![কুমিল্লায় যুদ্ধশেষের যুদ্ধ কুমিল্লায় যুদ্ধশেষের যুদ্ধ](https://comillarkagoj.com:443/2021/12/16/1639592276.jpg)
মোস্তফা হোসেইন ||
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিলো বিশ্বের যুদ্ধের ইতিহাসে ব্যতিক্রম।কারণ এই যুদ্ধ ছিলো অসামরিক বনাম সামরিক বাহিনীর। একপক্ষে ছিলো নারীপুরুষ-শিশুকিশোর নির্বিশেষে সমগ্র জাতি, অন্যদিকে ছিলো আধুনিক সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী।যে কারণে পৃথিবীর অন্য গণযুদ্ধগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা জনযুদ্ধ ছিলো অন্যরকম।
সেই যুদ্ধের তথ্য সংগ্রহে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাকে ঘুরতে হচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামে। বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে কাজ করতে গিয়ে। প্রশংসার পাশাপাশি টিপ্পনী কখনো সন্দেহ সবই অভিজ্ঞতার ঝুড়িতে। কুমিল্লার কথাই বলি।
আমি মুক্তিযোদ্ধা হই কী করে?
১৯৯৬ সালে ফাল্গুন চৈত্র হবে সময়টা। ওই সময়ের ব্যাপক জনপ্রিয় দৈনিক জনকণ্ঠে কাজ করি। সম্পাদক ও মুক্তিযোদ্ধা তোয়াব খানকে অনুরোধ করি, মুক্তিযুদ্ধের অপ্রকাশিত কিংবা কম প্রকাশিত ঘটনাবলী সংগ্রহ করতে চাই। তিনি সম্মত হওয়ার পর নিজের জেলা দিয়ে শুরু করা।
গেলাম বুড়িচং থানা এলাকায়। সঙ্গে প্রিয়জন অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম।কালিকাপুর আব্দুল মতিন খসরু কলেজের সামনে একটি দোকানে বসে চা খেতে খেতে প্রবীণ মানুষ খুঁজছিলাম। একজন টুপি দাড়ি পরিহিত মানুষ পেলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম একাত্তরের কথা।বললেন আজ্ঞাপুর,আনন্দপুর ও আশেপাশে একবারে জঙ্গলবাড়ি থেকে শুরু করে নানা এলাকার নৃশংসার স্মৃতি। ভাবলাম-তার সূত্রে পাওয়া জায়গাগুলো ঘুরতে ঘুরতেই অনেক সময় লেগে যাবে। মনে মনে ছক তৈরি করি কাজের।
একসময় জিজ্ঞেস করি,আপনি কি মুক্তিযোদ্ধা?
তার জবাব, না ভাই আমি মুক্তিযুদ্ধ করিনি।
কি করতেন তখন?
জবাব ছিলো- দেশে থাকা তো আর সম্ভব নয়। চলে গিয়েছিলাম ওপারে। শরনার্থী ক্যাম্পের থাকলেও যুবশিবিরে একটা মসজিদ ছিলো, সেখানে নামাজে ইমামতি করতাম।(যুবশিবিরের নাম ভুলে গিয়েছি)।
আমার প্রশ্ন-যুব শিবিরের মসজিদে ইমামতি করতেন,তাহলে মুক্তিযোদ্ধা নন কেন?
আমি কি যুদ্ধ করেছি যে মুক্তিযোদ্ধা হবো?
সেদিন তিনি আমাকে কয়েক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতার জন্য। ঘুরতে ঘুরতে প্রশ্ন জেগেছিলো মনে- কী সহজ মানুষগুলো, জেনে না জেনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাদের প্রাপ্তির কোনো আকাঙ্ক্ষা ছিলো না,এখনও তারা জানেন না সামরিক বিধি অনুযায়ী,সামরিক বাহিনীর কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টগণ সামরিক সুবিধাদি পেয়ে থাকেন। কিন্তু তিনি জানেনই না তিনিও সেই সুবাধে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করতে পারেন।
একাত্তরে হাতে ছিলো গুলির বাক্স এখন বাঁশের লাঠি
এমনই আরও দুটি উদাহরণ দেই। সেটাও কালিকাপুরেরই কাছের একটি ঘটনা। অধ্যক্ষ সৈয়দ আব্দুল কাইউমকে নিয়ে গিয়েছি সম্ভবত গাজীপুর হবে নাম গ্রামটার। কয়েকটি দোকানঘর রাস্তার পাশে। অধ্যক্ষ সাহেব মোটর সাইকেল থামিয়ে ঢুকলেন একটি দোকানে। উনার ছাত্রের বয়সেরই একজনকে তিনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধে পা হারানো বয়স্ক লোকটাকে খবর দিতে পারো?
