মোস্তফা কামাল ।।
অসুখ-বিসুখ থেকে শুরু করে চুরি-দুর্নীতি, খুন-খারাবি, ছিনতাই-রাহাজানিসহ অনেক কিছুতে করোনার দোহাই দেওয়ার একটা মৌসুম যাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে নাÑ বৈশ্বিক মহামারী মৃত্যু, আক্রান্তসহ দুর্যোগ বাড়িয়েছে। দুর্যোগই যে সুযোগ হয়ে দেখা দেবেÑ এমন শঙ্কা ছিল অনেকের। বাস্তবে সেটিই ঘটে চলছে।
শিক্ষাজগতে ঝরে পড়া বাড়িয়েছে এ মহামারীটি। আবার করোনার কারণে প্রকল্প বেড়েছে। প্রকল্পে গাফিলতিও বেড়েছে। বারবার বরাদ্দও বাড়ছে। দেশজুড়ে ক্ষুধার্ত ও কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে করোনার কারণে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাও করোনার দোষে বিভিন্ন কাøকারখানা বেড়ে যাওয়ার সমীক্ষা দিচ্ছে। করোনা নামের অতিমারী অনলাইন ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছে বাংলাদেশেও। ই-কমার্স নামে ছলচাতুরি-প্রতারণার দুয়ারও খুলেছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমোর ব্যবহার তো তুঙ্গে তুলে দিয়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনলাইনে কেনাকাটা বেড়েছে অবিশ্বাস্যমাত্রায়। অনলাইনে ফলমূল, শাকসবজি, মাছ, মাংস থেকে শুরু করে প্রসাধনী, কাপড়চোপড়, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, এমনকি কোরবানির পশু পর্যন্ত কেনার লাইন পড়ে। মাত্র হাজার দেড়েক প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হলেও অনলাইনে ব্যবসা করছে অনিবন্ধিত প্রায় অর্ধ লাখ প্রতিষ্ঠান। তাই বলে মহামারীতে চুরি, ছিনতাই, দস্যুতা, ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের মতো অপরাধও বাড়ে বা বাড়তে পারে? হ্যাঁ, বাড়ে-বাড়ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানও সেটিই বলে। চলতি বছরের হিসাব পেতে আরও মাস কয়েক সময় লাগবে। পুলিশের এ বছর শেষ করা গত বছরে দেশের অপরাধ পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক তথ্য দিচ্ছে।
খুন, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, দস্যুতার সঙ্গে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ধারণার বাইরে। সারাদেশের থানাগুলোয় হওয়া মামলার ভিত্তিতে পুলিশ সদর দপ্তরের করা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছর দেশে দৈনিক গড়ে ১৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যৌন সহিংসতা ও ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে করোনার এত ধার? পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) নতুন একটি টার্ম ব্যবহার করেছে। তারা অপরাধীদের বলছে ‘পাওয়ার রেপিস্ট’। এ ধরনের ধর্ষকরা ভুক্তভোগীকে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে ধর্ষণ করে। করোনা তাদের পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়েছে? কীভাবে? অবশ্যই বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আবার ধর্ষণ এখন গুরুতর পর্যায়ের অপরাধের পর্যায়ে নেই। কঠোর আইন থাকলেও ভয়-ভীতি কাজ করছে না। সেদিন হাফ ভাড়া দিতে চাওয়ায় এক কলেজছাত্রীকে ধর্ষণে ছাড় দিলেও ধর্ষণের হুমকিতে ছাড় দেয়নি বাসের হেলপার। এর প্রতিবাদে ও সংশ্লিষ্টদের বিচারের দাবিতে রাজধানীতে শিক্ষার্থীরা শোডাউন করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক ছাত্রী অভিযোগ করেছে, হাফ ভাড়া দেওয়ায় বাসের চালক ও হেলপার প্রকাশ্যে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে। ওই ছাত্রী কলেজে আসতে শনিরআখড়া থেকে ঠিকানা পরিবহনের বাসে ওঠে। সেখান থেকে কলেজের ভাড়া ১০ টাকা। কিন্তু তার কাছ থেকে ১৫ টাকা ভাড়া রাখা হলে নিজেকে স্টুডেন্ট বলে ১০ টাকা ফেরত চাইলে হেলপার ধর্ষণের হুমকিসহ নিম্ন ভাষায় কথা বলে। এরই মধ্যে ড্রাইভার-হেলপারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কি বিচার হবে? তা এখনো প্রশ্নের চক্করে। তারা ধর্ষণ করনি। ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে মাত্র।
