জাকির হোসেন
আফতাবউল ইসলাম মঞ্জু||
জাকির
হোসেন আমার দেখা একজন নম্র ভদ্র এবং চৌকস রাজনৈতিক ব্যক্তির নাম। আমার
হৃদয়ের সাথে মিশে থাকা বৃহত্তর কুমিল্লার রাজনৈতিক অঙ্গনে যে কয়জন
প্রথিতযশা রাজনেতিক নেতা, স্বাধীনতার স্বপক্ষে রাজনীতির মাঠে থেকে নিজেদের
কুমিল্লার মানুষের জন্য উৎসর্গ করে গেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ন্যাপ নেতা
জাকির হোসেন।
পরম বন্ধুসুলভ মানসিকতার এই মানুষটির সাথে আমার কুমিল্লা
শহরে অনেক স্মৃতি। আমি তখন ভিক্টারিয়া কলেজে পড়ি, ১৯৬৫ সাল। জাকির তখন
ছাত্র ইউনিয়নের একজন সক্রিয় কর্মী। তার তেজদীপ্ত কন্ঠের প্রতিবাদী স্লোগান
আজো আমাকে কুমিল্লার রাজপথে টেনে নেয় পরম মমতায়।
রাজনীতিতে সততা, একনিষ্ঠতা, হৃদয় দিয়ে মানুষকে কাছে নেয়ার যে মানসিকতা
তার
পুরোটাই তার মাঝে বিদ্যমান ছিল। পারিবারিক ভাবে তার সাথে আমার হৃদতাপূর্ণ
সম্পর্ক গড়ে উঠে সেই ছাত্র জীবন থেকেই। তার স্ত্রী শরমিন ছিলেন সদালাপী
মিষ্টভাষী একজন অসাধরণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। সে অপরিমিত বয়সেই মৃত্যু
বরণ করেন।
তারপর থেকে জাকিরের সাথে সম্পর্কটা আরও গভীর হতে শুরু করে।
তার গ্রামের বাড়ি শহরতলী অরণ্যপুর গ্রামে। গ্রামের মানুষের সাথেও
সামাজিকতায় গরিব দুখী মানুষের সহযোগিতায় তার ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মত। তাঁর
মৃত্যুর গত দুই বছর আগেও আমি তাকে দেখার জন্য বারবার তাঁর মগবাজারস্থ
হসপিটালে যাই এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর সাথে কাটাই। অনেক কথা হয় কুমিল্লার
রাজনীতি, সংস্কৃতি এসব নিয়ে। আজকের এই দিনে আমি তাঁকে চোখের জলে স্মরণ করি।
লেখক-সাবেক সভাপতি, আমেরিকান চেম্বার
জাকির ভাইয়ের সান্নিধ্য
ইকবাল আনোয়ার||
দূর
থেকে দেখতাম, মানুষটা মোটা-সোটা, গলার আওয়াজ ভারী, সমাজতন্ত্রে দিক্ষিত,
ন্যাপ এর নেতা। জানতাম মানুষটা, পোড় খাওয়া, ধান্দাবাজীতে নেই, নির্মোহ,
নির্লোভ। বয়সে বড় সংকোচের কারণে কখনো কথা হয়নাই। সিলেট থেকে আসলেই ঘরে
একটু আম্মার সঙ্গে দেখা করেই সুইট হোমের আড্ডায় চলে যাই। সুইট হোমে তাকে
পাই। হঠাৎ তিনি উচ্চস্বরে বলেন, ডাক্তার সাব, আমাদের সাথে একটু কথা বলেন
না। পাথর গলে গেলো। আমি তো এমন একটা কিছুর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
তিনি তার আদর্শের কথা বললেন। দেখি আমার সমন্ধে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক দিকের মন মানসিকতা ও কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে সবই জানেন। কি আশ্চর্য।
আশ্চর্য
হই, দিনে দিনে সম্পর্কের উন্নতি হতে থাকলে। জীবন সংগ্রামে সাহসের সাথে
হাসিমুখে হাল ধরেন তিনি। তারপর বাসা ভাড়ার সূত্রে তার প্রতিবেশিই হয়ে গেলাম
এক সময়। তের বছর ছিলাম একসাথে রাস্তার এপার ও ওপারের বাসিন্দা।
প্রায়
