে কয়লার ব্যবহার বন্ধে প্রতিশ্রুতি দেয়নি। যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য ও জ্বালানি বিষয়ক মন্ত্রী কোয়াসি কোয়ারটেং বলেন, বিশ্বসঠিক পথেই এগোচ্ছে, ৪০টিরও বেশি দেশ এ সংক্রান্ত বিবৃতিতে সই করেছে। এর মধ্যে পোল্যান্ড ভিয়েতনাম চিলিসহ ১৮টি দেশ প্রথমবারের মত কয়লার ব্যবহার থেকে সরে আসা এবং নতুন করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও বিনিয়োগ না করতে প্রতিশ্রুতি প্রদান করিল। পর্যবেক্ষকদের মতে, দক্ষিণ আফ্রিকা, পোল্যান্ড ও ভারতের মত দেশগুলোকে জীবাশ্ম ছেড়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারে বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে হবে। কপ-২৬ এ যোগদানকারী পরিবেশবাদী সংস্থা গ্রিনপিসের প্রতিনিধি দলের প্রধান ইউয়ান পাবলো ওসোরনিও বলেছেন, বর্তমান সংকটের দশকে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে যে সকল ব্যবস্থাদি গ্রহণ ছিল আবশ্যক- সেই একমত্য থেকে তা এখনও অনেকখানি দূরে।
গ্লোবাল কার্বন প্রকল্পের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ২০২০ সালের মহামারীতে নি:সরণ ৫.৪ শতাংশ হ্রাস হওয়ার পরও বৈশ্বিক কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন এ বছরে ৪.৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গোটা বিশ্ব শক্তি উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানি হচ্ছে প্রধান উপাদান। মহামারীতে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে গ্যাস এবং দুষিত কয়লা থেকে নির্গমন এবছর ২০২০ সালের হ্রাসের তুলনায় বেশি বৃদ্ধি পাবে। ২০২০ সালেরও তুলনায় ২০২১ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গমন বেড়ে ৩৯.৪ বিলিয়ন টনে পৌছবে। কপ-২৬ এ ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মত কার্বন নি:সরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিশ্বে কার্বন নি:সরণের চতুর্থ অবস্থানে আছে ভারত। প্রথম তিন স্থানে আছে যথাক্রমে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। সম্মেলনে যোগ দেয়া ১২০টি দেশের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা ২০৫০ সালের আগেই বিশ্বে কার্বন নি:সরণের মাত্রা শূন্যে নামিয়ে আনতে চায়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ২০৫০ সালের মধ্যেই কার্বন শূন্যে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করলেও চীনের লক্ষ্য ২০৬০ সালে।
২০১৯ সালে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের চেয়ে দ্বিগুণ পরিমান, প্রায় ৪০ হাজার প্রতিনিধি কপ-২৬ সম্মেলনে যোগ দিয়েছে। দরিদ্র দেশগুলোর প্রতিনিধি ও পরিদর্শকরা বলেছেন, তাদের সহকর্মীরা এ সম্মেলনে যোগ দিতে হিমশিম খেয়েছেন। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, কোয়ারেন্টাইনের নিয়মের শেষ মুহূর্তের পরিবর্তন, বিমাণ ভাড়া এবং হোটেলের উচ্চ ব্যয়ের কারণে অনেক প্রতিনিধিই ভিডিও কলে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছেন। গ্লাসগোর সম্মেলন কক্ষে নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের অনুমোদন সাপেক্ষে বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর পরিবেশ গোষ্ঠিগুলো বলেছে তারা বৈঠকে অংশ নিতে পারেননি। এক হাজার ৫শ’টি সিভিল সোসাইটি গ্রুপের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্কের আন্তর্জাতিক নির্বাহী তাসনিম এসপ বলেন, “বিশ্বের তাপমাত্রা শিল্প পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার জন্য এ সম্মেলনই ছিল সেরা এবং শেষ সুযোগ। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য সে লক্ষ্যের কাছে ধারেও সম্মেলনটি পৌছতে পারে নাই। আলোড়ন সৃষ্টিকারি সুইডিশ পরিবেশবাদী গ্রেটা থুনবার্গ পরিবেশ বিপর্যয় রোধে গ্লাসগোতে আন্দোলনরত সক্রিয় কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, এ সম্মেলনে অংশ নেয়া নেতাদের মাধ্যমে কোন পরিবর্তন আসবে না। পরিবর্তন আসবে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে উদ্যোগ গ্রহণ ও সচেতনতার মাধ্যমে, কপ-২৬ মহাযজ্ঞের পাশেই তরুণ পরিবেশবাদীদের নিয়ে আয়োজিত ‘ফ্রাইডেস ফর দ্যা ফিউচার’ নামক কর্মসূচির মধ্যমনি ছিলেন থুনবার্গ। ক্ষোভঝড়া কন্ঠে তিনি বলেন, কপ-২৬ সম্মেলনটি এর আগের জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মতই শুধু আনুষ্ঠানিকতা। বিশ্বনেতারা আমাদের আশাব্যঞ্জক কোন অবসস্থানে নিয়ে যেতে অপারগ।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও
সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল