ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
বিদ্রেহী কবিতার একশ বছর    অদ্বৈতবাদী কাজী নজরুল ইসলাম ও  তাঁর বিদ্রোহী সত্তা
Published : Sunday, 16 January, 2022 at 12:00 AM
বিদ্রেহী কবিতার একশ বছর    অদ্বৈতবাদী কাজী নজরুল ইসলাম ও  তাঁর বিদ্রোহী সত্তাআনোয়ারুল হক ।।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ভারত যুদ্ধে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা দুই দিকের রেডিওতে বেজে যুদ্ধবাজ সৈন্যদের উদ্দীপনা যুগিয়েছে সে আমি নিজেই শুনেছি। সেই সময় কুমিল্লা জিলা স্কুলে আমার পাঠ্য তালিকায় পেয়েছি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ‘সংকল্প’। কবিতার প্রথম পংক্তি, ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগতটাকে, কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণীপাকে-‘ জগত দেখার প্রেরণা নিয়ে বড় হতে হতে ১৯৬৯ সালে এসএসসি পাশ করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের উচ্চ-মাধ্যমিকে ভর্তি হই। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পর একদিন সকালে সেকশনের অডিটোরিয়ামের মঞ্চে মুখোমুখি দেখা পেয়ে গেলাম ‘বিদ্রোহী’ কবি নজরুলকে। সেদিন ছিল সদ্য-নির্বাচিত ছাত্র-সংসদের বাজেট মিটিং। বিজয়ী এবং বিজিতসহ সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মতো আমিও উপস্থিত। কোন একটা বিষয় নিয়ে মতানৈক্যের ফলে খুব হৈ চৈ হচ্ছে। কেউ কারো কথা শুনছে না। হল্লা থামছে না। ফলে কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যাচ্ছে না। অধ্যক্ষ সিরাজুল ইসলাম স্যার উপায়ন্তর না দেখে বদরুল হাসানকে ইংগিত করলেন ছাত্রদের শান্ত করতে উদ্যোগী হওয়ার জন্য। বাংলা বিভাগের কৃতি এবং সকলের মান্য শিক্ষক প্রখ্যাত আবৃত্তিকার বদরুল হাসান মঞ্চে মাইকের সামনে গিয়ে যখন নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ আবৃত্তি শুরু করলেন, মুহূর্তেই আমি যেন দেখলাম, স্বয়ং নজরুল আমার দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে। দিব্যকান্তি প্রবল পুরুষ যৌবনের কাজী নজরুল ইসলাম, যাকে আমি দ্বিতীয়বার সেদিন ধারণ করছি, এবং চিরজনমের মতো। যৌবনের এই দ্রোহী চেতনার নজরুলই সেই সময় ছিল প্রত্যেক তারুণ্যের স্বপ্ন এবং উদ্দীপনা, কেননা সাল ছিল ১৯৬৯-১৯৭০, সামনে ১৯৭১- যে সময় ছিল তরল উত্তপ্ত আগুনের মহাকাল। জ্বালাবার, স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে জ্বলে ওঠবার।  
স্বয়ং কাজী নজরুল যেনো সেদিন বিপুল উদ্যমে তারুণ্য ভরা  লাবণ্যে বাবরি দুলিয়ে বদরুল হাসান স্যারের কণ্ঠে নিজের কবিতা আমাদের অঙ্গ-ভঙ্গি করে শোনালো। পিন পতন নিঃশব্দতার মধ্যে হল ভর্তি ছাত্র-ছাত্রিদের সামনে নৃত্যরত নটরাজের শক্তি-মদ-মত্ততায় স্বর্গ মর্ত্য পাতাল দুলছে। আমি, আমরা বিহ্বল, বিমোহিত। তখনও কবিতার সব শব্দের অর্থ আমি জানি না, বুঝি না। কিন্তু প্রাণ তো আছে, যে প্রাণ ছন্দের দোলায় দোলে, উদ্দীপিত হয়। শক্তিতে শক্তি পায়। আমাদের কারো মুখে কোন শব্দ নেই, কিন্তু ভিতরে ভিতরে জ্বলে ওঠছে এক একেকটি প্রদীপ। যে প্রদীপের প্রাণ-স্পন্দনকে নজরুল জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন তাঁর সমকালে এবং আজও জ্বলে ওঠে সময়ে সময়ে।    
তৃতীয়বার নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আবার উদ্দীপনার তর্জনী তুলে সামনে এসে দাঁড়ালেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়। ওপারে ট্রেনিং ক্যাম্প ‘মেলাঘরে’র যুদ্ধ জীবনে। পুরো একাত্তর জুড়ে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’, ‘শিকল পরার গান’, ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’, ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ আমাদের জাগিয়ে রেখেছে। কোন কোন রাতে গভীর অন্ধকার অনিশ্চিত পাহাড়ি রাতে, একটা