ছেলেটি কিছু সময় পরই দোকানে নিয়ে আসে একজনকে। প্রবীণ মানুষ। বাঁশের লাঠিকে একটি পায়ের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে আসছেন।চুল দাড়ি পেকে গেছে। তারপরও সুঠামদেহী লম্বা মানুষ।
দোকানে বসেই কথা হচ্ছিলো তার সঙ্গে। একাত্তরে তৈলকুপি হত্যাকাণ্ডের পরপরই তিনি ভারতে চলে গিয়েছিলেন। থাকতেন শরনার্থী ক্যাম্পে। রিলিফ হিসেবে পাওয়া সামগ্রী দিয়ে জীবন বাঁচানো কষ্টকর ছিলো। কাজ খুঁজছিলেন তিনি।পেয়েও যান একসময়। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া। গুলির বোঝা বয়ে নিয়ে যেতেন তিনি। প্রায় প্রতিদিনই যেতেন।বিনিময়ে এক দুই টাকা করে পেতেন দৈনিক।
সেই জোবেদ আলীর জীবনে ক্ষত তৈরি হয়ে যায়,দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর। ডিসেম্বর মাসের প্রথমদিকে যখন কুমিল্লা শত্রুমুক্ত হয়। মানুষ অস্থির হয়ে যায় দেশে ফিরে আসার জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের নিষেধ উপেক্ষা করে তিনি রওনা হন নিজ গ্রামের উদ্দেশে। এত এত যুদ্ধস্থল ঘুরেছেন কিন্তু দেশে ফেরার সময় সেই অভিজ্ঞতা তার কাজে লাগেনি। সীমান্তে পাকিস্তানি বাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে একটি পা হারান তিনি।
নিজের পা হারালেও একটি স্বাধীনদেশ পেলেন বিনিময়ে।সেই জোবেদ আলী স্বাধীনতা লাভের ৫০বছর পরও হাত পেতে জীবন চালান। এবার নিজের মনে প্রশ্ন। যিনি যুদ্ধের ময়দানে গুলির বাক্স বয়ে নিয়ে গেছেন, যোদ্ধাদের কাজ করেছেন শত্রুর কাছাকাছি গিয়েও।তিনি কি মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেন না?
এখানে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সংজ্ঞা নিয়ে কথা বলা যায়। আমার প্রশ্নগুলো সবকিছুকে মান্য করেই বলতে পারি। কারণ সংজ্ঞাও তো বদল হতে পারে। এটা সংবিধান নয়।
বালিশের পাশে তার একাত্তরের স্মৃতি
ওরকমই প্রশ্নের মুখে পড়েছি, ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বড়ধুশিয়া গ্রামের আব্দুল হালিমের বাড়িতে গিয়ে। আব্দুল হালিমও মাইন বিস্ফোরণে একটি পা হারান। তিনিও যুদ্ধকালে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে রণাঙ্গনে যেতেন। দুর্বিসহ জীবন তার। একাত্তর আমাদের বিজয় উপহার দিলেও আব্দুল হালিমের জীবনে একাত্তর ছায়ার মতো লেগে আছে। দুঃখ-কষ্ট তাকে ছাড়ছে না। বড়ধুশিয়াতে তার বাড়ি গিয়ে হতবাক হওয়ার মতো অবস্থা। বিশাল একেকটি ঘর ওই বাড়িতে। সেই বাড়ির এক পাশে ছোট একটি দোচালা ঘর। ঘরের পশ্চিমে দাঁড়িয়ে ঘরের দিকে তাকাতেই, বেড়া ভেদ করে দৃষ্টি চলে যায়, পূর্বের ফসলের মাঠে। লাঠি ভর করে তিনি যখন বেরিয়ে আসেন,তাকাই ঘরের ভিতর। মেঝেতেই বিছানাপাতা। আসবাবপত্র বলতে পিড়ি আর জলচৌকি। বিছনায় তেল চিটচিটে বালিশের পাশে কী একটা দেখা যায়। ওদিকে তাকাতেই তিনি আবার ঘরে ঢুকেন। টুকরো মতো একটা জিনিস নিয়ে আসেন আমার সামনে।
