থেমে গেলেন বলিউডের ‘ডিস্কো কিং’:
গত শতকের আশি আর নব্বইয়ের দশকে ভারতে ডিস্কো মিউজিককে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে দেওয়া গায়ক, সুরকার বাপ্পি লাহিড়ী আর নেই। মঙ্গলবার মধ্যরাতে মুম্বইয়ের জুহুর একটি বেসরকারি হাসপাতালে এই সংগীত পরিচালকের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআই। তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। সংগীত জগতে একের পর এক নক্ষত্র পতনে শোকে স্তব্ধ ভারত। ৬ ফেব্রুয়ারি লতা মঙ্গেশকরের পর মঙ্গলবার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জীবনাবসান ঘটে। সেই শোক না কাটতেই বাপ্পি লাহিড়ীও পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে।
এক মাসের বেশি সময় হাসপাতালে থাকার পর গত সোমাবারেই বাড়ি ফিরেছিলেন বাপ্পি। কিন্তু আবারও স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসককে খবর দেন। পরে তাকে মুম্বাইয়ের ক্রিটিকেয়ার হাসাপাতালে নেওয়া হয়।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. দীপক নামজোশী পিটিআইকে বলেন, “তার অনেকগুলো শারীরিক জটিলতা ছিল। তিনি ওএসএ বা অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার কারণে মারা গেছেন।”
আনন্দবাজার লিখেছে, গত বছর এপ্রিল মাসে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। ওই সময় মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন।
চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসেবে বাপ্পি লাহিড়ীর আবির্ভাব মাত্র ১৯ বছর বয়সে। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘নান্নাহ শিকারি’ সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেন তিনি।
১৯৭০ এর দশকের শেষভাগেই তখনকার বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তার ক্যারিয়ার তুঙ্গে পৌঁছায় এবং ১৯৮০ এবং ৯০ এর দশকেও তা সমান তালে এগিয়ে যায়।
সেই সময়টায় হিন্দি ও বাংলা সিনেমার অন্যতম জনপ্রিয় ও সফল সংগীত পরিচালক ছিলেন বাপ্পি। সিনেমা পাড়ায় সবাই তাকে ভালোবেসে ডাকতেন ‘বাপিদা’।
একের পর এক সুপারহিট গান উপহার দিয়েছেন ভারতীয় সংগীতের দডিস্কো কিং’। হিন্দিতে ‘ডিস্কো ডান্সার’, ‘ডান্স ডান্স’, ‘হিম্মতওয়ালা’, ‘চলতে চলতে’, ‘শরাবি’, ‘সত্যমেব জয়তে’, ‘কমান্ডো’, ‘শোলা অউর শবনম’ সিনেমায় তিনি সংগীত পরিচালনা করেছেন।
কলকাতার ‘অমর সঙ্গী’, ‘আশা ও ভালবাসা’, ‘আমার তুমি’, ‘অমর প্রেম’ সিনেমার গানেও সুর দিয়েছেন; গেয়েছেন একাধিক গান। ২০২০ সালে ‘বাগি-৩’ সিনেমার জন্য গাওয়া ‘ভানকাস’ তার শেষ গান।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আব্দুল জব্বারের গাওয়া ‘হাজার বছর পরে আবার এসেছি ফিরে’ গানটির সুরকার ছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। গানটি লিখেছেন গীতিকার শ্যামল গুপ্ত, যিনি সদ্য প্রয়াত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের স্বামী।
বিবিসি লিখেছে, ‘ডিস্কো ড্যান্সার’ সিনেমায় বাপ্পি লাহিড়ীর গান ‘আই অ্যাম আ ডিস্কো ডান্সার’ বলিউডকে নতুন ধরনের মুক্ত নাচের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ১৯৮২ সালের ওই সিনেমায় তার গানে নেচেই তারকা হয়ে ওঠেন জনপ্রিয় অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী, যিনি পরে নাচের কিংবদন্তী হিসেবে স্বীকৃতি পান ভক্তদের কাছে।