চিহ্নিত তাঁবুতে এক ব্যাণ্ডের রেডিও বাজলে আমরা সেখানে জড় হতাম। কোন কোনদিন ‘স্বাধীন বাংলা বেতারে’ এই বদরুল হাসান স্যারের কণ্ঠেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আবৃত্তি শুনে আমাদের চিত্ত চাঞ্চল্য ধরে রাখতে পারতাম না। কোন নাম না জানা মুক্তিযোদ্ধা তরুণকে এমনও দেখেছি, আবৃত্তি শুনতে শুনতে ‘জয়বাংলা’ বলে দুই হাত শূন্যে তুলে লাফিয়ে উঠতে। তারপর হু হু করে সে কী কান্না। সেই ছেলেই থ্রি-নট থ্রি রাইফেলটা উঁচিয়ে ধরে তারপরদিন সকালে হুডতোলা ট্রাকে চড়ে চলে গেছে আত্মবিসর্জনের, রক্তদানের সীমান্তে।
এই যে উদ্দীপনার চিত্র, তা আছে আবদুল মান্নান সৈয়দের ভাষ্যে, বলেছেন,
১৯৬৫ সালে দেখলাম মুখোমুখি দুই যুধ্যমান দেশ ব্যবহার করে চলেছে একজন কবির কবিতা। ১৯৭১ সালেদেখলাম, যাঁকে বলা হত ঃড়ঢ়রপধষ ঢ়ড়বঃ, সমকালীন হৈ-চৈয়ের কবি, তাঁর নীরব হয়ে যাবার তিরিশ বছর পরে একটি রাষ্ট্রের জন্মে তাঁর উদ্দীপক-সন্দীপক কবিতা-গান-গদ্যরচনা সমূহের দীপ্ত ভূমিকা। প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশ এই দুই বিরোধী আদর্শের রাষ্ট্রে তিনি সম্মানিত হলেন শুধু বাংলা ভাষার কবি বলে নন, এজন্যে, যে, তাঁর রচনাতেই পাওয়া যাচ্ছে দুই বিরোধী আদর্শের উজ্জ্বল উপকরণ। মনে হচ্ছে, এই কবি দশআয়তবান, যার এক একটি আয়তন নিয়ে একএকটি ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী মুগ্ধ থাকতে পারে। ( সৈয়দ : ২০১৫ : ২০৫)
স্মর্তব্য যে, বহুমাত্রিক দর্শন, চিন্তা-চেতনা ও অগ্রসর দিনের ভাবনা যে লেখকের সৃষ্টিতে পাওয়া যায় সেই কবির পক্ষেই দশআয়তবান হওয়া সম্ভব। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তাই। ছিলেন তাঁর সময়ের চেয়ে এগিয়ে, প্রচলিত সমাজ ‘ভাঙার গান’ গেয়ে ‘অগ্নি-বীণা’ ‘বিষের বাঁশি’ বাজাবার জন্য তিনি যুগের প্রয়োজনে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ‘যা আছে তার সব ঠিক আছে’-এই প্রচলিত ধারণায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। ছিলেন সময়ের সাথে তাল রেখে পরিবর্তনকামী। নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া চিরকালের আধুনিক চেতনার চলমান মানুষ।যাঁর সৃজন সর্বযুগের সর্বকালের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে যায়। ফলে একশত বছরে ‘বিদ্রোহী’র আবেদন শেষ হয়ে গেলো না। যায় না।
আর বাস্তবতাই আমাদের নির্দেশ করে, যাবেই বা কী করে! ১৯২০ সালের ভারতবর্ষের  ভূগোলের সীমানা বদলে গত একশত বছরে একটি দেশ তিন টুকরো হয়ে বর্তমানে তিনটি দেশ হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রশক্তি পুঁজিবাদী শাসক ও শোষকের চরিত্র বদলায়নি। পরিবর্তন হয়নি মুক্তচিন্তার কণ্ঠরোধের রাষ্ট্র ও সামাজিক নিপীড়ণ নির্যাতনের বহুমুখী চিত্রটি। রাজনীতিবিদ থেকে আরম্ভ করে বুদ্ধিজীবীদের (নজরুলের ‘বিদ্রোহী বাণী’ কবিতা)১ তোষামোদী মেরুদণ্ডহীন চরিত্র সেকালে যেমন ছিল স্বার্থপর ও ভিক্ষুকের. আজও তেমনি আছে।
কিন্তু কথা তো ছিল মুক্তির। যে মুক্তি স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও আসেনি সেই মুক্তির মিছিলে বারবার নজরুলের ডাক পড়ে। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ সত্তার অকুতোভয় বাণী তাই নিয়ত আমাদের জীবন-যুদ্ধের মিছিলের অগ্রভাগে এসে দাঁড়ায়। সেকালে যেমন ‘ক্ষুদিরামে’র মতো বিপ্লবীদের মূলমন্ত্র হয়েছে, একালেও তেমনি ‘নূর হোসেন’দের মতো তারুণ্যকে আত্মবিসর্জনে প্রাণিত করেছে। কোন হেরফের নেই। যেজন্যে মনে করি, আগামী দিনেও শুধু এদেশে নয়, সারাবিশ্বের নিপীড়িত নির্যাতীত সমাজে ও রাষ্ট্রে নজরুলের প্রতিবাদী চেতনা জেগে থাকবে। শোষক ও শাসকের অপশাসন, পুঁজিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নজরুল চেতনা রাজপথে সোচ্চার থাকবে। কেননা বলেছি, অবস্থার তো কোন পরিবর্তন হয়নি। যে পরিবর্তনের জন্য পৃথিবীতে কালের প্রত্যাশায় যুগাবতারের জন্ম হয়। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের কোন এক রাতের শেষ প্রহরে আলোকিত সময় নেমে এলো পৃথিবীতে। যুগের বার্তাবাহক, কাজী নজরুল ইসলাম ‘দিব্যজ্ঞান’ প্রাপ্ত হলেন নির্যাতীত-নিপীড়িত মানবতার প্রার্থনায়। জন্ম হলো অনমনীয় কবিতা ‘বিদ্রোহী’ ও কবি, চিরকালের।