বলেন,একাত্তরের কথা। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গুলির বাক্স নিয়ে রণাঙ্গনে যেতেন নিয়মিত। অবশ্য বিনিময়ে কিছু পয়সা পেতেন।অনেক দুর্র্ধষ যুদ্ধের স্মৃতি আছে মনে। তো এভাবে দেশ যখন শত্রুমুক্ত হলো। তিনি অস্থির হয়ে গেলেন বাড়ি আসার জন্য। তার পালকপিতা বাধা দিলেন। মুক্তিযোদ্ধারাও বললেন, সীমান্তে প্রচুর মাইন পুঁতে রাখা আছে। রাস্তা পরিস্কার না হওয়া পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু তিনি আগে আগে দেশে আসতে চান। কারণ তার পালকপিতার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি সৈন্যরা।অবশিষ্ট টিন দিয়ে যদি একটা ছাপড়া না তোলা যায়, তাহলে বাড়ি গিয়ে থাকবেন কি করে। তিনি রওনা হলেন। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মন্দবাগ আসতেই মাইন বিস্ফোরণে তার পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দেহ থেকে।
তারপর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারকে সহযোগিতা করতে আসা ডাক্তার গাস্ট এর সহযোগিতায় কৃত্রিম পা লাগানো হয় তার। সেই কৃত্রিম পায়ের ভগ্নাংশটি তিনি রেখে দিয়েছেন বালিশের পাশে।
ভাবতে অসুবিধা হয় না, ওই ভাঙ্গা পা-টিই হলো আব্দুল হালিমের স্বাধীনতা। আর স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে গিয়ে এতটাই তিনি পেয়েছেন যা ভাবতেও অবাক লাগে। বিনা চিকিৎসায় তাঁর একটি মেয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। স্ত্রী হাঁপানিতে ভোগতে ভোগতে মৃত্যুর অপেক্ষা করছেন। মানুষের সাহায্যে চলে তাঁর জীবন।
আচ্ছা- সামরিক নিয়ম অনুযায়ী, সামরিক বাহিনীর গাড়িচালক,মালি,দাড়োয়ান সবাইতো সামরিক সুবিধা পায়। তাদের পরিচয় হয় সামরিক বাহিনীর লোক হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্র বহনকারী ব্যক্তিটিকে কি মুক্তিযোদ্ধার সুবিধা দেওয়া যায় না?
তারা কি মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেন না? এমন প্রশ্ন করলে একবাক্যে সবাই বলবেন, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেন না। মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে আমিও বলবো তারা মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেন না? কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যতিক্রমী এই জনযুদ্ধের সৈনিকদের কি গতানুগতিক সংজ্ঞায় ফেলা যায়?
বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পাওয়ার যোগ্য কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা নন
এবার যে ব্যক্তিটির কথা বলবো, তিনি শুধু মুক্তিযোদ্ধাই নন, আমি মনে করি বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে-তাঁর বীরত্বের কথা বোধ করি তাঁর এলাকার মানুষও ভুলে গেছে। নতুন প্রজন্ম তো জানেই না কী হয়েছিলো দেবিদ্বার থানার জাফরগঞ্জের পশ্চিমে রাস্তার পাড়ের ওই মসজিদঘিরে। আর তবদিল হোসেন নামের ওই স্কুটার চালকেরও বা কি ভূমিকা ছিলো সেই ব্যতিক্রমী সাধারণ মানুষ বনাম পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধে?
সংক্ষেপে সে কথাই বলি। ৩০ মার্চ ১৯৭১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি বাহিনীর কিছু সদস্য পিছু হটতে বাধ্য হয়। খুব ভোরে তারা মিরপুর নামক স্থানে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানীকে ডেকে উঠিয়ে চা খেতে বসে। এমন সময় মাধবপুরের জানু মিয়া চেয়ারম্যান তার এক সহযোগীসহ এসে পাকিস্তানি আর্মিকে লাঠিপেটা করে। সঙ্গে সঙ্গে পিস্তলের গুলিতে জানু মিয়া চেয়ারম্যান শহিদ হন। যার কবর সংরক্ষিত আছে মাধবপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশে রাস্তার ধারে।(অনেক তদবির করে জানু মিয়ার ছেলেরা বাবার নামটি মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করেছেন বলে শুনেছি।)
পাকিস্তানি সৈন্যরা ময়নামতি সেনানিবাস অভিমুখে এগিয়ে আসতে আসতে রাস্তায় অনেককে হত্যা করে এসেছে। এক পর্যায়ে তারা দেবিদ্বার থানাধীন ওই মসজিদে ঢুকে পড়ে। শুরু থেকেই হাজার হাজার মানুষ ওদের পিছু নেয়। মসজিদে ভিতরে ঢুকে যাওয়ার পর মসজিদকে ঘিরে মানুষের জটলা বাড়ে। সেখানেও তারা মসজিদের ভিতর থেকে বাইরে গুলি করে ওরা অনেককে হত্যা করে।
ওই সময় দেবিদ্বারের দিক থেকে একটা বেবি টেক্সি আসতে দেখা গেল মসজিদের দিকে। প্যাসেঞ্জার ছিল তার ভিতরে। মানুষের জটলায় পড়ে আর সেটি এগিয়ে যেতে পারছিল না। অন্যদিকে মানুষও তাদের বারণ করছে মসজিদের পাশে দিয়ে যেতে। ওই বেবি টেক্সির চালক গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়েন। রাস্তায় গাড়ি রেখে তিনিও মিশে যান জনতার কাতারে। বেবি টেক্সি চালক দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন কিছুক্ষণ। তারপর তিনি ঝাঁপ দিলেন পুকুরে। পুকুরের পূর্ব-উত্তর কোণে একটি পাকা ঘাট। মসজিদের মুসুল্লীরা এই ঘাট ব্যবহার করেন ওজু করার জন্য। মসজিদের উত্তরের দেওয়াল ঘেষে ছিল সরু একটি রাস্তা। রাস্তার উত্তর পাশে স্বল্প উচ্চতার একটি দেওয়াল। বড়জোড় আড়াই তিন ফুট হবে।
যাই হোক সেই ড্রাইভার সাঁতার কেটে ওই ঘাটে গিয়ে ওঠেন। মসজিদের পশ্চিমে ও উত্তর-পশ্চিমে থাকা মানুষের দৃষ্টি তখন তার দিকে। ঘাট থেকে তিনি মসজিদে যাওয়ার পথে চলে গেলেন দ্রুত। তারপর বসে পড়েন। বসে বসেই এগিয়ে যেতে থাকেন মসজিদের জানালা বরাবর। তখন মানুষ বুঝতে পারে, তিনি কী করতে যাচ্ছেন। তখনো মসজিদের ওই জানালা পথে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি রাইফেলের ব্যারেল বেরিয়ে আছে বেশ কিছুটা।
বেবি টেক্সি চালক ধীর গতিতে পা চালিয়ে জানালার কাছাকাছি চলে যান। একবারে কাছাকাছি গিয়ে কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকেন রাইফেলের ব্যারেলের দিকে। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে হেচকা টান দেন ব্যারেল ধরে। সৈনিকটি বুঝতেও পারেনি এত কাছে কেউ চলে আসবে। জানালার বাইরে ছিটকে পড়ে রাইফেলটি। রাইফেল নিয়ে তিনি দৌঁড় দেন পশ্চিমে ঘাটের দিকে। কি বুঝে তিনি রাইফেলটি ঢিল মেরে দেওয়ালের উত্তর দিকে রাস্তায় ফেলে দেন। রাস্তায় থাকা মানুষজন সেই রাইফেলটি সরিয়ে নেয় দ্রুত। এর মধ্যে একটা সৈন্য মসজিদের জানালা দিয়ে মুখ বের করে দেখে ফেলে। তার হাতে থাকা রাইফেল কিংবা পিস্তল দিয়ে গুলি করে চালককে লক্ষ্য করে। সেখানেই চালক ঢলে পড়েন। ওই জনযোদ্ধার নাম ছিল তবদিল হোসেন।