‘ডিস্কো ডান্সার’ গানটি সে সময় ভারতীয় উপমহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য দেশেও জনপ্রিয়তা পায়।
বাপ্পি লাহিড়ীর মৃত্যুর পর এক ভক্ত টুইটে লিখেছেন, “রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোতে ‘আই অ্যাম আ ডিস্কো ডান্সার’ গানের জনপ্রিয়তা দেখে আমি অবাক। সেখানে সবার প্রিয় এ গানটি দেশের দ্বিতীয় সংগীতের মত ছিল।”
ওই গানটির মাধ্যমেই ভারতে ‘ডিস্কো কিং’ হিসেবে পরিচিতি পান বাপ্পি লাহিড়ী। পরে মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে আরও অনেক সিনেমায় তিনি কাজ করেছেন। বেশ কিছু সিনেমা বছরের পর বছর ধরে জনপ্রিয়তা ধরে রাখে।
১৯৫২ সালের ২৭ নভেম্বর জলপাইগুড়িতে বাপ্পি লাহিড়ীর জন্ম। আসল নাম অলোকেশ লাহিড়ী। বাবা অপরেশ লাহিড়ী ও মা বাঁশরী লাহিড়ী দুজনই ছিলেন গানের জগতের মানুষ। ভারতীয় চলচ্চিত্রের আরেক প্রবাদ প্রতীম গায়ক, অভিনেতা কিশোর কুমার ছিলেন তার তুতো মামা।
বাপ্পি লাহিড়ী তার পোশাকের সঙ্গে নানা সোনার গয়না পরতে ভালবাসতেন; বলতেন, ‘আমার ভগবানের নাম সোনা!’
অলঙ্কারিক জাঁকালো সাজ তাকে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য দিয়েছিল। সব সময় চকচকে সোনার চেইন এবং ব্রেসলেট পরতেন। অনেকের জন্য তিনি ছিলেন স্টাইল আইকন। মখমলের জ্যাকেট আর চকচকে জরিদার ঢিলেঢালা পোশাক ছিল তার ট্রেডমার্ক স্টাইল।
বিবিসি লিখেছে, ২০১৬ সালে কিংবদন্তী এই সংগীত পরিচালক বলেছিলেন, সোনার প্রতি তার এই ভালোবাসা আসলে আমেরিকান রকস্টার এলভিস প্রিসলির প্রতি তার ভালোবাসার সঙ্গে জড়িত। এলভিস প্রিসলিও সোনার চেইন পরতেন। এই রকস্টার ও অভিনেতার বড় অনুরাগী ছিলেন ‘ডিস্কো কিং’।
এএনআইকে তিনি বলেছিলেন, “আমি প্রিসলির অনেক বড় ভক্ত। আমি ভাবতাম, আমি যদি কোনো দিন সফল হই, তাহলে আমার একটি ভিন্ন চিত্র আমি তৈরি করব। ঈশ্বরের দয়ায়, এই সোনা দিয়েই আমি সেটা করতে পারব।”
গানের পাশাপাশি রাজনীতির মাঠেও নেমেছিলেন বাপ্পি। কিন্তু খুব একটা স্বস্তিকর ছিলো না সে অভিজ্ঞতা। ২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরে লোকসভা আসনে বিজেপির হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে তৃণমূলের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে হেরে যান।
বাপ্পি লাহিড়ীর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে টুইট করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি লিখেছেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাপ্পি লাহিড়ীর গান মনে রাখবে। প্রাণবন্ত এই শিল্পীর না থাকা অনুভব করবে সবাই।
ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের শিল্পী ও কলাকুশলীরাও জনপ্রিয় এই সুর স্রষ্টার মৃত্যুতে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের তারকারাও তাদের প্রিয় ‘বাপিদা’র মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।
বলিউড অভিনেতা অক্ষয় কুমার টুইট করে বিদায় জানিয়েছেন এই গায়ককে: “বাপ্পী দা, আমিসহ লাখো মানুষের নাচের কারণ ছিল তোমার কণ্ঠ। সংগীতের মাধ্যমে যে সুখ তুমি এনে দিয়েছিলে, সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ।”