আমাদের জানা আছে, এই পৃথিবীতে যাঁরা মহাপুরুষ, মানুষের মঙ্গলের এবং কল্যাণের জন্য এসেছেন তাঁদের কাছে দিব্যজ্ঞান এসেছে, আলোকপ্রাপ্ত হয়েছেন তাঁরা এভাবেই-হঠাৎ একরাতে, গভীর নিশীথে, ঊষালগ্নে। যাকে বলা হয়, সুবহে-সাদেক। সেই সময়েই ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ হয়েছে তাঁদের। প্রচণ্ড ঘোরের মধ্য দিয়ে। স্বতঃস্ফূর্ত অনুভবে। নজরুল ইসলামও তেমনি এক আত্মনিমগ্ন অবস্থার ভিতর দিয়ে ১৪১ পংক্তির কালজয়ী কবিতাটি টুকরো টুকরো কাগজে পেন্সিল দিয়ে লিখে গেছেন, যাতে ১৪১ বার ‘আমি’ শব্দটি ভিন্ন ভিন্ন অর্থ সম্বলিত তাৎপর্যে উপস্থাপিত হয়েছে।
পরদিন সকালে যে কবিতা অচিরেই কালজয়ী হবে, প্রত্যাশী তারুণ্যের বারুদ-অন্তর জয় করে নেবে সেটির প্রথম শ্রোতা ছিলেন কবি নজরুলের অন্তরঙ্গ বন্ধু, ভারতীয় কম্যুনিষ্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজফফর আহমদ, যিনি তাঁর পাশের কক্ষেই অবস্থান করতেন। ২২ পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ, ৬ জানুয়ারি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার ‘বিজলি’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রথম ছাপা হয়। যদিও ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার সম্পাদক প্রথম ছাপাবার জন্য কবিতাটি নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কোন কারণে পত্রিকাটি প্রকাশ পেতে দেরি হওয়ায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রথম ছাপাবার কৃতিত্ব ‘বিজলি’ পত্রিকার ভাগ্যে জুটে যায়। তারপর যা ঘটেছে তার একমাত্র উদাহরণ একমাত্র ‘বিদ্রোহী’ কবিতাই। যে ভাগ্য সারা বিশ্বে আর কোন কবি কিংবা কারো কোন রচনার আজও হয়নি। এমনকি রবীন্দ্রনাথেরও।

সময়ের, সর্বকালের সেরা কবিতা ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের সাথে সাথে কলকাতার স্বারসত সমাজে আমরা জানি, এমন বিপুল সাড়া পড়ে গিয়েছিল যে, ‘বিজলি’ পত্রিকাটি সেই সপ্তাহে দু’বার ছাপা হয়েছিল আর কপির সংখ্যা ছিল, উনত্রিশ হাজার এবং দেড় থেকে দু’লক্ষ পাঠক কবিতাটি পাঠ করেছিল। তারপর একে একে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ছাপা হয়েছিল সেকালের প্রায় সবগুলো চালু পত্রিকা- ‘মোসলেম ভারত’, ‘প্রবাসী’, ‘সাধনা’ ও ‘ধূমকেতু’ ইত্যাদিতে। বলে রাখি, ‘ধূমকেতু’ ছিল নজরুল সম্পাদিত অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা। এবং এই পত্রিকাটিরও গুণ-মান,বিষয়ের জন্য জনপ্রিয়তা ছিল অবিশ্বাস্য। বস্তুত, ‘বিদ্রোহী’ কবিতার তাৎপর্য বিবেচনা করে বাঙালি পাঠক সমাজ সঙ্গত কারণেই নজরুলের কপালে সাথে সাথেই ‘সৌভাগ্যের ফোটা’ এঁটে দেয় ‘বিদ্রোহী কবি’। অবশ্য ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় দুই হাতের এক হাতে বাঁকা ‘বাঁশের বাঁশরি’ বলার কারণে তাঁকে ‘প্রেমের কবি’ও বলা হয়ে থাকে। আমরা বিশ্বাস করি, হৃদয় নিভৃতে মানবতাবাদী চৈতন্য-স্বরূপে অন্তরঙ্গ প্রেমিক না হলে ‘বিদ্রোহী’ হওয়া কখনো সম্ভব নয়। সকলের জানা আছে, কবি নজরুলের প্রিয় ছিলেন ফারসি কবি হাফিজ, ওমর খৈয়াম, উর্দু কবি গালিব, এঁরা সকলেই তাঁদের সময়ে ছিলেন দ্রোহী চেতনারই প্রেমের কবি।