এমনিতেই ধর্ষণ এখন অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত অপরাধ। তার ওপর ধর্ষণ নিয়ে বিচারক বেগম কামরুন্নাহারের একটি রায় ও কিছু নির্দেশনা টক অব দ্য কান্ট্রিতে রূপ নিয়েছে। ছিঃ ছিঃ করছে মানুষ। এর জেরে কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছু প্রশ্নের জš§ দিয়ে তিনি ভিন্নমানের ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। বিশেষ করে তার ৭২ ঘণ্টার পর ধর্ষণ মামলা না নেওয়ার নির্দেশনাটির পর্যালোচনা-সমালোচনা কতদিন যে চলবে, তা কারও পক্ষে বলা কঠিন। ঘুরেফিরে কয়েকদিন পর পরই ধর্ষণ গরম ইস্যুতে রূপ নিচ্ছে। তার ওপর ডিজেল-কেরোসিন ইস্যুর মধ্যেও ঢুকে পড়েছে ধর্ষণচেষ্টা ইস্যু। এর জেরে মূল ইস্যু ঢাকা পড়তে আর কিছু লাগে না। শিক্ষার্থীরা ছিল হাফ ভাড়ার আন্দোলনে। ঘটনার পরম্পরায় তা চলে গেছে সতীর্থকে ধর্ষণের হুমকির বিচার দাবিতে। কোনো চতুর উকিল করোনার ওপর দোষ দিয়ে এখন আদালতে হেলপার বা ধর্ষকদের ছাড় দেওয়ার যুক্তি দাঁড় করিয়ে দেন কিনা, তা কে জানে! সংসারে অশান্তি, পরকীয়া, বিয়ে বিচ্ছেদের দোষও করোনার? ঢাকার বাইরেও সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ও আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করা হয়। উত্তর-দক্ষিণ দুই সিটি করপোরেশনের তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকাতেই দিনে ৩৮টি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর মাসে বিচ্ছেদ বেড়েছে ৯৯টি। প্রকৃত সংখ্যাটি হবে আরও। নিয়ম অনুযায়ী বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে দুইপক্ষের মধ্যে কোনো মীমাংসা না হলে ডিভোর্স কার্যকর হয়ে যায়। এর বাইরের অঙ্কটি অবশ্যই কম হবে না। কারণ ভাসমান, বস্তিবাসী বা নিম্নআয়ের, এমনকি উচ্চমার্গের মানুষের মধ্যে বিয়ে বিচ্ছেদ নিয়ে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউপি অফিস পর্যন্ত জানানোর প্রবণতা নেই। বরং তারা চেষ্টা করেন ঘটনা যেন পাশের কেউও না জানেন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে তালাকের আবেদন করেছেন ৫ হাজার ৪৮৭ জন। এর মধ্যে ডিএনসিসিতে আবেদন ২ হাজার ৮২৫টি ও ডিএসসিসিতে ২ হাজার ৬৬২টি। এই হিসাবে ডিএসসিসি ও ডিএনসিসিতে দিনে ৩৭টি তালাকের আবেদন পড়ছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা শহরে তালাকের আবেদন জমা পড়ে ৬ হাজার ৩৪৫টি। এর মধ্যে স্ত্রীদের আবেদন ৪ হাজার ৪২৮টি ও স্বামীদের ১ হাজার ৯১৭টি।
করোনাকালে বা সম্প্রতি বিয়ে বিচ্ছেদের এই ভয়ঙ্কর প্রবণতা নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। কেন ফুটফুটে সন্তান, সুন্দর সংসার, দীর্ঘ দাম্পত্যজীবন, এক সময়ের মধুর সম্পর্কের স্মৃতি কোনো কিছুই বিয়ে বিচ্ছেদকে আটকাতে পারছে না? আরও উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, এই বিয়ে বিচ্ছেদে নারীরাই এখন এগিয়ে। তারাই (প্রায় ৭০ শতাংশ) আগ বাড়িয়ে যান বিচ্ছেদ ঘটাতে। এটি কিসের জের? গবেষণা ও বিশ্লেষণ জরুরি। স্বার্থের সংঘাত, অর্থের অভাব, পর নর-নারীতে আসক্ত ও মাদকাসক্ত হয়ে পড়া, যৌতুক, মতের অমিল আর আত্মসম্মান মোকাবিলায় চূড়ান্ত হচ্ছে বিয়ে বিচ্ছেদ। এসব কারণ আগেও ছিল। করোনা কি কারণগুলোকে আরও চোখা করেছে? করোনার মতো এমন দুর্যোগপূর্ণ অভিজ্ঞতা অদূর অতীতে মানুষের ছিল না। তাই গবেষণা-বিশ্লেষণের বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও চলমান করোনা মহামারীর মধ্যে পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে গেছে। সহিংসতার মাত্রা এমন পর্যায়ে যাচ্ছে যে, বিয়ে বিচ্ছেদের মতো ঘটনাও ঘটছে। সেখানকার স্বাস্থ্যসেবীরা মনে করছেন, করোনা মহামারীর জেরেই এসব পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। তাই বিভিন্ন রাজ্যে মানসিক সেবা দেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
এ সময়টায় দেশে শিশুর প্রতি সহিংসতা আরও বেড়েছে। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৭ মাসে শিশুর প্রতি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ১৯৯টি। এই ৭ মাসে খুন হয়েছে ৩৬৫ শিশু। এটি আইন ও সালিশ কেন্দে র পরিসংখ্যান। তাদের পরিসংখ্যান জানায়, ২০২০ সালে একই সময়ে শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ছিল ৯৮৬টি। ২০১৯ সালে বছরজুড়ে ঘটেছিল ২ হাজার ১৮৪টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা। আগের বছর তা ছিল ১ হাজার ৫৩২টি। কেবল তথ্য বা বিশ্লেষণ নয়, সামগ্রিকভাবে এসব ঘটনার কার্যকর পদক্ষেপ কাম্য।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক এবং বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন