ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
রবিবাসরীয়...............................................................................
Published : Sunday, 19 December, 2021 at 12:00 AM, Update: 19.12.2021 12:22:31 AM
রবিবাসরীয়...............................................................................

















অনুভূতি-সমন্ধীয় কুতর্ক



(নিঃসংকোচে পুস্তক পছন্দ কিংবা অপছন্দ করুন, কিন্তু সেখানেই থেমে যাবেন না।)

রবিবাসরীয়...............................................................................হাসিব উল ইসলাম ।।
লেখক এবং পাঠক দুই জন দুই প্রান্তে অবস্থান করেন। একজন লেখকের সাহিত্যকর্ম পুস্তক আকারে অনেক ঝক্কির ভেতর দিয়ে পাঠক পর্যন্ত পৌঁছায়।  পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত থেকে পাঠকের হাতে ধরা পুস্তক হতে একটা সাহিত্যকর্মকে প্রকাশক খুঁজে পেতে হয়,  ছাপা হতে হয়, ছাপা শেষ হলে বাঁধাই, তারপর পাইকারি বিক্রেতা হয়ে  বিভিন্ন পুস্তক বিপীণিতে ঘুরে এই যাত্রা শেষ হয় পুস্তক হিসেবে পাঠকের কাছে গিয়ে। তারপর পাঠক সাহিত্যকর্মটির স্বাদ গ্রহণ করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। কেউ চাইলে লেখকের অনুপ্রেরণা থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়াটির যেকোনো পর্যায় নিয়ে সমালোচনা করতে পারেন। কিন্তু খেয়াল খুশিমতো একজন পাঠক যখন তাঁর নিজস্ব আবেগ-অনুভূতি দিয়ে পুস্তকটির পর্যালোচনা করতে যায় তখন তাঁর বিশ্লেষণ বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভ্রান্তির দিকে নিয়ে যায়।

আমাদের অনুভূতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
একটি সাহিত্যকর্ম   লেখক কি  উদ্দেশ্যে রচনা করেছেন শুধুমাত্র তা দিয়ে বিশ্লেষণ করা যেমন  আপাতদৃষ্টিতে ঠিক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ভিত্তিহীন যুক্তি, পাঠকের  পাঠ পরবর্তী আবেগ অনুভূতি দিয়ে বিচার করাও ঠিক তেমন। পাঠকের আবেগ-অনুভূতির কথা উঠলে প্রসঙ্গক্রমে এরিস্টোটলের 'ক্যাথারসিস '  তত্ত্বের কথা চলে আসে। এরিস্টোটলের মতে, মহৎ ট্রাজেডির উচিৎ পাঠক/দর্শকের মনে 'ক্যাথারসিস '  সৃষ্টি করা। পোয়েটিক্সে এরিস্টোটল মাত্র একবারই 'ক্যাথারসিস ' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ক্যাথারসিস (ঈধঃযধৎংরং) শব্দটি সহজে অনুবাদ করা দুঃসাধ্য। এরিস্টোটল শব্দটি দিয়ে আসলে কি বোঝাতে চেয়েছিলেন তা নিয়েও বিতর্ক আছে। এক হিসেবে, শব্দটির অর্থ  'বিশোধন ' হতে পারে, অথবা 'পরিষ্কারক '। সহজ ভাষায় বললে, একটি উত্তম ট্রাজেডি আমাদের  আবেগ অনুভূতিকে নাড়া দিয়ে যাবে।
একটা সাহিত্যকর্ম আমাদের  আবেগ অনুভূতিকে কিভাবে  আলোড়িত করে তার ওপর জোর দিয়ে সেটাকে মূল্যায়ন করাকে  'অনুভূতি- সমন্ধীয় হেত্বাভাস ' বলা হয়। সহজ ভাষায়,  একটা পুস্তক পাঠের পর আমাদের ভেতরে যে  অনুভূতির সৃষ্টি হয়  তার প্রভাবের  ভিত্তিতে পুস্তকটিকে  পুরোপুরি মূল্যায়ন করা এক ধরনের ভ্রান্তি।  এই বিষয়টিকে আপাতদৃষ্টিতে সঠিক মনে হলেও কেন আসলেই  এটি একটি ভ্রান্ত যুক্তি তা একটা উদাহরণের সাহায্য দেখা যাক। এই ধরনের  বাক্যবিনিময়ের সাথে আপনারা নিশ্চয়ই কোন না কোন ভাবে পরিচিত :