প্রতিদিন তার বাসায় যাই। একদম পশ্চিমের ঘরটাতে তিনি থাকেন। বিয়ে করেন বেশি
বয়সে। বরযাত্রী যেতে পারিনি। ভাবী আসলেন। শরমিন কাদের। অত্যন্ত সামাজিক এক
মহিলা। আমি তাদের দু’জনকে দেখে ভাবলাম যাক এতদিনে জাকির ভাই সংসারী হবেন,
সুখী হবেন।
শরমিন কাদের এক অনন্য গুণী মহিলা। জাকির ভাই এর জন্য এক
সহযোদ্ধা হলেন তিনি। কিন্তু জাকির ভাইকে একা করে চলে গেলেন উপারে। আবার
জাকির ভাই একা।
তার জীবনের মুক্তিযুদ্ধের, সংসারের, নানান খুটিনাটি প্রায় সব কিছু আমার সঙ্গে শেয়ার করতেন এবং আমিও। বয়সের পার্থক্য ঘুচে গেলো।
নি:সন্তান
জাকির ভাই, ভাবী কোনদিনই দু:খ করেননি। এ কথা বলেন নি কখনো। এতটা মাখামাখি
হলে যদিও বলারই কথা। কাজেই বুঝে নেই আমি, জাকির ভাই চাপা একজন মানুষ।
বাইরের যে মানুষটা, হাসি তামাশা করছেন, মিটিং মিছিলে যাচ্ছেন, টেন্ডার ড্রপ
করছেন, প্রায়ই ভাল কিছু রাঁধলে আমায় খেতে ডাকছেন, একটা ঘরকেই কি সুন্দর
করে সাজিয়ে রেখেছেন ভাবী, এসবের ভিতরে অন্য জাকির ভাই জীবন সংগ্রামে যারপর
নাই লড়াই করেছেন নিত্যদিন। কখনও টাকা ধার করেছেন আবার দিয়েও দিয়েছেন। বলেন
আমাকে, ‘জানো একটা টেন্ডারও পাইনা, লাইসেন্স নবায়নই করি। বছর বছর টাকা
দিয়ে।’ একান্তবর্তী পরিবারে জাকির ভাই তার দায়িত্ব পালনে নিরলস। এমন জীবন
সংগ্রামী আমার চোখে আর পরেনি। তার বাসার পশ্চিমের টিনের চাল তর্জার বেড়ার
ঘরটা একটা লঙ্গর খানা যেনো। মরহুম ফরিদ ভাই তো বটেই, বহু নেতা, কর্মী ঐ
ঘরে দিনের পর দিন থাকছেন, জাকির ভাই এর সাথে এক ডাইনিংএ খেতেন। আশ্চর্য্য
মধ্যবিত্ত জীবনে এতসব সয়ে যান কি করে ? তাকে আরো শ্রদ্ধেয় মনে বরণ করলাম
আমি এ জন্য যে, তার নামাজী আস্তিক জীবন এক মধুর ব্যঞ্জনায় বাঁধা। পাঁচ
ওয়াক্ত নামাজি তিনি। কারা যেনো বলেছিলো, কমিউনিষ্ট মানে নাস্তিক। জাকির ভাই
তা ভুল প্রমাণ করলেন। তার ঘরের পেছনে ছোট সুন্দর মসজিদটাতে ফজর থেকে এশা
পর্যন্ত, যদি ঘরে থাকেন, তিনি ও আমি নামাজ পড়তাম। আমাকে তিনি নামাজের পথে
নিয়ে এলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নামাজ কাজা করেননি। আমি পুলিশ লাইনের
বাসায় চলে এলে, তিনি দু:খ পেলেন। অসুস্থ হয়েও আমি তার খোঁজ নেব কি, তিনিই
আমাকে ফোন করে ভালমন্দ কেমন আছি জানতেন। ক্যালেন্ডার ও ডায়রির ভক্ত ছিলেন।
আবার আমার থেকে নিয়ে অন্যদের সব গিফট করে দিতেন। জীবিত অবস্থায় আমি তাঁকে
প্রকৃত মর্যাদা দিতে পারিন, দায়িত্বও পালন করতে পারিনি। এ আমার গভীর
অনুসূচনা। এখন তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে দু এক কলাম লিখে একটু শান্ত¦না
পাই।
আমি সত্য বলতে পারিনা সবসময়, এতো সাহস আমার নাই, জাকির ভাই সত্য
বলার ক্ষেত্রে কোন আপোষ করেননি। ফলে তার সহকর্মী, সহযোদ্ধা অনেকেই তাকে
কষ্ট দিয়েছে, ভুল বুঝেছে, একঘরে করে রেখেছে। এসব আমি জানি, দেখেছি এবং
তিনিও হেসে হেসে কিছু কিছু বলেছেন।
তিনি মৃত্যুর আগে শেষ পর্যন্ত
যতক্ষণ হুশ ছিলো কেবল ভেবেছেন ন্যাপের, দেশের রাজনীতি, মানুষের ভাগ্য
উন্নয়ন ও তার মতাদর্শের, এমনকি ভিন্ন মতাদর্শের নিঃশ্ব অসহায় নেতাকর্মী,
মজলুমদের কথা। আমার কাছ থেকে তাদের জন্য সাহায্য চেয়েও নিয়েছেন। আমার
সাধ্যমত তা করেছি। ভাবীও এমনই ছিলেন। তাদের ধরিয়ে দেয়া দুঃস্থ মানুষ বিশেষ
করে মহিলারা সেই সূত্রে আজও আমার কাছে অনটনে পড়লে আসে।
জাকির ভাই এর
রাজনীতি হলো, মানুষের অন্ন, বস্ত্রের, চিকিৎসার, সংস্থানের রাজনীতি,
মানুষের মর্যাদার লড়াই, সবার জন্য সমান সুযোগ, সঠিক বিচার ব্যবস্থা। যখন
আমরা এসব অর্জন করতে পারবো, কেবল তখনই জাকির ভাইদের আত্মা শান্তি পাবে।
“স্মৃতিতে জাকির ভাই” ফিরোজুর রহমান মোল্লা||
জীবন
নিবেদিত মুক্তি সংগ্রামে যাঁরা তাঁদের একজন কুমিল্লার জাকির হোসেন, আমার
শ্রদ্ধাভাজন জাকির ভাই। তিনি ১৯৫০ সনে ১০ই জানুয়ারি জন্ম গ্রহণ করেন।
তাঁর
সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭১ সনের মে মাসের ২৯/৩০ তারিখ ভারতের আসাম
রাজ্যের তেজপুরে। প্রিয় বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানি হানাদারের কবলে জন্ম ভূমির
মুক্তির লড়াইয়ের সৈনিক হিসাবে জাকির ভাইয়ের ন্যায় আমিও গ্যারিলা প্রশিক্ষণ
গ্রহণের জন্য তেজপুরের সেলোনীবাড়ী সেনানিবাসের অধীনে প্রশিক্ষণরত ছিলাম।
মাতৃভূমির মুক্তির লড়াইয়ে জীবন উৎসর্গীকৃত জাকির ভাইয়ের সাথে সেই প্রশিক্ষণ
শিবির থেকে পথ চলা। সেই প্রশিক্ষণ শিবিরে জাকির ভাইয়ের পাশাপাশি পরিচয় হয়
সৈয়দ আহমদ বাকের, গোলাম ফারুক, নাসিরুল ইসলাম চৌধুরী জুয়েল, হুমায়ূন কবির
মজুমদার, আবু আইয়ুব হামিদ, ওয়ালী হোসেনসহ আরো অনেকের সাথে। কুমিল্লা শহরে
আমার আত্মীয় স্বজনও আছে। কিন্তু কথা প্রসঙ্গে কুমিল্লার কথা উঠলেই আমার
আত্মীয় স্বজনদের নাম ছাপিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই নামগুলি যাঁদের সাথে
গ্যারিলা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম মাতৃভূমিকে দখলদার মুক্ত করার লড়াইয়ে।
প্রশিক্ষণের
দিন গুলিতে অবসরে তাঁর সাথে প্রায়ই কথা হত মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু,
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রগতির আন্দোলন ও মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ
সম্পর্কে। প্রগতির পথের বাধাগুলি সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ আমাকে মুগ্ধ করত।
মুক্ত বাংলাদেশে প্রগতি পথে বাধার সম্মুখীন হলেই স্মৃতিপটে ভেসে উঠত জাকির
ভাইয়ের প্রতিচ্ছবি। মনে হত ৭১'এ জাকির ভাই এ সম্পর্কে কথাগুলি বলেছিলেন।
আন্তর্জাতিক
রাজনীতি সম্পর্কেও তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। তিনি তেজপুরে প্রায়ই বলতেন
সাম্রাজ্যবাদ অবশ্যই আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ব্যর্থ করার সকল প্রচেষ্টা
চালাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। কাজেই ভারত-সোভিয়েত ঐক্য ছাড়া আমাদের মুক্তির
সংগ্রাম হবে অনেক কঠিন।
তেজপুরে প্রশিক্ষণ শেষে আমাদেরকে নিয়ে আসা হল
ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা থেকে ৯০ (নব্বই) কিলোমিটার দূরে বাইখুড়া
নামক স্থানে। বাইখুড়া মূলতঃ ছিল একটি ট্রেনজিট ক্যাম্প। ট্রেনজিট ক্যাম্পে
থাকাকালীন আগষ্ট মাসে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধকে সামনে রেখে। সেটি মৈত্রি চুক্তি নামে হলেও সেটা মূলতঃ ছিল
সামরিক চুক্তি। চুক্তি স্বাক্ষরের সংবাদ পাওয়ার পর জাকির ভাই বলেছিলেন
মুক্তির লড়াই ত্বরান্বিত হবে। পরবর্তীকালে তাঁর ভবিষ্যত বাণী সঠিক প্রমাণিত
হয়েছিল।
স্বাধীনতা পরবর্তী মুক্ত বাংলাদেশে আমি ছাত্র ইউনিয়নের
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হলে জাকির ভাই আমাকে আশীর্বাদ করেন। সৈয়দ
আহমদ বাকের ভাই ছিলেন সেই কমিটির সহ-সভাপতি । ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বা
তাঁর নিজের কোন কাজে ঢাকায় আসলে তিনি মাঝে মাঝে আমার খবর নিতেন। জাকির
ভাইয়ের ন্যায় প্রগতির আন্দোলনের একজন যোদ্ধার সাহচার্য্য আমাকে উৎসাহিত করত
মুক্তির লড়াইয়ে অকতুভয় হতে।
জাকির ভাইয়ের অনুজ বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়ালী
হোসেন আমাকে খবর দেয় যে, জাকির ভাই অসুস্থ হয়ে ঢাকার একটি বেসরকারী
হাসপাতালে আছেন চিকিৎসার জন্য। আমি দেরী না করে তাঁকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে
যাই। কিন্তু দুঃখজনক হল তখন মানুষকে চিনতে কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। তেমন কোন কথা
বলা গেল না তাঁর সাথে। ওয়ালী শুধু জাকির ভাইকে বললেন যে, “ভৈরবের ফিরোজ
ভাই এসেছে” তাঁর অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে কুমিল্লায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং
সেখানে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
জাকির ভাই ১৯৬৪ সাল থেকে তৎকালীন
প্রগতিশীল ছাত্রদের সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। সেই থেকে
সমাজ পরিবর্তনের একজন সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসাবে লড়ে গেছেন আমৃত্যু।
সমাজ
প্রগতির লড়াইয়ের সৈনিকদের মৃত্যু নেই। তাঁরা বেঁচে থাকেন তাঁদের অনুজ
বিপ্লবীদের হৃদয়ে যেমন বেঁচে আছেন সূর্যসেন, মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ
চক্রবর্তী, মনিসিংহ, মোজাফ্ফর আহমেদ প্রমুখ তেমনি ভাবে জাকির ভাই বেঁচে
থাকবেন আমাদের হৃদয়ে এ দেশের লক্ষ কোটি প্রগতিশীল মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায়।
লেখক: এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
দুর্ভাগ্য, জাকির ভাইয়ের জানাজায় শরীক হতে পারিনিশফিক সিকদার ||
জাকির