তিনি দেবপুর গ্রামের আলী আহমদ মুহূরীর গাড়ি ভাড়ায় চালাতেন।পরবর্তীতে তবদিল হোসেনকে তাঁর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এই লড়াইয়ে শহীদ হওয়া অন্যদের মতো তিনিও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি।
আমি যদি বলি বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পাওয়ার যোগ্যতা অর্জনকারী এই মুক্তিযোদ্ধা, তাহলে সংজ্ঞা অনুযায়ী অস্বীকার করতে পারেন। কিন্তু বিবেকের প্রশ্নের জবাব হবে-হ্যাঁ, তিনি বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পাওয়ার অধিকারী। অথচ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তই হননি। এমনকি তার কবরও চিহ্নিত নেই।
প্রাসঙ্গিকভাবেই তার যুদ্ধ বিশ্লেষণ করতে চাই। খেতাব পাওয়ার জন্য যেসব যোগ্যতা অর্জন করতে হয় তা হচ্ছে- যোদ্ধাকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে লড়াই করতে হবে। তাঁর আক্রমণে শত্রুপক্ষের ক্ষয়-ক্ষতি এবং শত্রুপক্ষের মনোবল ভাঙ্গার কারণ হতে হবে। তার আক্রমণ নিজ পক্ষের যোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি করতে হবে। নিজপক্ষের নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখতে হবে। এবং তার আত্যত্যাগও থাকতে হবে। এখানে দেখা যায়- তবদিল হোসেনের দেশপ্রেমের বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপনেরেই সুযোগ নেই। এবার আসুন শত্রুপক্ষের মধ্যে আতঙ্ক এবং তাদের ক্ষয়ক্ষতি কতটা হয়েছে। তিনি যখন শত্রুর অস্ত্র কেড়ে নেন,ভিতরে রাইফেল তাক করা সৈনিক আতঙ্কে এক দৌড়ে মসজিদের দক্ষিণাংশে চলে যায়। চিৎকার করে ওঠে। এই তথ্য আমাকে দিয়েছেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার কল্পবাস গ্রামের আমির খান। যিনি ওখানে উপস্থিত ছিলেন। পরের প্রসঙ্গ নিজ পক্ষের মনোবল বৃদ্ধি। এ নিয়ে কি কারো সন্দেহ থাকার কারণ আছে? তবদিল হোসেনের এই বীরত্বে হাজার হাজার মানুষ উল্লাস প্রকাশ করে জয় বাংলা ধ্বনি দিয়েছিলো। বলার অপেক্ষা রাখে না এই একটি ঘটনায় সাধারণ মানুষের প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকারী এই বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও স্বীকৃত নন।
লড়াই করে শহিদ তবে মুক্তিযোদ্ধা নন
কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্রের ঘটনা। মনোহরপুরের সিন্ধুভূষণ নাহা।একাত্তরের ২৬ মার্চ ভোরবেলা পাকিস্তানি মিলিটারির গাড়ির সামনে পড়লেন মিছিলসহ। ওরা মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দিলো। সিন্ধুভূষণ মারলেন ইট। তারপর নৃশংসভাবে তাকে খুন করে পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যরা। কারফিউর বিরতিতে বদরুল হুদা,ইন্দুভূষণ নাহা সিন্ধুভূষণ নাহার মরদেহ আনলেন বাড়িতে।কারফিউ শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। শ্মশানে যাবেন কি করে। সিদ্ধান্ত হলো ঘরের দরজার সামনে সমাধিস্ত করা হবে তাকে। কবর করলেন ঘরের সামনে। প্রতীকি মুখাগ্নী করে সমাধিস্ত করা হলো বীর এই যোদ্ধাকে। আজও ঘরের সামনে সেই কবর আছে। কুমিল্লা শহরবাসী অনেকেই জানতো না ১৯৯৬ সালে দৈনিক জনকণ্ঠে আমার প্রতিবেদন প্রকাশের আগে।
তথ্য সংগ্রহকালে জেনেছিলাম সিন্ধুভূষণ নাহার নাম শহিদের তালিকায়ও নেই, মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় থাক দূরের কথা।
বিখ্যাত ব্যাপারই-১
লেখা শুরু করেছিলাম, তথ্য সংগ্রহকালের অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো বলে, শেষ পর্যন্ত বিষয় এসে গেছে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার প্রসঙ্গে।সামান্য কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি।
কুমিল্লায় গিয়েছি যুদ্ধের প্রস্তুতির তথ্য সংগ্রহে। বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে। সময় দিলেন সন্ধ্যা ৬টায় তিনি কথা বলবেন। তাঁর রাজনৈতিক অফিসে সময়ের আগে গিয়ে হাজির হলাম। কতক্ষণের মধ্যে কামরা ভরে গেছে প্রায়। অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে তিনি তাদের অনেককেই ভালোবাসার প্রকাশ করছেন। প্রায় ঘন্টা পেরিয়ে যায়, তিনি গালিগালাজ করেই চলেছেন আগুন্তুকদের।ভাবসাব দেখে বুঝলাম এটাই তার স্টাইল। অতঃপর বললাম, আমাকে কি একটু সময় দেওয়া যাবে? জবাব পাওয়া গেলো- আমার সঙ্গে কথা বলতে হলে এক সপ্তাহ আগে এপয়েন্টমেন্ট করে আসতে হয়। ঠিকইতো আমিতো ৭দিন আগে এপয়েন্টমেন্ট নিইনি। খিস্তিখেউড় বন্ধ করে আমার সঙ্গে তিনি কথা বলেন কিভাবে?
ঢাকাগামী বাস বন্ধ হয়ে গেছে ততক্ষণে। বাধ্য হয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী বাস ধরার জন্য শহরথেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে হাইওয়েতে যেতে হলো আমাকে।
বিখ্যাত ব্যাপারই-২
কুমিল্লার আরেকজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদও একই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। বরং তিনি চড়কির মতো ঘুরিয়েছিলেন। তার কথা অনুযায়ী গিয়েছিলাম আদালতে। জন্মসূত্রে আমি কুমিল্লার হলেও আদালতে যাওয়া ওটাই ছিলো প্রথম। এই রুম ওই রুম ঘুরে জানতে পারলাম তিনি মাঝে মাঝে কোর্টে আসেন। ওইদিন আসেননি। ফোন করলাম, জবাব পেলাম- আমি একটু উপজেলায় আছি। আপনি সাড়ে ৪টায় জেলা পরিষদে আসেন। জেলা পরিষদে ৫টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফোন দিলাম। বললেন-সন্ধ্যার পর বাসায় আসেন। জিজ্ঞেস করলাম সন্ধ্যায় কি কোনো মিটিং আছে? তিনি বললেন- আছে একটা। বুঝলাম সম্ভাবনা ক্ষীণ। সুতরাং আমাকে ঢাকা রওনা হওয়াই ভালো। ফিরে এলাম আর প্রশ্ন করলাম নিজেকেই-মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহে কি কুমিল্লা যাওয়া আর ঠিক হবে?