প্রকৃতপক্ষে, নজরুলকে সনাক্ত করতে পেরেছিলেন তাঁর অগ্রজ কবি, গুরুদেব (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নজরুল ‘গুরুদেব’ বলে সম্বোধন করতেন, আর ‘প্রস্তুতির সাজঘর’ করাচি সেনা-ছাউনিতে থাকাকালীন সময়ে ‘গীতাঞ্জলি’র সমস্ত গান নজরুলের মুখস্ত ছিল। যে কারণে মুজফফর আহমদ তাঁর ‘স্মৃতিকথা’য় তাঁকে রবীন্দ্র সংগীতের ‘হাফেজ’ বলে উল্লেখ করেছেন)৩ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর ইংরেজ রাজশক্তি। সেই সময়ের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এবং চর্চিত উন্নাসিক আধুনিক কবিদের অসূয়া দৃষ্টিভঙ্গিকে পাত্তা না দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলের প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তাঁর ‘বসন্ত’ নাটিকা উৎসর্গ করে ‘কবি’ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল। আর ১৯২৯ সালে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে সংবর্ধনা সভায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু মন্তব্য করেছিলেন, নজরুল যে স্বপ্ন দেখে সেটা সমগ্র বাঙালি জাতির স্বপ্ন৪। আমরাও বলি, নজরুলের সমকালে কবি তো ছিলেন অনেকেই কিন্তু সমগ্র বাঙালি জাতির স্বপ্নের প্রতিফলন বা দেখা পাওয়া গিয়েছিল নজরুলের দ্রোহে, ‘বিদ্রোহী’র নান্দনিক উচ্চারণে। ১৯২১-১৯২২ এর অগ্নিযুগের অগ্নিদীক্ষার, উদ্দীপনার বাণী ‘বিদ্রোহী’তে ছিল বলেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নবীন কবিকে অভিনন্দন জানিয়ে নিন্দুকদের মুখে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন৫। ‘কল্লোল’ যুগের ত্রয়ী প্রতিভা বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, নজরুলের অগ্রজ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, প্রবোধচন্দ্র সেন, বিনয় সরকার প্রমুখ কবি, সাহিত্যিক এবং ‘সওগাত’, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’, ‘মোসলেম ভারত’, ‘নারায়ণ, ‘ভারতী’, ‘বিজলী’, ‘বাসন্তী’, ‘প্রবাসী’, বঙ্গবাণী’ ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় নজরুলের কাব্য-প্রতিভায় সপ্রশংস আলোচনা নিয়মিত প্রকাশ পেয়েছে। তবে  দিনে দিনে অভিনন্দিত আবেগে ভাটা পড়েছে। তবে সবচেয়ে প্রবল বৈরী রাজশক্তি ইংরেজ শাসক প্রথম সুযোগেই ‘বিদ্রোহী’ কবিকে কারাবন্দী করে জেল, জুলুম, নির্যাতন করে কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে। যদিও সফল হয়নি।
সফল হয়নি নজরুলের স্বপক্ষ মুসলিম গোঁড়া ধর্মান্ধ সমাজ, ব্যর্থ হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদী উন্নাসিক বন্ধু লেখক সমাজ প্রতিনিধি ‘শনিবারের চিঠি’, ‘প্রবাসী’ এরা নজরুলের বিরুদ্ধাচারণ করে তাঁকে দমিয়ে রাখতে। তুচ্ছতার সঙ্গে সকল অপশক্তিকে ডিঙিয়ে গেছেন নজরুল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা, তার পরিপূরক ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা৬ প্রকাশের পর স্বাধীনতার দাবীতে যে গণজাগরণ শুরু হলো সেই চেতনায় আগুন উসকে দিলেন নজরুল, তাতে কায়েমী স্বার্থ ‘অশনি সংকেত’ দেখতে পেলো। যার ফলে চতুর্মুখী নজরুল বিরোধীতা যেনো প্রত্যশিতই ছিলো। কেননা, পৃথিবীতে যত বিপ্লব, যত স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে তাতে শোষক রাষ্ট্র, ধর্মান্ধ সমাজ এবং তাদের দোসর (২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ স্মর্তব্য) যারা, তারা বরাবরই নৃশংস কায়দায় কবি, শিল্পী, সচেতন বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিত্বকে হীনমন্য আঘাতে প্রাণ সংহার করতে দ্বিধা করেনি।
ফলে, বৃটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহের বাণী প্রচার’, ‘অনুপ্রেরণা দান’, ‘দেশদ্রোহাত্মক মনোভাব প্রকাশ’, ‘ভাঙনের বীজ বপন’- ইত্যদি অজুহাতে নজরুলের পাঁচটি গ্রন্থ-‘যুগবাণী’ ( প্রবন্ধ সংকলন, ১৯২২). ‘বিষের বাঁশী’ (কাব্য, ১৯২৪), ‘ভাঙার গান’ (কাব্য, ১৯২৪), ‘প্রলয় শিখা’ (কাব্য, ১৯৩০) ও ‘চন্দ্রবিন্দু’ (গীতগ্রন্থ, ১৯৩০)  সরকার বাজেয়াপ্ত করেছে। অপর পাঁচটি গ্রন্থ- ‘অগ্নি-বীণা’ (কাব্যগ্রন্থ, ১৯২২), ‘সর্বহারা’ (কাব্য, ১৯২৬), ‘রুদ্রমঙ্গল’ (প্রবন্ধ, ১৯২৭), ‘ফণি-মনসা’ (কাব্য, ১৯২৭) এবং ‘সঞ্চিতা’ (কাব্য সঞ্চয়ন, ১৯২৮) বাজেয়াপ্তির জন্য সরকার কর্তৃক নিয়েজিত গোয়েন্দারা সুপারিশ করেছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা অন্তর্ভুক্ত ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যটি শেষ পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়নি। তার কারণ, নজরুলের বন্ধু অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ভাষ্যে,