ভাইয়ের মৃত্যুকালে করোনা মহামারীর কারণে সরকারি হুকুমে আমি ছিলাম ঘরবন্দী।
তারও আগে করোনা ভাইরাস আমাকে ঘায়েল করে হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের
বাহুবেষ্টনীতে আবদ্ধ করেছিল। আমার জীবন মৃত্যুর সেই সন্ধিক্ষণে ভিজিটিং
আওয়ারে আমার ছেলে আমাকে দেখতে এসে অনুচ্চকন্ঠে বলতো জাকির কাকা তোমাকে
স্মরণ করেছে। আমার ছেলেমেয়েরা জানতো কিংবা মনে করতো তাঁর নামটি ঐ অবস্থায়
আমার অচেতন অনুভূতিতে কিছুটা হলেও স্পন্দন জাগাবে। সত্যিই তাই প্রত্যক্ষ
করতো তাঁরা সেদিনগুলোতে। অচেতন আমি টের পেতাম সুদূরের কোন নিঃসীম পারাবার
থেকে কার কন্ঠ থেকে নিঃসৃত হয়ে জাকির নামটি যেন আমার শ্রবণতন্ত্রতে মৃদুলয়ে
খা মারছে। সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আসবার পরে তাদের কাছ থেকে জানতে পারি
নিঃসাড় অচেতন আমি নাকি জাকির ভাইয়ের কথা বলার সাথে সাথে চোখের পাতা মেলে
করুণ চাহনিতে তাকাতাম। তাঁর সাথে এমনই অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে ছিলাম। যা
ছিলো মূলত: মতাদর্শিক। কেবল আমার সাথে নয়, এদেশের বাম গণতান্ত্রিক
আন্দোলনের বহু মানুষের সাথে ছিলো জাকির ভাইয়ের এমন বন্ধন। অজাতশত্রু মানুষ
সমাজে যে নেই এমন নয়, কিন্তু একই সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শ ও আন্দোলনের
ব্যাপারে অনমনীয় এবং দলমতের সীমা অতিক্রম করে সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ
হওয়ার ক্ষেত্রে জাকির ভাই একটা দৃষ্টান্ত। কালমার্কসের সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে
ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস বলেছিলেন যে-মতাদর্শগতভাবে মার্কসের বিরুদ্ধে অনেকেই
ছিলেন কিন্তু ব্যক্তিগত শত্রু একজনও ছিল কিনা সন্দেহ। একই কথা বলা চলে
ধর্ম-কর্ম-গণতন্ত্রের নিশ্চয়তাসহ সমাজতন্ত্রের অনুসারী জাকির হোসেনের
সম্পর্কেও। তিনি লড়াকু ছিলেন। লড়ে গেছেন সকল শোষণ অসাম্য বৈষম্যের
বিরুদ্ধে, কখনো কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। এক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীটা
ছিলো বৈজ্ঞানিক, আবার একই সঙ্গে আবেগ সমৃদ্ধ। জাকির, ওয়ালী, ফারুক, মুকুল,
টুটুল পাঁচ সহোদর ভাই। সমাজসচেতন ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন প্রগতিশীল
রাজনৈতিক সংগঠন ন্যাপের সংস্পর্শে এসে। ন্যাপের মন্ত্রগুরু ছিলেন সংসপ্তক
রাজনীতিক অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। তাঁদের পক্ষে বর্তমান সমাজের প্রথা মেনে
উচ্চ শিক্ষিত-বড় ব্যবসায়ী অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হওয়া অসম্ভব কোন বিষয়
ছিলো না। কিন্তু তাঁরা সেপথে হাঁটেন নি। চলে গেছেন রাজনীতির কঠিন-কঠোর পথে।
অগ্রজ বলে অগ্রগামী ছিলেন জাকির হোসেন। বাকীরা তাঁর অনুগামী হয়েছেন। যেমন
মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অনুগামী হয়েছিলেন অনুজ ওয়ালী হোসেন। দু'জনই সীমান্ত
অতিক্রম করে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছেন আসামের তেজপুরে। যুদ্ধটা যে
অবশ্যম্ভাবী সেটা জাকির ভাই বুঝতে পেয়েছিলেন আগেভাগেই। যখন তাঁর সমসাময়িক
জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকরা সে সত্যটা আমলে নেননি। সরকারি চাকুরিজীবী পিতার
প্রচ্ছন্ন সম্মতি ছিল তাঁর মত-পথের প্রতি। মায়েরও সায় ছিল তাতে। মায়ের
রক্তে ছিল রাজনীতি। মামা মো: আবদুল্লাহ ছিলেন রাজনীতির মানুষ। ছিলেন
সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের বিপক্ষে। ছিলেন
অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের অবিভক্ত
কুমিল্লা জেলার দপ্তর সম্পাদক। মামার অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে এগিয়ে নিতে
জাকির হোসেন এক সময় যুক্ত হয়েছিলেন কমিউনিষ্ট পার্টির সাথে। মনের জোর ছিল
অসাধারণ। বিতৃষ্ণা তাঁর কোথাও কেউ কখনো দেখেনি। যে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচীতে
তাঁকে দেখা যেতো সাবলীল হাস্যোচ্ছল, দেখা যেত সকলকে ছাপিয়ে উঠতে। যেমন
অঙ্গীকারে তেমনি উদ্যমে। ব্যস্ত কিন্তু বিব্রত নয়। ওই ছবিটি এখনও আমি দেখি
তাঁর কথা মনে হলে। ছবিটিতে শুধু যে তাঁকে দেখি তা নয়। দেখি সমাজ
পরিবর্তনকামী সকল মানুষের প্রতিচ্ছবি। এমন মানুষটির জানাজায় শরীক হতে না
পারার দুঃখ, কফিনে একটি রক্তিম গোলাপ না দিতে পারার দুঃখ, তাঁকে শেষ দেখা
দেখতে না পারার দুঃখ অবিরাম-অহর্নিশ আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সান্তনা শুধু
এটুকুই যে, শেষ যাত্রার আগে যখন ঢাকা এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য তখন তাঁর
সাথে কথা হয়েছিল টেলিফোনে। অসুখ যে তাকে কতটা যন্ত্রনা দিচ্ছে বা উদ্বিগ্ন
করছে সেটা বোঝার কোন উপায় ছিলো না। তখনও নিজের রোগ যন্ত্রনাকে আড়ালে রেখে
আমার বন্দীদশার সমব্যথী হয়েছিলেন। বরাবরের মত আমাকে বিপ্লবীমন্ত্রে
উজ্জীবিত করেছেন। বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। বলেছিলেন, বিপ্লবীর মৃত্যু
নেই। বিপ্লবীরা চিরজীবী। জাকির ভাইয়ের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁর এমন
সাহসী উচ্চারণ খুব বেশী মনে পড়ছে। পড়বে নাইবা কেন? তাঁর সান্নিধ্যই যে
একদিন আমার অনভিজ্ঞ, অপরিণত জ্ঞানের অনেক প্রতিরোধ, অনেক বাধার প্রাচীর
অতিক্রমে সহায়ক হয়েছিল। যদিও তাঁর পার্টি ন্যাপ ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের
বিশেষ কিছুই আজ অবশিষ্ট নাই। চিন্তা ভাবনার বড় বড় ঢেউ যেমন উঠে তেমনি আবার
এক সময় পরেও যায়। তবে জাকির হোসেন তাঁর সমকালীন সমাজ ব্যবস্থার বন্ধ জলাশয়ে
যে ঢিল ছুঁড়ে মেরেছিলেন তাঁর ঢেউ আজও আছড়ে পড়ছে তীর থেকে তীরে।
জয়তু জাকির ভাই।
লেখকঃ শফিক সিকদার, সভাপতি, কুমিল্লা (উঃ) জেলা ন্যাপ।