সাহসী এক নারীর কথা
উল্টো চিত্র দেখেছিলাম কুমিল্লার বুড়িচং থানার কালিকাপুর এলাকায়। কুমিল্লা থেকে আখাউড়া পর্যন্ত সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর সংযোগ সড়কের কালিকাপুর থেকে পূর্বদিকে যেতে হবে আমাকে। আনন্দপুর নামক গ্রামে গিয়েছি তখন প্রায় বিকেল।
একাত্তরে একটি বাড়িতে থাকা ১০জনের মধ্যে একজনই জীবিত ছিলেন। একমাত্র মহিলা জোহরা বেগম পোড়ানো ভিটায় রাত কাটিয়েছিলেন। যিনি স্বামীর লাশ পাহারা দিয়েছিলেন রাতভর। অপেক্ষা করছিলেন বাড়ির পলাতক মানুষদের কেউ যদি আসে লাশ দাফনের জন্য। সেই মহিলার সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য যেতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, দুপুরের খাবার খেয়েছেন কোথাও। ‘খাইনি’ একথা শুনে তিনি চলে যান খাবারের ব্যবস্থা করতে। বললাম কষ্ট করবেন না। জবাব দিলেন- পুরুষশুন্য বাড়িটায় থাকাকালে মুক্তিযোদ্ধাকে খাইয়েছি পোড়া মরিচ দিয়ে। এখন এসেছেন- মাছ মাংস না দিতে পারি দুই চামচ ডালতো দিতে পারবো ভাতের সাথে। তাকিয়েছিলাম সাহসী ওই মহিলার দিকে। একাত্তরে দুটি গর্তে ৯ প্রিয়জনের লাশ মাটিচাপা দিয়েছিলেন নিজ হাতে। কাফন জানাজা হয়নি তাদের। পুকুর থেকে বালতিতে করে পানি এনে ঢেলে দিয়েছিলেন শেষ গোসলের নিয়ত করে। সেই মহিয়সী নারীর ভাবনা যেন যুদ্ধটাতো শেষ হয়নি। ৯০ এর কাছাকাছি বয়সের সেই মহিলার উদ্দম দেখে সঙ্গত কারণেই সাহস পেয়েছিলাম কাজ করতে।
ন্যাড়া বেলতলায়ও যায়
বড় একটা ধাক্কা খেতে হয় কুমিল্লার লাকসামের বেলতলী বধ্যভূমি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর। বৃহৎ এই বধ্যভূমিতে সর্বক্ষণ কাজ করেছেন শ্রীধাম দাস। নিজেও অনেক গর্ত তৈরি করেছেন মরদেহ মাটিচাপা দেওয়ার জন্য। তাঁর বক্তব্য ক্যাসেটবদ্ধ করি। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী বেলতলীতে ১০ হাজারের মতো মানুষকে খুন করা হয়েছে। প্রথম এটি প্রকাশ হয় জনকণ্ঠে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে। দ্বিতীয়বার ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা মাধ্যমে প্রকাশ হয় সব কটি জাতীয় দৈনিকে প্রথম লিড কিংবা দ্বিতীয় লিড হিসেবে। ইত্তেফাকে পরদিনই প্রতিবাদ হিসেবে ছাপা হয় একটি প্রতিবেদন। লেখা হয় আমি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির ক্রীড়নক। কারণ সেখানে শহীদের সংখ্যা অতিরঞ্জিত করে উল্লেখ করেছি আমি। প্রতিবাদকারী স্থানীয় সাংবাদিক আমাকে ইতিহাস বিকৃতকারী হিসেবে প্রকারান্তরে আমার বিচার হওয়া উচিৎ বলেও জানিয়ে দিলেন। শ্রীধামের দেওয়া বক্তব্য এবং এসবি জামানের বক্তব্য রেকর্ড করা থাকার পরও এহেন প্রতিবাদের প্রতিবাদ জানানো কর্তব্য মনে করে গিয়েছিলাম, বাসস এর তৎকালীন প্রধান, মুক্তিযোদ্ধা হারুণ হাবীবের কাছে। তিনি বললেন, আলোচনা হোক।তাঁর বক্তব্য- স্থানীয় সাংবাদিক বুঝতে পেরেছেন ১৯৭১ এর পর ১৯৯৯ এতদিনেও বেলতলী সম্পর্কে তাদের কোনো প্রতিবেদন না থাকাটা তার পেশাগত জীবনে ব্যর্থতার পরিচায়ক।
পরামর্শ দিলেন-এসবে কান দিতে নেই। নিজের কাজ করে যেতে থাকুন।সেই কাজই করে যাচ্ছি,যতদিন ক্ষমতা থাকে করতে থাকবো।
লেখক-সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।চাকরিসূত্রে গবেষণা সম্পাদক-সময় টেলিভিশন।প্রকাশিত গ্রন্থ-৭৫টি। তারমধ্যে ২২টি মুক্তিযুদ্ধের তথ্য ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক।স্বীকৃতি পেয়েছেন-অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার, এম নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার, চট্টগ্রাম একাডেমি প্রবর্তিত অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার ও ভারতের বর্ধমান থেকে ঐক্য পত্রিকা সন্মাননাসহ বিভিন্ন পুরস্কার। পৈত্রিক নিবাস, ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার চান্দলা গ্রামে।