হতে পারে যে, ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যে হিন্দু-মুসলিম’ ঐতিহ্যের চিত্রকল্পের ব্যবহার। আর যে কবিতাটির জন্য গ্রন্থটি
বাজেয়াপ্ত হতে পারতো তার নাম ‘বিদ্রোহী’। এ কবিতায় হিন্দু-মুসলমান দুজনেরই এত পুরাণ প্রসঙ্গ ঢুকেছে যে, বৃটিশ সরকার সরাসরি একে ‘রাজদ্রোহ’ বলে চিহ্নিত করতে পারলো না। কখনো ঈশান-বিষাণের হুঙ্কার বাজছে, কখনো বা ইস্রাফিলের শিঙ্গা থেকে উঠছে রণহুঙ্কার। কখনো বা হাতে নিয়েছে ডমরু-ত্রিশূল, কখনো বা অর্ফিয়াসের বাঁশি। কখনো বা বাসুকির ফণা জাপটে ধরছে, কখনো বা জিবরাইলের আগুনের পাখা, কখনো চড়েছে ‘তাজি বোরাকে’, কখনো উচ্চৈশ্রবায়। একে রাজদ্রোহ বলতে গেলে ধর্মের উপর হাত দেওয়া হবে। (সেনগুপ্ত : ১৪০৫ : ১১৯)
কিন্তু, ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যগ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত না হলেও নিয়োজিত গোয়েন্দা ব্যক্তিরা ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্য গ্রন্থটি যেখানে, যার হাতে পেয়েছে কেড়ে নিয়েছে। বস্তুত অত্যাচারীর শাসকের বিরুদ্ধে এমন ভাষায় আর কোন বাঙালি কবি কখনো চ্যালেঞ্জ জানাতে সাহস দেখায়নি। রাষ্ট্র ও সমাজের উৎপীড়কদের উৎপীড়ণের বিরুদ্ধে এমন শপথ  আর কারো মুখে শোনা যায়নি।
লক্ষ করি, ‘বিদ্রোহী’ কবিতার তাৎপর্য অনুধাবন করতে অক্ষম হয়েছে ধর্মান্ধ মুসলিম সমাজও। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর পরই কবিতার ভাব ও শব্দচয়নের তাৎপর্য না বুঝে এরা ক্ষুব্ধ হয়ে কঠোর ভাষায় নজরুলের নিন্দা করেছে। অপবাদ, গালি দিয়েছে ।স্বসমাজের এমন কূপমণ্ডুক, বিরূপ আচরণ নজরুল অত্যন্ত মনোবেদনার সঙ্গে হজম করেছেন। বিভিন্ন সময়ে চিঠিপত্রে (পত্র নং - চোদ্দ) কবি যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তারই একটি এমন,
বাংলার মুসলিম সমাজ ধনে কাঙাল কিনা জানিনে, কিন্তু মনে যে কাঙাল এবং অতিমাত্রায় কাঙাল, তা আমিবেদনার সঙ্গে অনুভব করে আসছি বহুদিন হতে। আমায় মুসলিম সমাজ ‘কাফের’ খেতাবের যে শিরোপা দিয়েছে, তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি। একে আমি অবিচার বলে কোনদিন অভিযোগ করেছি বলে তো মনে পড়ে না। (ইসলাম : ২০১৫ : ১৮২)
প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁকে লিখিত একই পত্রে নজরুল অন্যত্র বলেছেন, আমাদের বাঙালি সমাজ, নামাজ পড়ার সমাজ। যত রকম পাপ আছে করে যাও-তার জবাবদিহি করতে হয় না এ সমাজে, কিন্তু নামাজ না পড়লে কৈফিয়ত তলব করা হয়। অথচ কোরানে ৯৯৯ জায়গায় জেহাদের কথা এবং ৩৩ জায়গায় সালাতের বা নামাজের কথা বলা হয়েছে। ( প্রাগুক্ত : পৃষ্ঠা-১৯২)

ইসলামের মহানবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহিসসালামের একনিষ্ঠ ভক্ত, নবী প্রেমিক, অসংখ্য কালজয়ী ইসলামি কবিতা, গান, গজল রচয়িতা, কাব্য আমপাড়া-অনুবাদক কবি নজরুলকে তাঁর ধর্মান্ধ স্বসমাজ প্রকৃতপক্ষে চিনতে পারেনি। নজরুলের সমকালে তাঁর বন্ধু বলে কথিত কবি গোলাম মোস্তফার মতো ইসলাম পছন্দ ব্যক্তিত্ব, ‘নওবাহার’ (১৩৫৬) পত্রিকার পরিচালক ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ১৯১ পংক্তির প্যারডি লিখেন ‘নিয়ন্ত্রিত’ নামে যাতে নিম্ন রুচির পরিচয় ছাড়া কৌতুক রস কিংবা সাহিত্য রচনার কোন উদ্দেশ্য ছিল না। কবিতাটি ছাপা হয় ‘সওগাত’ ১৩২৮, ফাল্গুন সংখ্যায়। তার আংশিক এমন-
                ওগো ‘বিদ্রোহী বীর !