ক : শীর্ষেন্দু  মুখোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক উপন্যাস বিষয়ে আপনি কি ভাবেন?
খ : আমার ভালো লাগে।

এখানে, উত্তরদাতা  কি উত্তর দিচ্ছেন, না কি প্রশ্নটিকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন? একটি পুস্তকের  সমালোচনা করার জন্য পুস্তকটি আমাদের ভালো লাগে না খারাপ লাগে তাতে কি কিছু আসে যায়? আমরা অবশ্যই সেই সমস্ত পুস্তক সম্পর্কেও অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ বা প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলতে পারি যেগুলো আমরা সানন্দে অপছন্দ করি। আবার আমরা অনেক বই পছন্দ করি যেগুলোতে আসলে তেমন চিন্তাভাবনার খোরাক থাকে না, পড়তে এমনি ভালো লাগে।

"আমার ভালো লাগে " এই মানদণ্ডটি বিরক্তিকরভাবে অসংস্কৃত পাঠককে এক ধরনের আত্মতুষ্টির দিকে ঠেলে দেয়। ই এম ফর্স্টার তাঁর 'আসপেক্টস অভ নভেল ' গ্রন্থে এই ধরনের হামবড়া পাঠকদের নিয়ে রসিকতা  করেছেন : "একটা উপন্যাস কি করে? কেন, অবশ্যই গল্প বলেৃ.আমি গল্প পছন্দ করি। আপনি আপনার শিল্প নিয়ে নিতে পারেন, সংগীত নিয়ে নিতে পারেন, কিন্তু আমাকে একটা ভালো গল্প দেন। আর আমি গল্পকে গল্প হতে পছন্দ করি, মনে রাখবেন, আমার স্ত্রীও কিন্তু গল্প পছন্দ করে। " ফর্স্টারের দুঃখ ধুর মিয়া, বাদ দেন, আমি জানি কি আমার ভাল্লাগে  কিসিমের পাঠকরাই প্রথাগতভাবে গল্প উপন্যাসের বাজারের বৃহৎ অংশ গঠন করে।

কিন্তু এটা কি নিঃসন্দেহে  কুতর্ক?
তবে সাধারণ পাঠকের পছন্দ অপছন্দকে একেবারেই ফেলে দেওয়া ঠিক না। আবার তাদেরকে অসংস্কৃত পাঠকও বলা যায় না। স্যামুয়েল জনসন এবং ভার্জিনিয়া উলফের মতও তেমন। আর পুস্তকের বাণিজ্যিক দিক আমলে নিলে আম পাঠকের পছন্দ অপছন্দ গুরুত্বপূর্ণ। পাঠকের যে পুস্তক পছন্দ, তাঁরা সেটা কেনেন, যেটা অপছন্দ সেটা কেনেন না। পাঠকের কেনার ওপর নির্ভর করেই 'বেস্ট সেলার ' বইয়ের তালিকা প্রস্তুত করা হয়। পাঠকের ভালো লাগে বলেই তাঁরা বই কেনেন এবং অসংখ্য বইয়ের বিক্রি হয়। (যেমন, বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদ রচিত উপন্যাস।) ফর্স্টারের মতে, তাঁরা 'অসংস্কৃত বা অযোগ্য পাঠক'; কেননা তাঁরা পুস্তক বিচার করেন তাঁদের ভালো লাগা খারাপ লাগা দিয়ে।
কোন ভূতের গল্প পড়ে আমরা যদি ভয়ই না পাই, কোন থ্রিলার পড়ে যদি উত্তেজনাই না আসে, অথবা কোন দুঃখের গল্প পড়ে যদি মন খারাপই না হয়, তবে এটা বলা যুক্তিযুক্ত যে আমাদের ঐ ভুতের গল্প, থ্রিলার, কিংবা দুঃখের গল্পটি ভালো লাগেনি। এই ধরনের জনপ্রিয় বইয়ের পাঠকের ওপর 'প্রভাব ' ই সবকিছু। এখন প্রশ্ন আসে, একটি পুস্তক মূল্যায়নের জন্য আমাদের  'শিক্ষিত/সংস্কৃত রুচি' কি খারাপ জিনিস? আমরা আসলে বইপুস্তক পুরোনো মদের মতো করে শুঁকে দেখে তারপর তার মূল্যমান যাচাই করি না। তবে এটা ধরে নেওয়া যায় যে, বই পড়ার একটা সংস্কৃত রুচির জন্য আবেগ অনুভূতিরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।   

