ক্রীড়া
প্রতিবেদক: অবিশ্বাস্য, অসাধারণ, অভাবনীয়! প্রায় এক মাসের টুর্নামেন্ট
নানা বাঁক পেরিয়ে, অনেক রোমাঞ্চ ছড়িয়ে, চূড়ান্ত উত্তেজনা জমা রেখেছিল যেন
শেষ সময়ের জন্য। সেই শেষাঙ্কে ফুটে উঠল ক্রিকেটীয় অনিশ্চয়তার সবটুকু। শেষ
বলের ফয়সালায় রচিত হলো আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য। প্রথম বিপিএল শিরোপা নাগালে
পেয়েও হারানোর হতাশায় পুড়ল বরিশাল। তাদের মুঠো থেকে জয় বের করে নিয়ে
কুমিল্লা মেতে উঠল রেকর্ড তৃতীয় শিরোপার বাঁধনহারা উল্লাসে। বিপিএল ফাইনালে
ফরচুন বরিশালকে ১ রানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স।
বিপিএলের আট আসর মিলিয়ে ১ রানের জয়-পরাজয় হলো এখন চারটি। তবে ফাইনালে এই
ব্যবধান এটিই প্রথম।
কুমিল্লার মতো তিনটি শিরোপা আছে ঢাকার
ফ্রাঞ্চাইজিরও। তবে তা ভাগাভাগি করেছে দুটি দল। একক ফ্র্যাঞ্চাইজি হিসেবে
কুমিল্লাই কাই বিপিএলের সফলতম দল।
শেষের একটু আগেও ম্যাচ ছিল দোলাচলে।
শেষ ওভারে বরিশালের প্রয়োজন ছিল ১০ রান। শহিদুল ইসলাম একটি ওয়াইড দিলেও
দারুণ বোলিংয়ে প্রথম ৪ বলে দেন কেবল ৫ রান। পঞ্চম বলে বল আকাশে তুলে দেন
ব্যাটসম্যান তৌহিদ হৃদয়। সহজ সেই ক্যাচ লং লেগে ছেড়ে দেন তানভির ইসলাম।
উল্টো বরিশাল পায় ২ রান।
তাতে শেষ বলে প্রয়োজন পড়ে ৩ রানের। শহিদুলের
ফুল লেংথ ডেলিভারি কাভারে পাঠিয়ে হৃদয় নিতে পারেন স্রেফ ১ রান। দুই রান
নিয়ে ম্যাচ ‘টাই’ করার চেষ্টায় রান আউট হন হৃদয়ের সঙ্গী মুজিব উর রহমান।
আরেকটু
পেছনে গেলে, শেষ ওভারে ১০ রানের সমীকরণও মনে হবে বেশ বিস্ময়কর। শেষ ১৮ বলে
স্রেফ ১৮ রান দরকার ছিল কুমিল্লার। উইকেট বাকি তখনও ৫টি। অসাধারণ এক ওভারে
তখন ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন সুনিল নারাইন।
দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে
ওভারের প্রথম বলে ব্রাভোকে আউট করে নারাইন ওভারে দেন মাত্র ২ রান। পরের
ওভারে মুস্তাফিজুর রহমান কেবল ৬ রান দিয়ে নেন নাজমুল হোসেন শান্তর উইকেট।
এরপর সেই শেষ ওভারের নাটক।
বোলিংয়ের মতো ব্যাট হাতেও কুমিল্লার নায়ক
নারাইন। ব্যাট হাতে যে বিধ্বংসী শুরু তিনি এনে দিয়েছিলেন, দলের রান সেখান
থেকে ১৭০-১৮০ হওয়ার কথা অনায়াসেই। কিন্তু পরের ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা আর
বরিশালের দারুণ বোলিংয়ে তারা আটকে যায় স্রেফ ১৫১ রানে।
টস জিতে
ব্যাটিংয়ে নামার পর থেকেই শুরু নারাইনের ব্যাটিং তাণ্ডব। বরিশালের নতুন
বলের ট্রাম্প কার্ড মুজিবের করা প্রথম ওভার থেকে আসে ১৮ রান। পরের ওভারে
বাঁহাতি পেসার শফিকুল ইসলামকে গুঁড়িয়ে নারাইন নেন আরও ১৮।
সেই স্ট্রোকের
ফোয়ারা ছুটতে থাকে। তৃতীয় ওভারে বাজে শটে লিটন দাস বিদায় নিলেও নারাইনের
ব্যাট ছুটতে থাকে। পঞ্চম ওভারেই তিনি পৌঁছে যান ফিফটিতে।
দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে তিনি ১৩ বলের ফিফটিতে গড়েছিলেন রেকর্ড। সেই ধারা ধরে রেখে ফাইনালে পঞ্চাশ করের ২১ বলে।
৫টি করে চার ও ছক্কায় ২৩ বলে ৫৭ রান করে নারাইন বিদায় নেন ছক্কার চেষ্টায়। তবে পাওয়ার প্লেতে ৭৩ রান তুলে ফেলে কুমিল্লা।
এরপর
তাদের পথ হারানোর শুরু। ডোয়াইন ব্রাভোর দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ে রান আউট হন
মাহমুদুল হক জয়, মুজিবকে ফিরতি ক্যাচ দেন ফাফ দু প্লেসি, ব্রাভোর বাউন্সারে
আউট হন ইমরুল কায়েস, মুজিবের গুগলিতে হতভম্ব হয়ে বোল্ড হন আরিফুল হক।
২৭