            সংযত- কর, সংহত কর উন্নত তব শির !
                  বিদ্রোহী ? -শুনে হাসি পায় !
           ‘বাঁধন হারা’র কাঁদন কাঁদিয়া  বিদ্রোহী হতে সাধ যায় ?
              সে কি    সাজে রে পাগল, সাজে তোর ?
           আপনার পায়ে দাঁড়াবার মত কতটুকু তোর আছে জোর ?
                 ছি ছি লজ্জা ! ছি ছি লজ্জা !
              তোর      কোথা রণ- সাজ-সজ্জা ?   ...
            তুই       বলিবি কাঁদিয়া –‘ক্ষমা চাই প্রভু ক্ষমা চাই,
                  মোর ভক্তি-সাধনা কিছু নাই !’
           তোর     ক্ষমাই তখন হইবে ভীষণ শাস্তি,
                  সকল গর্ব অবসান হবে- বিদ্রোহ- বাণী নাস্তি !
                  আপনারে তুই চিনিবি তখন বিদ্রোহী ওরে বীর !
                   সার্থক হবি মিলনের মাঝে -বিশ্ব-বিধাত্রীর। -(ইসলাম : ১৯৯৯ : ২৮৮-২৯৫)
কবি গোলাম মোস্তফা মৌলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁর ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায়ও নজীর আহমদ ছদ্মনামে নজরুল বিরোধীতা করে লিখছেন। লিখবেন যে, সে সম্পর্কে নজরুল সুহৃদ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের ‘সাপ্তাহিক সওগাত’ পত্রিকার ২৮ অগ্রহায়ণ, ১৩৩৫ সংখ্যায় ‘গোলাম মোস্তফার নূতন উদ্দোম’ শিরোনামে সংবাদ ছাপা হয়েছে তা হলো,
সংবাদ পাওয়া গেল মৌলবী গোলাম মোস্তফা বি এ বি টি সাহেব কবি নজরুলের লেখার
অসারত্ব প্রমাণ করিবার জন্য আর একবারে আদাজল খাইয়া লাগিয়াছেন। শুনেতেছি তাঁহার
এই বহু বিনিদ্র রজনীর ফল আবার ‘মোহাম্মদী’র নজির আহমদ চৌধুরীর বেনামায় ছাপা হইবে। (ইসলাম : ১৯৯৯ : ১০৫)
আর কবি গোলাম মোস্তফা ‘নজীর আহমদ চৌধুরী’ বেনামে যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন সেটি ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার কার্তিক, ১৩৩৫ সংখ্যায় ‘এছলাম ও নজরুল ইসলাম’ শিরোনামে ছাপা হয়েছে। নজরুল সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করে লেখক লিখেছেন, ...তাঁহার প্রধান কৃতিত্ব হইতেছে- খোদাকে অস্বীকার করিয়া, অমান্য করিয়া, অপমান করিয়া। উদাহরণস্বরূপ  মুসলমান পাঠক-পাঠিকাগণকে কবির ‘অগ্নিবীণা’ পুস্তকখানি পাঠ করিয়া দেখিতে অনুরোধ করিতেছি। খোদাতাআলার প্রতি অতি জঘন্য ভাষায় বিদ্রোহ ঘোষণা করাই তাঁহার এই পুস্তকের প্রধান বিশেষত্ব। কবি বিদ্রোহরূপের পরিচয় দিতে দিতে মোছলেম বাঙ্গালার সম্মুখে যে আদর্শ উপস্থিত করিয়াছেন- কোন আজাজীলই আজ পর্যন্ত ততটা করিতে সাহসী হয় নাই।...