পাঠকের প্রতিক্রিয়া
আধুনিক কালে সাহিত্যের অনুভূতি -সমন্ধীয় গুনের অননুমোদনকে আবেগ নিয়ন্ত্রণের সাথে সম্পর্কিত করা যেতে পারে। এবং বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেও দেখা হয়। ভিক্টোরিয়ান যুগের মানুষেরা অবশ্য ডিকেন্সের দি ওল্ড কিউরোসিটি শপ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র এতিম অসহায় নিষ্কলুষ লিটল নেলের মৃত্যুতে কেঁদে বুক ভাসাতো। আইরিশ রাজনীতিবিদ ড্যানিয়েল ও'কনেল এক ট্রেন ভ্রমণে দি ওল্ড কিউরোসিটি শপ এর শেষ কিস্তি পড়ে রাগে দুঃখে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলেছিলেন; তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে চিৎকার করে বলেছিলেন, নেলকে হত্যা করা ডিকেন্সের উচিৎ হয়নি।  জাহাজে করে যখন নিউ ইয়র্কে পত্রিকার নতুন কপি আনা হচ্ছিল ডক শ্রমিকেরা চেঁচিয়ে জানতে চেয়েছিল নেল মরে গেছে কিনা। ডিকেন্স লিটল নেলের মৃত্যুর বিবরণ দেন এভাবে :
'সকাল হওয়ার পরপরই সে মারা গেল শান্ত সুগভীর এক ঘুম ভেঙে অবশেষে সে তাঁর চোখ খুললো, সবাইকে অনুনয় করলো তারা যাতে আরো একবার তাকে চুমু দেয়।
তারপর,  একটা মনোরম হাসি মেখে সে বৃদ্ধ মানুষটির দিকে ফিরলো - এভাবেই, তাঁরা বলে, যেমনটা তাঁরা কখনো দেখেনি এবং যা কখনোই তাঁরা ভুলতে পারবে না, - দুবাহু দিয়ে সে বৃদ্ধ মানুষটার গলা ধরে ছিল। প্রথমে তারা বুঝতেই পারেনি যে নেল মারা গেছে।'
(নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস কোথাও কেউ নেই  অবলম্বনে নির্মিত নাটক দেখে বাংলাদেশের মানুষও এমন আলোড়িত হয়েছিল। নাটকের চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসি রুখতে মিছিল হয়েছিল সারা দেশে। অবশ্য ১৯৯৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর রাত আটটায় বিটিভির পর্দায় বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কার্যকর হয়।)
অনেকেই অস্কার ওয়াইল্ডের সাথে একমত হবেন যে, হাসতে না পারার জন্য একজনের খুব শক্ত মনের দরকার হয়। কিন্তু সেটাও, বিপরীতক্রমে, একটি 'আবেগ সমন্ধীয় প্রতিক্রিয়া '। হাসি, কান্না, শিউরে ওঠা, এবং সর্বোপরি 'পছন্দ করা ' হচ্ছে আমাদের অনুভবের বিষয়। নিরুত্তাপ যৌক্তিকতার স্বার্থে, আমাদের এইসব অনুভব নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ।  আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও সত্যবর্জিত নয় এমন একটা ঐতিহাসিক উদাহরণ দেখুন। ভিক্টোরীয় যুগের মানুষের আলোকচিত্রে দেখবেন তাঁরা কঠিনভাবে  মুখ বন্ধ করে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? কারণ, ভিক্টোরীয় যুগের দন্তচিকিৎসা। তাঁদের দাঁতের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। অস্কার ওয়াইল্ড তাঁর এবড়ো থেবড়ো দাঁত নিয়ে এতোই লজ্জিত ছিলেন যে হাসার সময় হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলতেন, বা হাসতে খুবই শরমিন্দা হতেন। বরং কান্নাকাটি করা ছিল সহজতর । ওয়াইল্ড এবং তাঁর সাথী ভিক্টোরিয়ানরা কোন লোকলজ্জা ছাড়াই কেঁদে বুক ভাসাতে পারতেন।
ডিকেন্স যখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে  তাঁর উপন্যাসের কোন চরিত্রের মৃত্যুর বর্ণনা, যেমন ন্যান্সির (অলিভারে টুইস্ট এর), অথবা নেলের, বা পলের, পড়ে শোনাতেন, তখন তাঁর হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ এতোই বেড়ে যেত যে ডাক্তারেরা তাঁর মৃত্যুর আশংকা করতেন। ডিকেন্সের জীবনকাল অবশ্যই এইসব অনুষ্ঠান করার জন্যই কমে গিয়েছিল। তিনি আলোড়িত হতেন - আমরা যখন তাঁর পুস্তক পড়ি তখন এইসব আবেগীয় প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিবাদ করা কি উচিৎ? আধুনিক কালের পাঠকদের এইসব বিখ্যাত মৃত্যুশয্যার দৃশ্যগুলোর বর্ণনা নিয়ে (যেমন ডিকেন্সের, বা থমাস হার্ডির জুড দ্য অবস্কিউর উপন্যাসের জুডের মৃত্যু, বা রবীন্দ্রনাথের 'ছুটি' গল্পের ফটিকের মৃত্যু) প্রতিক্রিয়া জিজ্ঞাসা করুন। অধিকাংশ আধুনিক পাঠক উত্তর দেবেন, এইসব 'অস্বস্তিকর '। এবং অপরিহার্যভাবেই এইসব আবেগীয় প্রতিক্রিয়া আমাদেরকে উত্তম পাঠক বানায় না।
[ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের লর্ড নর্থক্লিফ ইমেরিটাস প্রফেসর, লেখক, এবং কলামিস্ট জন এন্ড্রু সাদার্ল্যাণ্ডের লেখা অবলম্বনে।]
পরিচিতি: হাসিব উল ইসলাম ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। পড়ান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা সেনিবাসে। ]



