ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
জাতীয় পরিচয়পত্র: কার ভুলে কে খেসারত দেয়
Published : Sunday, 20 February, 2022 at 12:00 AM
জাতীয় পরিচয়পত্র: কার ভুলে কে খেসারত দেয়মোস্তফা হোসেইন ।।
‘কার ভুলে কে খেসারত দেয়’ ঠিক এ কথাটিই মনে আসে সম্প্রতি প্রকাশিত কুড়িগ্রামের বঞ্চিত এক বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলীকে নিয়ে একটি সংবাদ পড়ে। জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখ ভুল হওয়ার কারণে তাকে সম্মানী ভাতা থেকে বঞ্চিত করা হয় দীর্ঘদিন ধরে। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এই বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন টাকার অভাবে।
তার পরিচয়পত্রে  জন্ম তারিখ লেখা হয় ১৯৭১ সালের মে মাসে। অথচ তিনি ওই সময় বুক উঁচিয়ে লড়াই করেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখ ভুল কি তিনি করেছিলেন? অবশ্যই নয়। ভুল করেছে সরকারি কর্তৃপক্ষ। তার দায় সরকারের। সরকারের দায়ে কেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বঞ্চিত হবেন? জীবদ্দশায় তাকে কেন দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হয়েছে সরকারি ভুল সংশোধন করার জন্য? তারপরও সংশোধন করাতে পারেননি। আবারও বলছি, সরকারি ভুলের জন্য একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা কেন বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন?
শুধু কি আকবর আলী? এই কুড়িগ্রামেরই কালে গ্রামের বীর নারী মাজেদা খাতুন এমন ভুলের শিকার। মাস তিনেক আগে হতদরিদ্র এই বীর নারীর মুখোমুখি হয়েছিলাম তার বাড়িতে। দুর্বিষহ চিত্র, দেখে প্রাণ কেঁদে ওঠে। ৫০ বছর ধরে যুদ্ধ করছেন এই নারী। একাত্তরে ছিলেন দুই সন্তানের মা। সেই অবস্থায় বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হন তিনি। অথচ একাত্তরের দুই সন্তানের মা মাজেদা খাতুনের জন্ম তারিখ ১৯৬২ সালে দেখানো হয়। দুবার যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে হাজিরা দিয়েছেন তিনি। সাক্ষী-সাবুদও নেওয়া হয়েছে তাঁর। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি তখনও। সম্মানী ভাতার তো প্রশ্নই আসে না।
মাজেদা খাতুনকে দেখলেই বোঝা যায়, নিরক্ষর এই মানুষটি ভালো করে নিজের ঠিকানাটাও বলতে পারেন না। একাত্তরে পাকিস্তানি বর্বরদের নির্যাতনের যাতনা নিয়ে দিন যায় তার। সঙ্গে যুক্ত হয় সামাজিক অত্যাচার। গঞ্জনা সইতে হয়, আখ্যায়িত হন চরিত্রহীনা বলে। এই মানসিক যন্ত্রণা লাঘবের জন্যই রাষ্ট্র তাদের সম্মাননার ব্যবস্থা করেছে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়েছে অবহেলাকারী অদক্ষ কর্মচারীর বেখেয়াল। কিন্তু খেসারত দিতে হয় মাজেদা খাতুন আর আকবর আলীদের মতো সরল-সহজ মানুষগুলোকে।
পরিচয়পত্রের ভুলের কারণে যে কত মানুষকে প্রতিনিয়ত হয়রানি হতে হচ্ছে তার হিসাব নেই।
আমার বোনের পরিচয়পত্রে আমার বাবার নাম ভুল লেখার পর কর্তৃপক্ষকে সঙ্গে সঙ্গে অবহিত করা হয়। তাকে জানানো হয় পরদিন যেতে। পরদিন যাওয়ার পরও হয়নি। এখানে ওখানে দৌড়াদৌড়ি করে শেষ পর্যন্ত ভুল নামের পরিচয়পত্র দিয়েই পাসপোর্ট করে হজে যাওয়ার টাকা জমা দিয়েছিলেন। আরও কিছু জরুরি কাজ করার জন্য তাকে ভুলকেই শুদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করতে হয়েছে। এখন যদি সংশোধন করাও হয় তাহলে অনেক কিছুতে তার হাত দিতে হবে।
ভুলটা যেহেতু কর্তৃপক্ষের, সংশোধনের আবেদন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অতি দ্রুত আবেদনকারীর কাছে ক্ষমা চেয়ে তা সংশোধনসহ পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটা তাদেরই। উল্টো কার্ডধারীকে ঘুরতে হয় দুয়ারে দুয়ারে। ভোগান্তিতে পড়তে হয় পদে পদে। এর অবসান হওয়া অতি জরুরি।
জাতীয় পরিচয়পত্র এখন নাগরিকের জন্য অতি জরুরি বিষয়। কোটি কোটি টাকা খরচ করে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, ভুল-ত্রুটিগুলো সংশোধনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এত বছর পরও সহজসাধ্য করার কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমি মনে করি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সমুদয় দায়িত্ব এবং সর্বোচ্চ এক সপ্তাহে সংশোধন সম্পন্ন করার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হোক। সাধারণত নিরক্ষর ও সরল-সহজ মানুষদেরই এমন অদক্ষতার শিকার হতে হয়েছে বেশি। তারা বলতেও পারবে না তাদের এনআইডিতে কী কী ভুল আছে। ধরা পড়ে যখন কোনও কাজে হাত দেয় তখন। যখন দেখে বাবার নাম কিংবা নিজের নামটিই ঠিক নেই, কিন্তু তাদের পক্ষে অফিসে অফিসে ধরনা দেওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এমন করাকে অসদাচরণ হিসেবেই গণ্য করা যেতে পারে।
রাষ্ট্র তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর প্রয়োজনেই কিছু সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছে। এটা তাদের প্রতি করুণা নয়। রাষ্ট্রের দায় শোধের একটা উপায় মাত্র। আর সেখানে যদি তাদের এমন অবস্থার মুখে পড়তে হয় তখন নাগরিক হিসেবে আমাদের মুখ থাকে না।
মুক্তিযোদ্ধারা প্রাকৃতিক কারণেই হারিয়ে যাচ্ছেন। যারা বেঁচে আছেন তারা বয়সজনিত নানা রোগে ভুগছেন। এই মুহূর্তে মহান মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সামাজিক নিরাপত্তা। বার্ধক্যজনিত জটিল রোগমুক্তিতে নিয়মিত চিকিৎসা পাওয়াটা তাদের অধিকার। কিন্তু এই বীরদের মরতে হয় বিনা চিকিৎসায়। ৫০ বছরেও আমরা এই বীরদের অবাধ চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করতে পারিনি। এই মুহূর্তে অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সব দায়িত্ব সরকারকে নেওয়া জরুরি বলে মনে করি। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা যাতে প্রয়োজন হলেই তার পছন্দের হাসপাতালে বিনা ব্যয়ে চিকিৎসা করাতে পারেন সেই ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে করতে হবে। শুধু সরকারি হাসপাতালে রেয়াতি সুবিধা নয়, যেকোনও চিকিৎসার ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। তারা যাতে মরণকালে দেখে যেতে পারে, দেশ তাদের সম্মান করেছে, তারা যেমন দেশ চেয়েছিলেন তার কিছুটা হলেও বাস্তবায়ন হয়েছে। এটা তাদের মৌলিক অধিকার।
মুক্তিযোদ্ধার যাচাই-বাছাই অনেক দেখেছি আমরা। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার প্রসঙ্গও শুনেছি। ভুয়াদের কারণে প্রকৃত কোনও মুক্তিযোদ্ধা বঞ্চিত হবে তা হতে দেওয়া যায় না। কে ভুয়া কে প্রকৃত এটা যাচাই হোক হতে থাকুক। ভুয়া প্রকৃত নিয়ে কামড়াকামড়ি করে প্রকৃতদের দমিয়ে রাখা, তাদের ভাগ্যবঞ্চিত করাটা অনাকাঙ্ক্ষিত।
এই মুহূর্তে পরিচয়পত্র সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হোক। সপ্তাহকাল এই কাজের জন্য প্রাথমিক অবস্থায় সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হোক। এনআইডি সংশোধন কার্যক্রম হাতে নিয়ে সবার এনআইডি সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া এখন খুবই জরুরি।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।