যে অসংযত-বাক লেখক নিজেকে জগদীশ্বর বা রাব্বুল আলামীন আল্লার ঈশ্বর বলিয়া প্রকাশ করিতে একটুও দ্বিধা না করেন, যিনি আল্লাহকে ‘খেয়ালী বিধি’ বলিয়া তাঁহার বুকে পদাঘাত করার এমন অনুপম ধৃষ্টতা করিতে আনন্দ ও গৌরব বোধ করেন-...তাহাকে আপন বলিয়া গ্রহণ করা ত দূরে থাকুক - অন্তর হইতে ধিক্কার না দিয়া পারে না।
এছলামের চোখে এ অপরাধ অমার্জনীয়। মুসলমান সাহিত্যিকগণ শত কণ্ঠে ধিক্কার দিয়া এই পাপ আদর্শকে জাতির সম্মুখ হইতে দূর করিয়া দিন। (ইসলাম : ১৯৯৯ : ৯৫-৯৬)
‘মাসিক মোহাম্মদী’ (১৩৩৪) পত্রিকার নজরুল বিরোধীতার উদ্দেশ্যও যে সাহিত্যিক ছিল না তা তাদের পত্রিকার বয়ানে লিপিবদ্ধ আছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা এবং ‘বিদ্রোহী’র পরিপূরক  ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার জ্বালাময়ী রচনাকে উপলক্ষ্য করে পত্রিকার লেখকবৃন্দ কবির নামের আগে ‘শয়তান’, ‘ফেরাউন’, ‘অনাচারী’, ‘নরাধম’, ‘খোদাদ্রোহী’, ধর্মজ্ঞানশূন্য’, ‘বুনো বর্বর’, ‘কুলাঙ্গার’, ‘নমরুদ’, ‘আজাজিল’ ইত্যাদি নাম প্রয়োগ করেছে। একই সময়ে তাল মিলিয়ে নজরুল বিরোধীতায় শক্তির অপচয়ে লিপ্ত হয় ‘ইসলাম দর্শন’(১৩২৭), ‘মোসলেম জগৎ’ (১৩৩২), ‘মোসলেম দর্পণ (১৯২৫), ‘ছোলতান’(১৯২৩) পত্রিকার লেখকেরাও।
বিরোধীতার পাল্লা ওজনে বৃদ্ধি করেছে সমকালে ব্রাহ্মণ্যবাদী চেতনার অন্যতম পত্রিকা, সজনীকান্ত দাসের ‘শনিবারের চিঠি’ (২৬ জুলাই, ১৯২৪) এবং ব্রাহ্ম সমাজের পত্রিকা ‘প্রবাসী’ (১৯০১)। ইতিহাসে নজরুল বিরোধীতায়, ব্যঙ্গ রস সাহিত্যের নামে অ-সাহিত্যিক আচরণে নিন্দুকের সাফল্যজনক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন সজনীকান্ত। ‘শনিবারের চিঠি’র অন্যতম লেখক, সম্পাদক তিনি, তাঁর ‘বিটকেলি পথে’ অবশ্য একা ছিলেন না। প্রধান সারথি হিসেবে পরে যোগ দিয়েছিলেন সমকালের অন্যতম কবি, সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার। যিনি পাঠক সমাজে সর্বপ্রথম অকুণ্ঠ প্রশংসায় নজরুলকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গুরু পদে নজরুলের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন।কিন্তু তিনি নজরুল বৈরী হয়ে ওঠেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর। গুরুতর অভিযোগে আনেন, ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ভাব-সম্পদে তাঁর ‘আমি’ কথিকার প্রভাব আছে বা ‘চুরি’ করা হয়েছে।এ নিয়ে সম্পর্কের পরিণতিতে মোহিতলাল মজুমদার ‘শনিগোষ্ঠি’তে প্রবল উৎসাহের সঙ্গে যোগ দেন। স্মর্তব্য, ‘শনিবারের চিঠি’র জন্ম হয়েছে রামানন্দ চৌধুরী সম্পাদিত ‘প্রবাসী’র গর্ভে, এই কথাটাই প্রমাণ করার জন্য যে, দুটি পত্রিকার আদর্শ ভিন্ন হলেও নজরুল বিরোধীতায় তারা হাত মিলাতে দ্বিধা করেনি। কেননা, নজরুল তাঁর জায়গা থেকে উভয় পত্রিকার স্বার্থ চেতনায় আঘাত দিয়ে থাকবেন।
যদিও জানা আছে, প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ (১৯১৪) পত্রিকায় হবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম নামে করাচি সেনাছাউনি থেকে পাঠানো ‘আশায়’ কবিতাটি রবীন্দ্রঘেঁষা মনে হওয়ায় সম্পাদকের পছন্দ হয়নি। কিন্তু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় উদ্যোগী হয়ে সেটি নিয়ে ‘প্রবাসী’তে দিলে কবিতাটি ছাপা হয়। এই সূত্রে পবিত্রবাবুর সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং ‘প্রবাসী’র সঙ্গে যোগাযোগ। পরবর্তী সময়ে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত ‘প্রবাসী’ পত্রিকা ‘বিদ্রোহী’ পুনর্মুদ্রণসহ নজরুলের এক ডজন কবিতা ছেপেছে। প্রথমদিকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী নজরুলের অনুকূলে ছিল। কিন্তু ‘নজরুল-প্রমীলা’ বিবাহের পর (১৯২৪) ‘প্রবাসী’ কর্তৃপক্ষের সুনজর পাল্টে যায়। তারা নজরুলের আর কোন কবিতা ছাপেনি।  যদিও পত্রিকাটি ব্রাহ্ম সমাজের মুখপত্র ছিলো। এবং বলাবাহুল্য, নজরুল বিরোধিতার মিছিলে ‘প্রবাসী’ও এরপর আর পিছিয়ে থাকেনি।