 নষ্ট বাতাসকে বলেছি ভালোবাসতে

রবিবাসরীয়...............................................................................মো. আরিফুল হাসান ||

একটি অসভ্য বাতাসকে বলেছিলাম ভালোবাসতে। আর সে ভালোবাসাই আমার কাল হলো। দুপুরে, বসন্তের সুভাস গায়ে নিয়ে সে যখন আসলো আমি দরজা খুলে দিলাম। ও পাশে অন্ধকার ছিলো আমি তখন জানতাম না। তাই মধ্যাহ্নের বিপরীতে আমার ঘরভর্তি নিশুতিরাত নিয়ে আমার দিনযাপন।
খুব সখ করে তার নাম দিয়েছিলাম টুসি। ও বলতো, এটিতো মেয়েদের নাম। আমি বলতাম, থাক গে। আমার কোনো মেয়ে বন্ধু নেই। তুমিই আমার মেয়ে বন্ধু, তুমিই আমার ছেলে বন্ধু। টুসি আলতো করে আমার কানের নিচে টোকা দিতো। ঘাসে শুয়ে আমরা দেখতাম দুনিয়াটা সবুজ আর আমাদের প্রেমের মতোই প্রাণবন্ত।
আমাদের দুঃখের দিন শুরু হলো কোনো এক ভাদ্র মাসে। টুসি প্রাণপণে চাইতো আমাকে। আমি সবসময় টুসিকে প্রস্তুতি দিতে পারতাম না। মেঘের গুড়ুর মতো আমাদের প্রেমও ভাসতে লাগলো নীলমাখা আকাশের বুকে। তখন আমরা বুঝতে পারলাম, আমাদের আসলে একত্রে থাকা সম্ভব নয়। কারন টুসির ছিলো অন্য মেয়েতে আসক্তি আর আমার ছিলো সংসারের বাঁধন। দিনমান কাজ করে যখন সন্ধ্যায় টুসির ফেরার জন্য অপেক্ষা করতাম তখন নিজের ভেতর কতকিছু প্রশ্ন জন্মাতো। আচ্ছা, আমি কেনো এভাবে পথ চেয়ে থাকবো? টুসি কি এ পথে আছে? সে গেছে অন্য পথে, পথে পথান্তরে।
তবু আমাদের সংসার চলতে লাগলো। যেহেতু আমাদের বিয়েটা নিজেদের সিদ্ধান্তেই হয়েছিলো তাই পরিবারের কাছে ফিরে যেতে উভয়েরই ছিলো লজ্জা। তবু লজ্জার বেড়িবাধ ভেঙে আমাদের এগুতে হলো। টুসি এক সন্ধ্যায় জানালো সে বিয়ে করতে যাচ্ছে। আমি হা, না কিছুই বলিনি। তারপর আবার রাতের বেলায় একবিছানায় শোয়ার সময় টুসি বললো, তুমি যে কিছু বললে না? আমি তখনও চুপ করে আছি। টুসি বললো, চুপ করে থাকলে তো হবে না; কিছু একটা বলতে হবে। এখানে তোমারও সম্মতির দরকার আছে। যেহেতু আমি তোমাকে রেখেই দ্বিতীয় বৌ ঘরে আনছি। আমার কানের নিচে গরম বাতাস শোঁশোঁ শব্দে বয়ে গেলো। টুসিকে জাপটে ধরে দুই হাতে কিল ঘুষি দিতে থাকলাম। আশ্চর্য, টুসি একটুও রাগ করলো না। সে একপাশে নেতিয়ে শুয়ে পড়লে আমি তাকে জাপটে ধরে কাঁদতে লাগলাম।
সে রাতে প্রেম ভালোবাসা আমাদের কাছে ফিরে এলো। আশ্বিনের কাশফুল শুভ্রতায় আমরা পরস্পরকে ছুঁয়ে দিলাম গভীর অনুভবে। সকাল বেলায় টুসিকে দেখা গেলো অন্য চরিত্রে। ঘুম থেকে উঠেই দেখি আমার জন্য চা রেডি করে পায়ের কাছে বসে আছে। মুখভরা হাসির ঊষা। টুসি আমার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে গেলো। বাইরে ভোরের আলোয় কয়েকটা চড়ুই খেলা করছে। টুসি বললো, একজীবনের যতো অপরাধ, ক্ষমা করো।
কিন্তু টুসি তো টুসি, সে আবার বদলে যাবে কেমন করে! যে মেয়েটির প্রেমে সে পড়েছিলো, আবার সে ফিরে যেতে থাকলো তার কাছে। বিষন্ন সন্ধ্যায় আমি আবার টুসির পথ চেয়ে বসে থাকি। টুসি ওদিকে প্রিয়ংবদার আঁচলের তলে হয়তো ফিক করে হাসছে। আমার মুখ থেকে হাসি সরে যাচ্ছে চিরতরে। রাত দশটার পর টুসি বাসায় ফিরতো। তার চেহারার দিকে তাকানো যেতো না। এলোমেলো বিদ্ধস্ত ভাঙা দেহ। ফ্রেস হয়ে এসেই বলতো খেতে দাও। খেয়ে দেয়ে ঘুমের পিল খেয়ে ঘুম দিতো। লম্বা ঘুমের পর সকালে অফিসে চলে যেতো না বলে। আমি দরজার কবাট ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম আর ভাবতাম, কি এমন ক্ষতি হতো একটি বার বলে গেলে?
ক্ষতি যাই হতো, এভাবে আর ক্ষতটা বাড়ানোর ইচ্ছে আমার ছিলো না। লজ্জার মাথা খেয়ে একদিন বাড়িতে ফোন দিলাম। বাড়ির কথাবার্তা আমার ভালো লাগলো না। তবু মা বললেন, যদি টিকতে না পারিস, চলে আসিস। আমরা এখনো মরে তো যাইনি। তোর কি হবে তা নিয়ে আমরা আবারও ভাববো। তুই নির্ভয়ে চলে আয়।
কিন্তু আমি গেলাম না। মায়ের টিকতে না পারিস কথাটা খুব মনের মধ্যে গাঁথলো। পণ করলাম, যতক্ষণ সহ্যশক্তির সীমা আছে ততক্ষণ সইবো। কিন্তু আর কতক্ষণ? দিনদিন টুসির লাম্পট্য বাড়তেই লাগলো। ইদানিং সে আমার সামনেই সে মেয়ের সাথে কথা বলে। ভিডিও কলে নানা অশ্লিল অঙ্গভঙ্গি করে। আমি নিজেকে পোড়াতে পোড়াতে একসময় ঘুম অথবা দহনের ভেতর হারিয়ে যেতাম। সকালে উঠে শুনতাম টুসি চিল্লাফাল্লা করছে। এতো বেলা হলো। জমিদার কোথাকার। কখন অফিস যাবো? আমি তড়িঘড়ি করে উঠে চুলোয় নাস্তা বসাতাম। একা একা খেয়ে টুসি বেরিয়ে যেতো। আমি প্রায় দিনই নাস্তা করতাম না। এতে করে আমার চেহারা ভেঙ্গে যেতে লাগলো। পরে নিজেকে বুঝালাম, না, এভাবে নয়। নিজেকে কষ্ট দিয়ে নয়। বরং নিজেকে গড়ে তুলে প্রমাণ করবো জীবনে আমিও টিকতে পারি।
ছাব্বিশ তারিখ সকালে আমরা ডিভোর্স নিলাম, তখন ছিলো ফেব্রুয়ারি মাস। সম্পূর্ণ দু’জনের সম্মতিতেই কাজটা সমাধা হলো।। টুসি এ ব্যাপারে বেশ আন্তরিক ছিলো। তাই আমাকে আর বেশি দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে হয়নি। সকাল বেলা কাজী অফিস থেকে ফিরে জামাকাপড় নিয়ে চলে এলাম নতুন একটি মেসে। এখানে কাছে-কোথাও একটা কিন্ডারগার্টেনে চাকরি পেয়েছি। যা বেতন পাবো তার সাথে দুটো-একটি টিউশনি করাতে পারলে সুন্দর চলে যাবে।