রানের মধ্যে ৫ উইকেট হারিয়ে কুমিল্লার ইনিংস তখন প্রায় ধ্বংসস্তুপ। ৬
উইকেটে ৯৫ রান থেকে দলকে এগিয়ে নেন মইন আলি ও আবু হায়দার রনি। ঠাণ্ডা মাথার
ব্যাটিংয়ে দুজন গড়েন ৫৪ রানের জুটি। মইনের ৩২ বলে ৩৮ রানের ইনিংসে দেড়শ
পার হতে পারে তারা।
শেষ ওভারে তিন উইকেট হারানোয় আরেকটু বাড়েনি তাদের রান।
বরিশাল
রান তাড়ার শুরুতেই বড় ধাক্কা খায় মুনিম শাহরিয়ারকে হারিয়ে। ভয়ডরহীন
ব্যাটিংয়ে এবারের আসরে নজর কাড়া ওপেনার আউট হয়ে যান ৭ বলে শূন্য করে।
তবে
সেই ঘাটতি অনেকটাই পুষিয়ে দেন সৈকত আলি। এবারের আসরের শুরুর দিকে তিনটি
ম্যাচ খেলতে পারলেও একাদশের বাইরে ছিলেন তিনি সেই ২৫ জানুয়ারির পর থেকে।
ফাইনালে আবার সুযোগ পান জিয়াউর রহমানের বদলে। তিনে নেমে চোখধাঁধানো সব
স্ট্রোক খেলে চমকে দেন তিনি। ১০ চার ও ১ ছক্কায় ফিফটি করে ফেলেন ২৬ বলেই।
সেই ২০১৩ থেকে বিপিএল খেলছেন সৈকত, তবে এটি ছিল তার মাত্র ত্রয়োদশ ম্যাচ। এতদিনে এসে পেলেন বিপিএলে প্রথম ফিফটির স্বাদ।
গেইল তখনও একপ্রান্ত আগলে আছেন অনেকটা দর্শক হয়ে। ৩৪ বলে ৫৮ রান করে যখন আউট হলেন সৈকত, গেইলের রান তখন ১৯ বলে ১৩!
পরে
নিজের সেরা সময়ের কিছুটা ঝলক দেখিয়ে দুটি ছক্কা ও একটি চার মারেন গেইল। ১২
ওভারেই একশ পেরিয়ে যায় ফরচুন। জয় তখন তাদের জন্য মনে হচ্ছিল স্রেফ সময়ের
ব্যাপার। ৮ উইকেট হাতে নিয়ে ৪৮ বলে প্রয়োজন ছিল মাত্র ৫০ রান।
কিন্তু
ক্রিকেট তো কতবারই দেখিয়েছে, শেষের আগে শেষ নয় কিছুই! দৃশ্যপটে আবারও ফেরেন
ফাইনারের নায়ক নারাইন। আউট করে দেন তিনি ৩১ বলে ৩৩ রান করা গেইলকে।
দারুণ ফর্মে থাকা বরিশাল অধিনায়ক সাকিব (৭ বলে ৭) আউট হয়ে যান মুস্তাফিজের দুর্দান্ত এক ক্যাচে।
তার
পরও ম্যাচ ছিল বরিশালের মুঠোতেই। সপ্তদশ ওভারে যখন শহিদুলের বলে ছক্কা
মারলেন শান্ত, জয়ের জন্য তখন লাগে ২১ বলে ১৯ রান। আরিফুল হকের সরাসরি
থ্রোয়ে তখন রান আউট হয়ে যান নুরুল হাসান সোহান। ক্রমে বদলাতে থাকে ম্যাচের
চিত্র।
বরিশালের আশা আস্তে আস্তে যায় মিলিয়ে। কুমিল্লা দেখা পায় আলোর রেখার। শেষ সময়ে স্নায়ুর লড়াইয়ে জিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তারা সাফল্যে।
শেষ
বলের পর জয় নিশ্চিত হতেই কুমিল্লার ক্রিকেটাররা মেতে ওঠে , দিগ্বিদিক
ছুটোছুটি আর খ্যাপাটে উল্লাসে। পুরো মাঠ প্রদক্ষিণ করে তারা উদযাপন করে
স্মরণীয় জয়।
বরিশালের ড্রেসিং রুমে তখন মুখে রাজ্যের হতাশা নিয়ে দাঁড়িয়ে
সাকিব আল হাসান। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে তিনিই ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট।
কিন্তু ট্রফি মিলিয়ে গেল হাতছানি দিয়েও!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
কুমিল্লা
ভিক্টোরিয়ান্স: ২০ ওভারে ১৫১/৯ (নারাইন ৫৭, লিটন ৪, মাহমুদুল ৮, দু প্লেসি
৪, ইমরুল ১২, মইন ৩৮, আরিফুল ০, আবু হায়দার ১৯, শহিদুল ০, তানভির ০*,
মুস্তাফিজ ০*; মুজিব ৪-০-২৭-২, শফিকুল ৪-০-৩১-২, সাকিব ৪-০-৩০-১, ব্রাভো
৪-০-২৬-১, মেহেদি রানা ৪-০-৩৪-১)।
ফরচুন বরিশাল: ২০ ওভারে ১৫০/৮ (মুনিম
০, গেইল ৩৩, সৈকত ৫৮, সোহান , সাকিব ৭, শান্ত ১৪, ব্রাভো ১, হৃদয় ৯*, মুজিব
৪; মুস্তাফিজ ৪-০-৩১-১, শহিদুল ৪-০-৩৬-১, নারাইন ৪-০-১৫-২, মইন ৩-০-২৮-০,
আবু হায়দার ১-০-১৪-০, তানভির ৪-০-২৫-২)।
ফল: কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ১ রানে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: সুনিল নারাইন।