সন্দেহ নেই, ‘শনিবারের চিঠি’ ছিলো নজরুল বিরোধিতায় ছিল সবার চেয়ে এগিয়ে এবং দলে ভারী। বিস্তৃত বিবরণে না গিয়ে পত্রিকাটিতে যাঁরা ছদ্মনামে লিখতেন তাঁদের স্বনাম ও কবিতার শিরোনামসহ পরিচিতি দিলে বিরোধীতার মাত্রা এবং মানসিকতার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। এই পত্রিকায় শুধু যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ‘ব্যঙ্গ’ কবিতা প্রকাশ পেয়েছে তা নয়, নজরুলের অন্যান্য কবিতা, জননন্দিত গান, বাংলা গজল, অসাম্প্রদায়িক সাম্যবাদী  চেতনা তাঁদের বিদ্রুপের কষাঘাত থেকে রক্ষা পায়নি। যেমন- নজরুলের ‘অগ্নি-বীণা’, বিষের বাঁশী’, ‘ব্যথার দান’কে ব্যঙ্গ করে সজনীকান্ত দাস ‘ভবকুমার প্রধান’ বেনামে লেখেন ‘আবাহন’ (২৮ ভাদ্র, ১৩৩১/১৯২৪), ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারডি লেখেন ‘ব্যাঙ’ শিরোনামে, যোগানন্দ দাস, অশোক চট্টোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস যৌথভাবে রচনা করেন ‘শ্রী অবলা নলিনীকান্ত হাঁ এম.এ.জেড’ ছদ্মনামে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারডি ‘আমি বীর’ (১৮ আশ্বিন, ১৩৩১/১৯২৪), চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ‘কবিদ্রোহী’ শিরোনামে প্যারডি লেখেন (কার্তিক ১৩৩৪ সংখ্যা) ‘শ্রী বটুকলাল ভট্টাচার্য’ ছদ্মনামে। পত্রিকার প্রধান রচয়িতা সজনীকান্ত দাস ‘গাজী আব্বাস বিটকেল’, ‘শ্রী সনাতর দেবশর্মা’, ‘শ্রী মধুকর কাঞ্জিলাল’, ‘শ্রী কোলারাম গাজনদার’ ইত্যাদি বেনামে লিখেছেন নজরুলের অন্যন্য কবিতা, গান ও সম্যবাদী চেতনার ব্যঙ্গ রচনা।
বলেছি, মোহিতলাল মজুমদার ক্ষুব্ধ ছিলেন নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর থেকেই। নজরুল ‘কল্লোল’ পত্রিকায় (১৩৩১, কার্তিক সংখ্যা) লেখেন ‘সর্বনাশের ঘন্টা’ কবিতা। কবিতাটি তাঁকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে ভেবে এর জবাবে মোহিতলাল মজুমদার  রচনা করেন ‘দ্রোণগুরু’। ‘শনিবারের চিঠি’ বিশেষ ‘বিদ্রোহ’ সংখ্যায়  কবিতাটি প্রকাশিত হয়। (ইসলাম : ১৯৯৯ : ২৯৯৯-৩১০) মোহিতলাল মজুমদার পুরো কবিতা জুড়ে নিন্দাবাক্যসহ নজরুলকে অভিশাপ দিয়েছেন, যাতে তাঁর ব্রাহ্মণ্যবাদী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে,

আমি ব্রাহ্মণ, দিব্যচক্ষে দুর্গতি হেরি তোর-
অধঃপাতের নাই দেরী আর, ওরে হীন জাতি-চোর !
আমার গায়ে যে কুৎসার কালি ছড়াইলি দুই হাতে-
সব মিথ্যার শাস্তি হবে সে এক অভিসম্পাতে,
গুরু ভার্গব দিল যা’ তুহারে! ওরে মিথ্যার রাজা!
আত্মপূজার ভণ্ড পূজারি! যাত্রার বীর সাজা
ঘুচিবে তোমার, মহাবীর হওয়া মর্কট সভাতলে!
দু’দিনের এই মুখোশ-মহিমা তিতিবে অশ্রুজলে!  
                         -(অংশবিশেষ, ইসলাম : ১৯৯৯ : ৩০৯-৩১০)
     এছাড়াও মোহিতলাল মজুমদার ‘শ্রী সত্যসুন্দর দাস’ ছদ্মনামে লিখেছেন ব্যঙ্গ রচনা, করেছেন ‘রুবাইয়াৎ-ই-চামার খায় আম’ শিরোনামে নজরুলের গজলের প্যারডি লিখেছেন। অন্যত্র, ‘সাহিত্যের আদর্শ’ শিরোনামে তিনি   নজরুলের ‘বিদ্রোহ’ চেতনার স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন,
অতিশয় অমেধ্য এবং মানবাত্মার পথে গ্লানিকর একশ্রেণীর ভাব ও ভাবুকতা বিদ্রোহের ‘রক্ত নিশান’ উড়াইয়া ভয়ানক আস্ফালন করিতেছেন, এ বিদ্রোহের মধ্যে প্রাণশক্তির প্রাবল্য নাই, মনুষ্যত্বের অভ্রভেদী অভ্যুত্থান কামনা
নাই-মানবাত্মার জয় ঘোষণা ইহাতে নাই। কারণ, মানুষের মধ্যে যে পশু আছে, সেই পশুর ক্ষুধা, রিপুর তাড়না, বিচার ও বিবেক ধর্মহীন কুৎসিৎ দেহসর্বস্বতাই এই বিদ্রোহের মূল প্রবৃত্তি- এক কথায়, ইহা মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে মনুষ্যত্বের আক্রোশ। -(হক : ২০০০ : ৪১)
তবে সমকালে সবচেয়ে বেশি এবং অজীবন নজরুল বিদ্বেষী ছিলেন শ্রীনীরদচন্দ্র চেীধুরী। ‘শ্রী বলাহক নন্দী’ বেনামে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বালখিল্য মন্তব্য তিনি করেছেন। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত নীরদ চৌধুরী ছিলেন শনিগোষ্ঠীর কনিষ্ঠতম সদস্য।  (চলবে)