কিন্তু এ সুন্দর আমার শুধু সুন্দরে সীমাবদ্ধ থাকলো না। বছর ঘুরতেই আমার কলেজে চাকরি হয়ে গেলো। ফিজিক্সের ক্লাসে পড়াই। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে কেনো যেনো টুসির কথা মনে হয়। আসলে খুব মায়া পড়ে গেছে তার জন্য। সে কী খাচ্ছে, কখন বাসায় ফিরছে, ঠিকমতো ঘুমোচ্ছে কিনা এসব ক্ষণে ক্ষণে ভেসে উঠে মনে। আচ্ছা, তারও কি আমার কথা মনে পড়ে?
এসব ভাবতে ভাবতে দিন ফুরায়। আমার পরিবার আমার জন্য আবার বিয়ে দেখতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। শর্ট ডিভোর্স, কোনো সমস্যা নেই। মেয়ের যেহেতু চাকরি আছে ভালো ফ্যামিলি থেকেই ছেলেরা আসতে থাকে। আমার কেনো যেনো দেরি হয়ে যায়। ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।
এর মধ্যে একদিন খবর পেলাম টুসি হাসপাতালে। সড়ক দুর্ঘটনায় ভয়াবহরকম আহত হয়েছে।
যাবো কি যাবো না? যাবো না, নাকি যাবো, এসব ভাবতে ভাবতে আমি হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দিলাম। রিক্সায় উঠেও মনে হচ্ছিলো আমি আসলে যাবো না। হয়তো হাসপাতালের গেটের কাছ থেকে ফিরে আসবো। কিন্তু আমি গেলাম। একেবারে হাসপাতালের ভেতরে গেলাম। আইসিইউ বেডে থাকার কারনে কাছ থেকে তাকে দেখতে পারলাম না সত্য। কিন্তু তাকে দেখার বাসনা আমার মনে তীব্রতর হলো। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম। ডাক্তাররা আসছে, চলে যাচ্ছে। কেউ কিছু উত্তর দিতে পারছে না। রুগির অবস্থা সংকটাপন্ন।
রাত দুইটার দিকে টুসির বাবা আমার হাত ধরে কেঁদে দিলেন। তোমার সঙ্গে এমন আচরণ করাতেই আজ ওর এ অবস্থা হয়েছে মা। তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও। আমি কী উত্তর দিবো বুঝতে পারছিলাম না। টুসির বাবার হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এমন সময় একজন ডাক্তার এসে বললো, মিলি কে? মিলি? আমি আঁঁৎকে উঠলাম। ডাক্তার বললো, রুগির জ্ঞান ফিরেছে। জ্ঞান ফেরার পর থেকে শুধু মিলিকে ডাকছে। টুসির বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, যাও মা। তোমার টুসিকে তুমি বাঁচাও। আমি অবিশ্বাস্য দ্বিধাগ্রস্ততায় আইসিইউর ভেতর পা রাখলাম। মনে পড়লো, বহুবছর আগে এক নষ্ট বাতাসকে বলেছিলাম ভালোবাসতে।


মো. আরিফুল হাসান
কুমিল্লা, বাংলাদেশ
০১৭৬৩৭১৩৫৪৮


 

শরমের কথা


আবেদীন মাওলা ||

প্রেমের কবিতা গল্প লিখো তুমি বেশ ভালো
ভক্তি নিয়ো সঙ্গে ভালোবাসা আর আর সব
ভুল হলে ক্ষমা করো ইতি তোমার প্রিয় গর্ধব

ইউসুফকে বলেছি তোমার কথা বিস্তারিয়া বিস্তর
জোলেখা শুনেছে হেসেছে ডাগরে চার আনা
আমিই কি বুঝি বলো এসব কুটক কৃষি গবেষণা

ওরা অমৌসুমি কাঁঠাল ভাঙে তস্তরিতে
সুবাস বিস্তারে কোষ, আহা বেশ রস
গন্ধ নিতে নিতে আমি গাধা হলাম অবশ

 জোলেখা হাত দেখায় হাতে লেগে থাকা আঠা
বলে দৃষ্টি প্রসারিত করো মিয়া ভালোভাবে দেখো
কানে কানে বলে তুমি নাকি আঠার বিত্তান্তই লেখো



শুরুতেই থেমে আছি
    - জাফরিন সুলতানা ||

যেখান থেকে শুরু করেছিলাম
আজ আবার সেখানেই এসে থেমেছি
পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি এক বিন্দু নড়িনি
মনে হলো মাসের পর মাস অনেক খেটেছি
তাও এক পা নড়িনি।

নিজের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি না
কেন, কোথায়,  কার জন্য আছি?

নিজেকে ভালোবাসি